জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হলেই টানা কর্মসূচিতে যাবে বিএনপি। দলটি তাদের এই আন্দোলনকে ‘একদলীয় নির্বাচন প্রতিহত’ কর্মসূচি বলতে চাইছে।
আগামী তিন মাসের মধ্যে বিএনপির টানা আন্দোলনের প্রথম লক্ষ্য হচ্ছে সরকারের জন্য রাষ্ট্র পরিচালনা কঠিন করে দাবি আদায়ে বাধ্য করা। দ্বিতীয়ত, দাবি না মানলে ভোটকে অগ্রহণযোগ্য করতে ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি কমিয়ে আনা।
বিএনপির চেয়ারপারসন ও বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া দলের সর্বশেষ স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, রাজনৈতিক পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার দ্রুত নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করতে পারে। মধ্য নভেম্বরের মধ্যে এটা হতে পারে বলেও তিনি জানান। তবে নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, তারা নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যে তফসিল ঘোষণার পরিকল্পনা করছে।
বিএনপির নেতারা বলছেন, আন্দোলনের লক্ষ্য তাঁরা নির্ধারণ করেছেন। পরিকল্পনা করে কর্মসূচি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এখন বাস্তবায়নই বড় কথা। যদিও মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন পর্যন্ত সরকারের সঙ্গে সমঝোতার সুযোগ আছে। সমঝোতা হলে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮-দলীয় জোট নির্বাচনে অংশ নেবে। এ জন্য আরও ৪০ দিন সময় হাতে থাকছে। এ সময়ের মধ্যে আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের বিরুদ্ধে যাতে জনমত গড়ে তোলা যায়, সে রকম কর্মসূচি দেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়েছে।
বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা মনে করেন, বিএনপি টানা আন্দোলন শুরু করলে দেশের অভ্যন্তরে খাদ্যের জোগানব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। বিশেষ করে ঢাকার ভেতরে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সংকট দেখা দেবে। আর এটা হলে খাবারের দাম বেড়ে যাবে। এতে একদিকে ভোক্তারা সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ হবেন, অন্যদিকে কৃষকের পণ্য বাজারজাত না হওয়ায় তাঁরাও ক্ষেপে উঠবেন। নিত্যপণ্যের সরবরাহ ঠিক না থাকলে সরকার বেকায়দায় পড়বে। দ্বিতীয়ত, টানা হরতাল-অবরোধে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পুলিশ ও প্রশাসনের মধ্যে হতাশা তৈরি হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, টানা হরতাল বা অবরোধ কর্মসূচি চলতেই থাকবে। কিছুদিনের মধ্যেই এ ধরনের কর্মসূচি দেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়েছে। হরতাল-অবরোধে নিত্যপণ্যের বাজারে প্রভাব পড়বে। সরকার এটা সামাল দিতে না পারলে দায় তাকেই নিতে হবে।
আবার বিএনপির একটি অংশ মনে করে, আন্দোলনের মাধ্যমে নির্বাচন ঠেকানো যাবে না। তাই শেষ পর্যন্ত দাবি আদায় না হলে তাদের লক্ষ্য হবে নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি একেবারেই কমিয়ে আনা। দলটি মনে করে, ভোট কম পড়লে কোনো মহলেই এ নির্বাচন সমর্থনযোগ্য হবে না।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এম কে আনোয়ার বলেছেন, বিএনপি জনগণের সমস্যার কথা চিন্তা করে খুব কঠোর হয়নি। কিন্তু এখন আর উপায় নেই। আন্দোলন ছাড়া দাবি আদায়ের পথ ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছে।
চার ধাপে কর্মসূচি দেবে বিএনপি: বিএনপির নীতিনির্ধারণ করেন এবং কর্মসূচি তৈরির কাজে সক্রিয় অংশ নেন এমন এক নেতা বলেন, এখন থেকে আগামী তিন মাসকে চার ভাগে ভাগ করে আন্দোলনের কর্মসূচি নির্ধারণ করা হবে।
প্রথম ধাপে আজ থেকে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগ পর্যন্ত কর্মসূচি থাকবে কিছুটা বিরতি দিয়ে। এই সময়ের মধ্যে সপ্তাহে তিন দিন হরতাল বা অন্য কোনো কর্মসূচি দেওয়া হবে। পরীক্ষার বিষয়গুলো যতটা সম্ভব বিবেচনায় আনা হবে। এ সময়ের আন্দোলন হবে নির্দলীয় সরকারের দাবিতে। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের কথাও বলা হবে।
দ্বিতীয় ধাপের সময় ধরা হবে তফসিল ঘোষণার দিন থেকে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন পর্যন্ত। প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের এই সময় পর্যন্ত সরকারের সঙ্গে একটা সমঝোতার সুযোগ থেকে যায়। দ্বিতীয় ধাপে টানা কর্মসূচি থাকলেও সমঝোতার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। তফসিল ঘোষণার পর থেকেই নির্দলীয় সরকারের দাবির আন্দোলন রূপ নেবে ‘নির্বাচন প্রতিহতের’ আন্দোলনে।
তৃতীয় ধাপের সময়টি হবে মনোনয়নপত্র বাছাই থেকে শুরু করে ভোট গ্রহণের দিন পর্যন্ত। এ সময় টানা হরতাল বা অবরোধ অথবা অসহযোগের মতো কর্মসূচি দেওয়া হবে। ভোটের আগের ১৫ দিন শুক্র ও শনিবার ছুটির দিনও টানা কর্মসূচির মধ্যে থাকবে। ওই সময় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হবে, যেন সাধারণ মানুষ ভোটকেন্দ্রে যেতে ভয় পায়।
এই ১৫ দিন বিএনপি ও তার জোটের সমন্বয়ে গড়া ‘সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি’ কাজ করবে। ভোটকেন্দ্রভিত্তিক এই কমিটিগুলো ভোটারদের ভোটদানে নিরুৎসাহিত করবে। ভয়ভীতিও দেখাবে। একই সঙ্গে বিএনপির শীর্ষপর্যায় থেকে ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হবে।
এর পরও নির্বাচন হলে পরিস্থিতি বুঝে কর্মসূচি দেবে বিএনপি। অর্থাৎ ভোটার উপস্থিতি কেমন ছিল এবং দেশে-বিদেশে নতুন সরকারের অবস্থান দেখে কর্মসূচি দেওয়া হবে। এ বিষয়টি নিয়ে দলে এখনো তেমন আলোচনা হয়নি। তবে বিএনপির নীতিনির্ধারকদের বিশ্বাস, একতরফা নির্বাচন করে আওয়ামী লীগ টিকে থাকতে পারবে না।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথম আলোকে বলেছেন, তাঁরা সমঝোতাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন, এখনো দিচ্ছেন। কিন্তু সরকার সেই পথে না হাঁটলে কঠোর আন্দোলনের মাধ্যমেই দাবি আদায় করা হবে। বিএনপি জনগণকে নিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে আন্দোলন করে দাবি আদায় করবে, নয়তো নির্বাচন প্রতিহত করবে।