দেশের অর্থনৈতিক কর্মচাঞ্চল্যে গতিময়তা কমে গেছে। আর দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রভাব মোকাবিলায় অর্থনীতির নিজস্ব পদক্ষেপগুলো ব্যবহারের সুযোগ ধীরে ধীরে সীমিত হয়ে যাচ্ছে। অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়েছে।
এই অবস্থায় নির্বাচনের বছরে এসে বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমবে, কমবে রাজস্ব আয়, বাড়বে রাষ্ট্রীয় ব্যয়। পাশাপাশি টাকা পাচার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। ইতিমধ্যে এগুলোর আভাস মিলেছে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) গতকাল মঙ্গলবার তাদের ধানমন্ডির নিজস্ব কার্যালয়ে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে এসব কথা বলেছে। এতে ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি ২০১৩-১৪: বাজেটের তিন মাস পরে, নির্বাচনের তিন মাস আগে’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন সিপিডির বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। স্বাগত বক্তব্য দেন প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান। আরও উপস্থিত ছিলেন আনিসাতুল ফাতেমা ইউসুফ, ফাহমিদা খাতুন, খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, তৌফিকুল ইসলাম খান প্রমুখ।
এতে গত ২০১২-১৩ অর্থবছরের অর্থনীতির সার্বিক ও চলতি ২০১৩-১৪ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের বিশ্লেষণ তুলে ধরে আসন্ন নির্বাচন ঘিরে অর্থনীতি কোন দিকে যেতে পারে তার একটি প্রক্ষেপণ উপস্থাপন করা হয়।
এতে বলা হয়, নির্বাচনী বছরে প্রবৃদ্ধি কমে যায়। যেমন ১৯৯৪-৯৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৪ দশমিক ৯০ শতাংশ হলেও ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছরে তা হয় ৪ দশমিক ৬০ শতাংশ। ১৯৯৬ ছিল নির্বাচনী বছর। একইভাবে ২০০০-০১ অর্থবছরের ৫ দশমিক ২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ২০০১-০২ অর্থবছরে হয় ৪ দশমিক ৪০ শতাংশ (২০০১ নির্বাচনী বছর) এবং ২০০৭-০৮ অর্থবছরের ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ৫ দশমিক ৭০ শতাংশ হয় (২০০৮ নির্বাচনী বছর)।
এই প্রবণতা অনুসারে চলতি ২০১৩-১৪ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের নিচে থাকবে বলে মনে করেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, মূলত গত অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে এসে অর্থনীতির গতি এতটাই মন্থর হয়ে পড়েছে, যা চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকেও প্রতিফলিত হচ্ছে। এর ফলে যেসব পূর্বানুমানের ওপর ২০১৩-১৪ অর্থবছরের বাজেট ও ৭ দশমিক ২০ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল, সেসব পূর্বানুমান অবান্তর হয়ে পড়ছে।
দেবপ্রিয় আরও বলেন, আবার নির্বাচনের বছরে আগের চেয়ে বেশি হারে কর আদায় হবে বলে মনে হয় না। বিগত তিনটি নির্বাচনী বছরের সঙ্গে আগের বছরের কর আদায় কিছুটা কম হওয়ার তুলনা দেখিয়ে তিনি বলেন, চলতি অর্থবছর আগের বছরের চেয়ে ২৫ শতাংশ বেশি কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও গত বছরের সংশোধিত বাজেটের ভিত্তিতে তা দাঁড়ায় ৩০ শতাংশ, যা অভূতপূর্ব। কিন্তু প্রথম দুই মাসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর আদায়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৬ শতাংশ।
এ ছাড়া নির্বাচনের বছরে রাজস্ব ব্যয় বেড়ে যাওয়া ও রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ কমে যাওয়ার পূর্ববর্তী সময়ের উপাত্ত তুলে ধরা হয় সিপিডির উপস্থাপনায়। এ প্রসঙ্গে দেবপ্রিয় বলেন, গত অর্থবছরও বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের ঘাটতি অনেকটা মিটিয়েছিল সরকারি বিনিয়োগ। এবার তা হবে না।
দেবপ্রিয় বলেন, রাজনৈতিক-ব্যবসার চক্রে প্রবেশ করলে সহসা তা থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব হবে না। আর তাই প্রবৃদ্ধির ধারা একবার কক্ষচ্যুত হলে তা ফিরে আসতে সময় লেগে যাবে। এ রকম পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক অভিঘাত থেকে অর্থনীতিকে বাঁচাতে হলে রাজনীতির উচ্চবর্গের ব্যক্তি-গোষ্ঠীর সক্রিয়তা প্রয়োজন।
দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর দিকে ইঙ্গিত করে দেবপ্রিয় বলেন, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষার বিষয়ে তাদের একটি যৌথ স্বার্থ আছে, আছে অভিন্ন স্বার্থ। কাজেই এই জায়গায় সমঝোতা করার সুযোগ আছে।
দেবপ্রিয় বলেন, এমন কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড যেন না হয় যাতে মানুষের জীবন-জীবিকা বিঘ্নিত হয়, সম্পত্তি বিনষ্ট হয় ও আন্তর্জাতিকভাবে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়। আর তাই অর্থনীতির জন্য একটি রক্ষাকবচ তৈরি করতে হবে, যা হতে হবে রাজনীতির ঊর্ধ্বে।
এক প্রশ্নের জবাবে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সম্প্রতি সময়ে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি বাড়ছে বলে উপাত্ত মিলছে। কিন্তু আসলে কতটা যন্ত্রপাতি দেশে আসছে আর কতটা ওভার ইনভেয়সিংয়ের (বেশি মূল্য দেখানো) মাধ্যমে টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে, বোঝা যাচ্ছে না। বিশেষত মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি করে ব্যবহার বিষয়টি উৎপাদনে এখনো সেভাবে প্রতিফলিত হয়নি।
মোস্তাফিজ আরও বলেন, প্রায় সব মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির শুল্কহার শূন্য। কাজেই শুল্ক আদায়ের উপাত্ত থেকেও প্রকৃত চিত্র বোঝা যাবে না।
প্রতিবছর গড়ে ১৫০ কোটি ডলার করে দেশ থেকে পাচার হয়ে যায়—গ্লোবাল ফাইনান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির এই তথ্য উদ্বৃত্ত করে মোস্তাফিজ আরও বলেন, বিগত সময় নির্বাচনের বছরকে সামনে রেখে টাকা পাচার বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা গেছে।