ভারতীয় চ্যানেল দেখতে বছরে হাজার কোটি টাকা ব্যয় করছে বাংলাদেশ

0
166
Print Friendly, PDF & Email

ভারতীয় চ্যানেল দেখতে বাংলাদেশ বছরে ব্যয় করছে প্রায় হাজার কোটি টাকা। এর সাথে ভারতীয় বিভিন্ন পণ্য প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে এখানে তাদের বাজার তৈরি হচ্ছে। এ রকম পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের কোনো চেষ্টাই করছে না সরকার। ভারতীয় চ্যানেল থেকে দর্শকের দৃষ্টি সরাতে সরকার দেশে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক টেলিভিশন চ্যানেলের লাইসেন্স দিয়েছে বলে দাবি করেছেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, তবে এতে সফল হতে পারেনি। দেশের বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আইয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগর বলেন, চ্যানেল বেড়েছে ঠিকই তবে মান বাড়েনি। ভারতীয় চ্যানেলের অভ্যস্ততা কাটাতেও কিছুটা সময় লাগবে বলে মনে করেন তিনি। পরিশোধ করতে হয় হাজার কোটি টাকা : দেশে ২৭২টির মতো চ্যানেল দেখা যায় বলে ক্যাবল টিভি ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন। এর মধ্যে ৪০টির মতো চ্যানেল বাংলাদেশ কিনে দেখায়। এ সব চ্যানেলের সবগুলোই ভারতীয়। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের চ্যানেল এইচবিও এখন ভারত থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয় বলে এর জন্য পেমেন্টটাও সেখানে করতে হয়। বাংলাদেশে ভারতীয় চ্যানেল আমদানি করে থাকে দুইটি প্রধান প্রতিষ্ঠান। এর একটি মোহাম্মদী গ্রুপ। এর মালিক এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি ও জনপ্রিয় টিভি অনুষ্ঠান উপস্থাপক আনিসুল হক। অন্য পরিবেশক আবুল খায়ের লিটুর বেঙ্গল গ্রুপ। অথচ বেঙ্গল গ্রুপ দেশজ সংস্কৃতি চর্চার কথা বলে ধানমন্ডিতে গড়ে তুলেছে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন। এ দুইটি প্রতিষ্ঠান থেকেই মূলত ক্যাবল টিভি ব্যবসায়ীরা পে চ্যানেলগুলো কিনে গ্রাহকদের মধ্যে সংযোগ দিয়ে থাকে। এ জন্য পরিবেশকদের গ্রাহক প্রতি চ্যানেলের জন্য আলাদা পেমেন্ট করতে হয়। ইউনাইটেড ক্যাবল সার্ভিসের ইঞ্জিনিয়ার ফারুক আহমেদের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা স্টার গ্রুপের চ্যানেল প্রতি ৫১ টাকা এবং সনি গ্রুপের চ্যানেল প্রতি ৬০ টাকা করে প্রতি মাসে দিই পরিবেশকদের। এর সাথে তাদের আবার ৩৩ দশমিক ৭ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয়। সে হিসাবে স্টার গ্রুপের এটি চ্যানেলের জন্য গ্রাহকপ্রতি দিতে হয় ৭৩ টাকা ৩১ পয়সা। সনির জন্য দিতে হয় ৮৬ টাকা ২৫ পয়সা। বাংলাদেশে সব মিলিয়ে বছরে অন্তত এক হাজার কোটি টাকা এ খাত থেকে ভারত চলে যাচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। হিন্দির আগ্রাসন : হিন্দির আগ্রাসনে বিপর্যস্ত দেশজ সংস্কৃতি। ভারতীয় সংস্কৃতির চলমান আগ্রাসন নতুন প্রজন্মকে নিজস্ব সংস্কৃতিবলয় থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগের ওয়েব সাইট ফেসবুকে পাঁচ হাজারেরও বেশি তরুণ-তরুণীর প্রোফাইল দেখে জানা গেছে, যে দেশটি বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতির জন্য রক্ত দিয়েছে সে দেশের নতুন প্রজন্মের প্রিয় সিনেমার তালিকায় হিন্দির আধিপত্য। বাংলা সিনেমার নাম নেই বললেই চলে। একই সাথে প্রিয় টিভি শোয়ের জায়গায় হাতে গোনা দুই-চারজন বাদে সবারই প্রিয় ভারতীয় টিভি চ্যানেলের সিরিয়াল ও রিয়্যালিটি শো। আর এর ফলে বাংলাদেশে গড়ে উঠেছে ভারতীয় শিল্পীদের নিয়ে বাণিজ্য। তাদের টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠান উপভোগ করতে বছরে প্রায় হাজার কোটি টাকা চলে যাচ্ছে বাংলাদেশের মানুষের পকেট থেকে। ভাষা সৈনিক আবদুল মতিন বলছেন, ভাষার প্রতি এ রকম উন্নাসিকতা এবং নিজের সংস্কৃতির প্রতি মনোযোগ বিপন্নতা আমাদের পীড়া দেয়। নতুন প্রজন্মকে তার ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি অনুরক্ত হতে হবে। ভাষা মতিন বলেন, বিশ্বায়নের একটা প্রভাব থাকতেই পারে। তাই বলে আমরা নিজেদের ভুলে যাবো, তা মেনে নেয়া যায় না। খ্যাতিমান শিল্পী আবদুল জব্বার বলেন, ভালো কিছু গ্রহণ করতে আপত্তি নেই। কিন্তু অবাধে সব উন্মুক্ত করে দেয়ার পক্ষেও আমি নই। আমাদের সংস্কৃতি কোনোভাবেই খাটো করে দেখার উপায় নেই। ভারতীয় শিল্পীদের আধিপত্য : বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া খবরে জানা গেছে, ২০০৯ থেকে চলতি বছরের অক্টোবরের প্রথম পর্যন্ত বাংলাদেশে সাড়ে ৩০০ ভারতীয় শিল্পী এসেছিলেন। সে জন্য তাদের পেছনে খরচ হয়েছে শত কোটি টাকারও বেশি। এ সব টাকার জোগান দেয়া হয়েছে দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের স্পন্সর ও দর্শকদের কাছে বিক্রি করা টিকিট থেকে। সাধারণ দর্শকের জন্য এ সব আয়োজনের বাইরেও নিটওয়্যার প্রস্তুত ও রফতানিকারকদের সমিতি বিকেএমইএ, তৈরী পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতি বিজিএমইএ, টেক্সটাইল মিল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএ তাদের বার্ষিক অনুষ্ঠানগুলোতে ভারত থেকে শিল্পী নিয়ে আসে। এ সব অনুষ্ঠানের উপস্থাপক পর্যন্ত এসেছেন ভারত থেকে। রাজধানীতে ফ্যাশন শো, শপিং মলের উদ্বোধন করতেও আনা হচ্ছে ভারতীয় অভিনেত্রী, মডেল ও র‌্যাম্প মডেলদের। ভারতীয় রাজনীতিক ও কলাম লেখক শশী থারু তার এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, বলিউড হলো সফট পাওয়ার। এ পাওয়ার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মতো কামানোর গোলা বর্ষণ করে না ঠিকই, কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের রুমে যে বাক্সটি রয়েছে তার ভেতর দিয়ে সংস্কৃতির গুলি বর্ষণ করে। আর সে গুলি বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে তছনছ করে দেয়। এ জন্য অভিভাবকেরা আকজাল শিশু- কিশোরদের হিন্দি কথামালায় উদ্বিগ্ন হন না। সংস্কৃতির আগ্রাসনের রূপ তুলে ধরে মারাঠি রাজনীতিক শঙ্কর রাও দেও ভারতের লোকসভায় বলেছিলেন, নেহেরু শুধু সংস্কৃতির কথা বলেন, কিন্তু ব্যাখ্যা দেন না। সংস্কৃতি বলতে তিনি কী বোঝাতে চাচ্ছেন। আজ বুঝলাম সংস্কৃতি মানে হলো বহুর ওপর স্বল্পের আধিপত্য। ভারতের হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার পর তিনি এ বক্তব্য রেখেছিলেন। অনুষ্ঠানের সাথে বিজ্ঞাপন : বাংলাদেশের কোনো টিভি চ্যানেল ভারতে দেখানো হয় না। অথচ তাদের প্রায় সব টিভি চ্যানেল বাংলাদেশ টাকা দিয়ে দেখে। একই সাথে আসে সে দেশের পণ্যের বিজ্ঞাপন। এর মধ্য দিয়ে এখানে তাদের একটি বড় বাজার তৈরি হচ্ছে। গুলশান এলাকায় ক্যাবল টিভির ব্যবসা পরিচালনা করেন আবু তাহের মন্টু। তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, তারা আমাদের চ্যানেল দেখায় না। এর জন্য তাদের বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই। অথচ বাংলাদেশ তাদের সব চ্যানেল দেখায়; সেই সাথে বিজ্ঞাপনও। এ থেকে বাংলাদেশ সরকার কোনোভাবেই লাভবান হচ্ছে না।

শেয়ার করুন