বক্তব্য-বিবৃতিতে কঠোর অবস্থান স্পষ্ট হলেও আগামী নির্বাচন একতরফা না-কি সব দলের অংশগ্রহণে এ প্রশ্নের নিষ্পত্তি এখনও পুরোপুরি করতে পারেনি সরকার। নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলোর দাবি, এ প্রশ্নে সরকারে এখনও কিছুটা মতদ্বৈধতা রয়ে গেছে। ফলে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোকে বাদ দিয়ে নির্বাচন হলে সম্ভাব্য পরিস্থিতি কি দাঁড়াতে পারে তা নিয়ে যেমন আলোচনা হচ্ছে; পাশাপাশি নির্বাচনে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক মহলের অবস্থান কি দাঁড়ায়, আলোচনা হচ্ছে তা নিয়েও। এ ছাড়া নির্বাচনের সময়ে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও পশ্চিমা বিশ্বের সম্ভাব্য সমর্থনের বিষয়টিও গুরুত্ব সহকারে দেখা হচ্ছে। নির্বাচনের সময় সরকার প্রশাসনিক কাঠামোতে নিয়ন্ত্রণও পুরোপুরি নির্বিঘ্ন করতে চায়। চায় মিত্র রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি সমর্থক গোষ্ঠী ও শুভানুধ্যায়ীসহ সুশীল সমাজকেও পক্ষে রাখতে। সব মিলিয়ে সম্ভাব্য সব পরিস্থিতি সরকার পর্যালোচনা করে দেখছে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফরুল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, সরকার সব দলের অংশগ্রহণেই নির্বাচন চায়। এখনও সময় আছে আলোচনা করে একটা গ্রহণযোগ্য সমাধানে আসার। কিন্তু বিরোধী দল যদি আন্দোলনের হুমকি দিতেই থাকে, আর নির্বাচন প্রতিহত করাকেই গুরুত্ব দেয় এবং শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে না আসে তাহলে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে অনেকের অংশগ্রহণ ছাড়াই যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তিনি বলেন, আমরা যেমন নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছি, তেমনি বিএনপির সংগ্রাম কমিটি গঠন করে নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা আমলে নিয়েও রাজনৈতিক কর্মপদ্ধতি ঠিক করা হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, সরকার সংবিধান অনুযায়ী যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানে বদ্ধপরিকর। সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করার লক্ষ্যে কাজ চলছে। এ নির্বাচনে বিএনপিও অংশগ্রহণ করবে বলে দৃঢ়তার সঙ্গে দাবি করেন তিনি। হানিফ বলেন, ‘বিএনপি নির্বাচনে আসবে, ওয়েট অ্যান্ড সি’। বিরোধী দলের নির্বাচন প্রতিরোধের বিষয়ে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি জানতে চাইলে তিনি বলেন, গত তিন বছর ধরেই তারা নানা হুমকি দিয়ে আসছে। কিন্তু কোনো কিছু দৃশ্যমান ছিল না। হুমকিতেই সীমাবদ্ধ ছিল তাদের আন্দোলন। তাদের আন্দোলন, নির্বাচন প্রতিরোধের হুমকিও আইওয়াশ। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সেটা আমলে নিচ্ছে না। কাজেই মানুষের আতংকের কিছু নেই, সঠিক সময়েই নির্বাচন হবে।
আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানায়, নির্বাচন পদ্ধতি এবং নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে প্রধান বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনার বিভিন্ন উদ্যোগ ভেস্তে যাওয়ার পর এখন পরবর্তী করণীয় নিয়ে ভাবছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এর অংশ হিসেবে বিভিন্ন দেশের নির্বাচনী কাঠামো পর্যালোচনা, সংবিধান পর্যালোচনা, কূটনৈতিকদের সঙ্গে যোগাযোগ, নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করা এবং নিজেদের মধ্যে আলোচনার পাশাপাশি এর আগে অনুষ্ঠিত সবগুলো নির্বাচনের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচন প্রতিহতের ঘোষণা আমলে নিয়ে তাদের শক্তিও বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। একতরফা নির্বাচন হলে পরবর্তী পরিস্থিতি এবং ওই পরিস্থিতি সামাল দেয়ার কৌশল নিয়েও বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। কেউ বলছেন, নির্বাচন ঠেকানোর ক্ষমতা বিএনপির নেই। আবার কারও মতে, কোন ঘটনা কোন দিকে মোড় নেয় বলা যায় না। বিশেষ করে তৃতীয় কোনো পক্ষের ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের বিষয়টিও কেউ কেউ বিবেচনায় রাখতে চাইছেন। তারা বলছেন, জামায়াত ও হেফাজতে ইসলাম সর্বশক্তি নিয়ে মাঠে নামবে। ফলে বিএনপি, জামায়াত ও হেফাজত- এই তিন শক্তিকে মোকাবেলা করতে হবে সরকারকে। তা ছাড়া উদ্ভূত কঠিন সময়ে পুলিশ ও প্রশাসন কতটা চাপ সামলাতে পারবে এবং শেষ পর্যন্ত সরকারের নির্দেশ কতখানি দৃঢ়তার সঙ্গে তারা বাস্তবায়ন করবে- এ সবকিছু বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে। এ ছাড়া শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর অবস্থানের ওপরও অনেক কিছু নির্ভর করছে। শেষ পর্যন্ত তারা কী ভূমিকা নেবে তাও বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। সূত্রমতে, মেয়াদের এই শেষ ভাগে সরকারের নীতি-নির্ধারকরা দফায় দফায় বৈঠক করছেন। প্রয়োজন ও গুরুত্ব অনুযায়ী সম্ভাব্য পরিস্থিতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নিজে ডেকে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করছেন। ঢাকার কূটনীতিকদের তৎপরতার দিকেও নজর রাখা হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের আরেকটি সূত্র জানায়, গত ২৮ সেপ্টেম্বর দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার ধানমণ্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে তার জন্মদিন উপলক্ষে কেক কাটার পর দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম একতরফা নির্বাচন হলে তা কীভাবে গ্রহণযোগ্য করা যায় এ নিয়ে কথা বলেন। তিনি নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, যদি বিএনপি নির্বাচনে না আসে তা হলে ৫১ শতাংশ ভোট পড়ার দিকে গুরুত্ব দিতে হবে, তা হলেই সে নির্বাচন আন্তর্জাতিক মহলে গ্রহণযোগ্যতা পাবে।
সূত্রমতে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিয়ে বড় দুই দলের সংলাপের বিষয়টি অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিল। এমনকি রাষ্ট্রপতির অধীনে অন্তর্বর্তী সরকার প্রশ্নে সম্মত ছিল বিএনপি। কিন্তু তাদের দেয়া নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের শর্তে রাজি নয় সরকার। যে কারণে সব ধরনের উদ্যোগ ভেস্তে যায়। এদিকে আওয়ামী লীগের এক প্রেসিডিয়াম সদস্যের দেয়া বক্তব্য অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর অধীনে ১৬ সদস্যের মন্ত্রিসভা গঠন করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোনো আলোচনাও এখন ক্ষমতাসীন মহলে হচ্ছে না বলে আওয়ামী লীগের উচ্চ পর্যায়ের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে। এ অবস্থায় ক্ষমতাসীন মহলের অনেকেই এখনও আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পক্ষে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বিরোধী দলের নেতা ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সংগ্রাম কমিটি গঠনের নির্দেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মনে করছেন, আর আলোচনার পরিবেশ নেই। আলোচনা করে কোনো ফলও আসবে না। কারণ, এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিক আলোচনার প্রস্তাব দেয়ার পর তারা আলটিমেটাম দিয়েছিল। ওই আলটিমেটাম যেমন পরিকল্পিত ছিল এই সংগ্রাম কমিটি গঠনের ঘোষণাও পরিকল্পিত বলে মনে করে সরকার। তাই সংবিধান অনুযায়ী যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে সব ধরনের প্রস্তুতির পাশাপাশি নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করা, আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা, দেশী-বিদেশী শক্তিকে পাশে রাখা, একতরফা নির্বাচন হলে নির্বাচন-পরবর্তী পরিস্থিতি উত্তরণকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এ সব বিষয়ে দলের নেতাদের মতামত নেয়া এবং করণীয় ঠিক করতে আগামী ১৩ অক্টোবর দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকও ডাকা হয়েছে। ইতিমধ্যে আদর্শিক জোট ১৪ দলের একটি বৈঠক হয়েছে। সে বৈঠকে সার্বিক বিষয় নিয়ে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন শরিকরাও।
সরকারের বিবেচনায় সম্ভাব্য সব পরিস্থিতি
উৎসঃ যুগান্তর