ধর্মীয় মৌলবাদের মতো সাংবিধানিক মৌলবাদও ভয়ানক হতে পারে। বাংলাদেশ বরাবরই সাংবিধানিক মৌলবাদ চর্চা করে আসছে।
স্বাধীনতা-পরবর্তী দেশে ‘সৃষ্ট সাংবিধানিক সংকটের’ প্রতি ইঙ্গিত করে মঙ্গলবার দৈনিক মানবজমিন-এর এক প্রতিবেদনে একজন বিখ্যাত ব্যক্তির উদ্ধৃতি দিয়ে একথা বলা হয়।
আরটিএনএন-এর পাঠকদের জন্য প্রতিবেদনটি হুবহু তুলে দেয়া হলো-
সংবিধান বাংলাদেশকে কোথায় নিয়ে যাবে? সর্বত্র কানাঘুষা কোথায় যাচ্ছি আমরা? ২৫শে অক্টোবরের পর কি হবে? একটা চাপা নিরানন্দ নিয়ে ঈদের ছুটিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। রাস্তাঘাটে উপচেপড়া ভিড়, যানবাহনে ঠাঁই নেই, ঠাঁই নেই বিপণি বিতানে, বিকিকিনিও যথারীতি বাড়ন্ত, কিন্তু তবুও কিছু একটা নেই।
অবস্থাটি যত দূর চোখ যায় পানি আর পানি। কিন্তু একবিন্দু খাবার পানি নেই। সরকারের কাছ থেকে চাকুরেগণ ২০ ভাগ মহার্ঘ ভাতা পাচ্ছেন গরম গরম। প্রায় সর্বত্র এভাবে প্রাপ্তিযোগ আনার চেষ্টা। এরকম একটা অবস্থার মধ্যে খাবি খাচ্ছে বাংলাদেশ।
আন্দোলন ও অনিশ্চয়তা দানা বাঁধলে খবরের কাগজের চেনা শিরোনামগুলো ফিরে আসে। সেগুলো আসছে। সুড়ঙ্গের শেষে আলো, খাদের কিনার, ট্রেনের লাইনচ্যুতি, সামনে অন্ধকার সিঁড়ি আর সেই সঙ্গে শামসুর রাহমানের বিখ্যাত পঙ্তি: অদ্ভুত উটের পিঠে চড়ে চলেছে স্বদেশ।
এবারে অবস্থাটি সংবিধানের পিঠে সওয়ার বাংলাদেশ। ঘোড়সওয়ারি নয়, পুনর্বার সংবিধানসওয়ারি বাংলাদেশ। অতীতে অবাধ নির্বাচন দিতে অস্বীকৃতি জানানো ক্ষমতাসীন দলগুলো সবসময় সংবিধানের দোহাই দিয়েছে।
একজন প্রথিতযশা ভারতীয় সংবিধান বিশারদ ননীভাই পাল্কিওয়ালা (১৯২০-২০০২)। তিনি বাংলাদেশের প্রসিদ্ধ বিচারকদের কাছেও বরেণ্য। জীবনে বহু আলোচিত সাংবিধানিক মামলা করেছেন। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের কেশবানন্দ ভারতীর মতো যেসব বিখ্যাত মামলার ভিত্তিতে বাংলাদেশ ৫ম ও ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার রায় দিয়েছে তার অনেকগুলোরই সফল আইনজীবী ছিলেন ননীভাই। ১৯৭৭ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। ক্ষমতাসীন কংগ্রেসের বিরুদ্ধে তিনি বহু সাংবিধানিক লড়াইয়ে জিতেছেন। পঁচাত্তরের জরুরি অবস্থার পরে ইন্দিরা গান্ধী সরকারের পক্ষে সিদ্ধান্ত দিতে সুপ্রিম কোর্টের একটি বেঞ্চকে তিনি ঠেকিয়েছিলেন।
তার একটি বিখ্যাত উক্তি হচ্ছে: ধর্মীয় মৌলবাদের মতো সাংবিধানিক মৌলবাদও ভয়ানক হতে পারে। বাংলাদেশ বরাবরই সাংবিধানিক মৌলবাদ চর্চা করে আসছে। ১৯৭৩ সালের পরে ২০০৮ সালে বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে আওয়ামী লীগ। তখন তাদেরকে ‘সাংবিধানিক মৌলবাদে’ পেয়ে বসেছিল।
বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক-ও যুক্তি দেন, চতুর্থ সংশোধনী তো সামরিক ফরমানে ঘটেনি। এটা জনগণের সংসদ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পাস করেছে। অবশ্য বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ ৮ম সংশোধনী মামলার রায়ে বলেছিলেন, সংসদে পাস হলেও ওটা ছিল নির্বাচিতদের দ্বারা সংঘটিত একটি বেসামরিক অভ্যুত্থান।
’৭৫-এ সংসদের মেয়াদ দু’ বছর বাড়ানো হয়েছিল। সেটাও ছিল ‘পবিত্র সংবিধান’। ২০০৮ সালের বাংলাদেশে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। দুই-তিন ঘণ্টার মধ্যে একটি সংসদীয় ক্যু ঘটানো হলো। ’৭৫-এর পরেও সাংবিধানিক মৌলবাদ দেখা গেছে। ’৮৬ ও ’৮৮-র ভোট ডাকাতির নির্বাচনগুলোও সংবিধানের অধীনে হয়েছিল।
’৯০তে শাহ মোয়াজ্জেম বলেছিলেন, জিরো পয়েন্টে ক্ষমতা দেয়া যায় না। এরশাদ জিরো পয়েন্টেই ক্ষমতা দিয়েছিলেন। তখনও বলা হয়েছে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের জোর নেই। কিচ্ছুটি করতে পারবে না।
এরপর বেগম খালেদা জিয়া অন্ধকে হাইকোর্ট দেখানোর মতো সংবিধান দেখান। বলেছিলেন, বিশ্বের অন্যান্য গণতন্ত্রে এধরনের ব্যবস্থা নেই। ১৫ই ফেব্রুয়ারির নির্বাচন ছিল প্রহসনের। মানুষ ভোট দিতে যায়নি। তাই বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়া পর্যন্ত ক্ষমতাসীন বিএনপিকে থামানো যায়নি। সবচেয়ে বেশি পেয়েই তবে সবচেয়ে কাবু হয়েছেন তারা। এবারে মাঠে নামানো হচ্ছে তথাকথিত বিএনএফ। এধরনের ভাড়াটে সংগঠন দিয়ে দল ভাঙার চেষ্টা বাংলাদেশে নতুন নয়।
সবশেষ অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহমেদ জাতিকে সংবিধান দেখিয়ে গেছেন। তিনিও ২০০৭ সালের জানুয়ারির মধ্যে ‘পবিত্র সংবিধানের’ দোহাই দিয়ে নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন। রাষ্ট্রপতির বদল ঘটেছে। কিন্তু মনোবাসনার পরিবর্তন নেই। বর্তমান রাষ্ট্রপতি বিএনপির রাষ্ট্রপতির তুলনায় সেরা। কিন্তু তাই বলে সেরার মতো তার তরফে কিছুই মিলবে না। ইয়াজউদ্দিনের কাছে বিরোধী দলের চাওয়ার কিছু ছিল না। আবদুল হামিদ খান তাকে আসলে অতিক্রম করতে পারেননি। কারণ বিরোধী দল তাঁর কাছে কিছুই আশা করে না। তার কোনো পৃথক ভাবমূর্তি নেই।
আগামী ২৫ অক্টোবরের পরে উপকূলে আছড়ে পড়তে পারে সুনামি কি নার্গিস। ওবায়দুল কাদের বলেই দিয়েছেন, আর ২০ কি ২২ দিন আছে সরকারের মেয়াদ। যদিও একথার কোনো আইনি ভিত্তি নেই। তদুপরি এটা এক অর্থে সঠিক। আর বড় কথা হলো, এটা সবাই মেনে নিয়েছেন। দুই প্রধান দল একমত হয়েছে যে, এ মাসেই সরকারের আয়ু ফুরাচ্ছে। পর্যবেক্ষকরা বলেন, যখন এতই অনৈক্য তখন এ-ও কম কিসে। রাজনীতির মেট অফিস বা আবহাওয়া অধিদপ্তর হয়ে উঠবে বঙ্গভবন। কিন্তু কারও নজরে বঙ্গভবন নেই। হয়তো থাকবেও না সহসা।
রোম জ্বলছে আর নিরো’র বাঁশির সুর আরও দীর্ঘ হচ্ছে। সংবিধান অনুযায়ীই নির্বাচন হবে বলে বারংবার ঘোষণা দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, পৃথিবীর অন্যান্য সংসদীয় পদ্ধতির দেশগুলোতে যেভাবে নির্বাচন হয়, বাংলাদেশেও সেভাবে নির্বাচন হবে। সবশেষ গত রোববার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদের মহাসমাবেশেও একই কথা পুনর্ব্যক্ত করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জনগণ ২০০৮ সালে ভোট দিয়ে আমাদের নির্বাচিত করেছে। জনগণের রায় নিয়ে আমরা সংবিধান সংশোধন করেছি। সংবিধান সংশোধনের আগে বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়েছিল। ওই কমিটি ২৭টি বৈঠক করেছে। বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ তাঁদের মতামত দিয়েছেন। এ-সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটিরও মতামত নেয়া হয়েছে।’ কিন্তু তিনি যে তথ্য প্রকাশ করেন না তাহলো বিশেষ কমিটির খসড়া রিপোর্ট। তাতে কিন্তু ত্রয়োদশ সংশোধনী বহাল রাখা হয়েছিল।
শেখ হাসিনা মনে করেন, যেখানেই আওয়ামী লীগ, সেটাই সংবিধান। তাই তিনি বলেন, ‘১৯৭৫ সালের পর একমাত্র ১৯৯৬ সালেই শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর হয়েছে। জনগণের আমানত যাতে খেয়ানত হতে না পারে, সে জন্যই আমরা সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচনের উদ্যোগ নিয়েছি।’ এভাবে শুধু তিনি নন, তার ভক্ত ও অনুরাগীরা ধর্মীয় মৌলবাদীদের শাপান্ত করতে করতে কেমন সাংবিধানিক মৌলবাদী হয়ে উঠছেন।