সরকারের শেষ সময়ে ফাইলপত্র গোছাতে শুরু করেছেন সরকার সমর্থক আমলারা। আখেরও গোছাতে ব্যস্ত কেউ কেউ। আবার কেউ কেউ বোল পাল্টাতে শুরু করেছেন। সমালোচনাও শোনা যাচ্ছে সরকার সমর্থক সুবিধাবাদী কোনো কোনো আমলার মুখে। এদিকে পদ ও পদোন্নতিবঞ্চিত কর্মকর্তারা কাউন্টডাউনে ব্যস্ত। কেউ কেউ বিএনপি নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়ে দিয়েছেন।
সাম্প্রতিক সময়ে ৪ সিটি করপোরেশন নির্বাচন ও বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির নির্বাচনে সরকার সমর্থক প্রার্থীদের ভরাডুবিতে বদলে গেছে প্রশাসনের পরিবেশ। বদলে যাচ্ছে সরকারি আমলাদের আচার-আচরণ। চাঙ্গা হয়ে উঠছেন সরকারবিরোধী হিসেবে পরিচিতি পাওয়া আমলারা। মাঠ পর্যায় থেকে প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয় পর্যন্ত এ অবস্থা বিরাজ করছে।
সচিবালয়ের একটি সূত্র জানায়, ৪ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফলে সরকারের জনপ্রিয়তা হ্রাসের হাওয়া বুঝে মাঠ প্রশাসন থেকে শুরু করে উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারাও নিজেদের অবস্থান পরিবর্তনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন। পদোন্নতি বঞ্চনা, ভালো ও পছন্দের জায়গায় পদায়ন না পাওয়া, বিশেষ করে বছরের পর বছর ওএসডি হয়ে কর্মহীন থাকা, বাধ্যতামূলক অবসরসহ নানা কারণেই প্রশাসনে অসন্তোষ বিরাজ করছে। যদিও বর্তমান সরকার বিভিন্ন ধাপে উপসচিব, যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব পর্যায়ে বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিয়েছে। কিন্তু তাতে বাদ পড়েছেন অনেক যোগ্য কর্মকর্তা।
মহাজোট সরকারের পাঁচ বছরে নিস্পিষ্ট হতে হয়েছে জনপ্রশাসনের বেশিরভাগ কর্মকর্তাকে। তবে দলবাজ কর্মকর্তাদের ছিল পোয়াবারো। একটানা পাঁচ বছর শাস্তিমূলক ওএসডি রাখা যেমন হয়েছে, তেমনি দেড় বছরের মাথায় সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে সচিব পদে পদোন্নতি পাওয়ার মতো তুঘলকি কাণ্ডও ঘটেছে। ব্যাচের সবচেয়ে মেধাবী অফিসারটি পদোন্নতিবঞ্চিত হয়ে যখন উপসচিব হিসেবে কাজ করছেন, তখন তার দলবাজ বন্ধুটি অতিরিক্ত সচিব হিসেবে ক্ষমতা এনজয় করছেন। এভাবে একচক্ষু প্রশাসনের কারণে হতাশা ও স্থবিরতা বিরাজ করছে জনপ্রশাসনে।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে দলীয়করণমুক্ত, অরাজনৈতিক ও গণমুখী প্রশাসন প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করে বলা হয়েছিল—যোগ্যতা, জ্যেষ্ঠতা এবং মেধার ভিত্তিতে সব নিয়োগ ও পদোন্নতি নিশ্চিত করা হবে। গত চার বছরে এসব প্রতিশ্রুতির কোনোটিই রক্ষা করা হয়নি। বরং জনপ্রশাসনের দলীয়করণ ও পদোন্নতিবঞ্চনা অতীতের সব রেকর্ড ছেড়ে গেছে।
সরকারের পাঁচ বছরের আলোচিত ছিল প্রশাসনের গতি বাড়াতে সরকারের ঊর্ধ্বতনদের দফায় দফায় তাগাদা, সিনিয়র সচিবের পদ সৃষ্টি, রেকর্ড পদোন্নতি ও সুপারসিডবঞ্চনা, নিয়োগ নিয়ে হাঙ্গামা, কর্মকর্তাদের নতুন সংগঠন, সিভিল সার্ভিস আইন বাতিল, সাবেক ৫০ আমলাকে সচিবালয়ে নিষিদ্ধ, ওএসডি ন্যস্ত’র নামে বেতন বন্ধ করে দেয়া এবং মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে পুলিশ ও জনপ্রতিনিধিদের প্রকাশ্য দ্বন্দ্বের ঘটনা। এর মধ্যে ২০১০ সালে পাবনায় নিয়োগ নিয়ে হাঙ্গামার ঘটনা সারাদেশে আলোড়ন তোলে। এছাড়া আমলাদের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর স্বাক্ষর জাল হচ্ছে সংক্রান্ত প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তথ্য অনেকটা নতুন আলোচনার জন্ম দেয়। একই বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের এক রায় পুরো প্রশাসনকে নাড়িয়ে দেয়। ওইদিনের রায়ে বলা হয়, বর্তমান ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স অবৈধ, বেআইনি ও বাতিল করা হলো। তিন বাহিনীর প্রধান ও সচিবদের ওপরে জেলা জজদের পদমর্যাদা দিতে হবে। এ রায় নিয়ে ওই সময় প্রশাসনে বিভিন্ন ধরনের আলোচনার জন্ম হয়। পরে অবশ্য সরকারপক্ষ আপিল করলে রায়ের ওপর স্থগিতাদেশ দেয়া হয়েছে। একই বছরের ১ এপ্রিল নিজের নিরাপত্তা চেয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারকে চিঠি দেন বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান ড. সা’দত হুসাইন। দেশের ইতিহাসে এ প্রথম সাংবিধানিক পদে অধিষ্ঠিত কোনো ব্যক্তি নিজের নিরাপত্তা বাড়াতে চিঠি দেন।
স্থবির, হতাশা আর ক্ষোভ : স্থবির, হতাশা আর ক্ষোভের মধ্য দিয়েই পাঁচটি বছর পার করছেন জনপ্রশাসনের কর্মকর্তারা। বর্তমান সরকারের সময়ে রেকর্ডসংখ্যক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়া হলেও গতি আসেনি মাঠ প্রশাসনে। জ্যেষ্ঠতা, যোগ্যতা, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও সততা বিবেচনায় না নিয়ে কেবল দলীয় বিবেচনায় পদোন্নতি এবং পদায়ন করায় এমন স্থবিরতা দেখা দেয় বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়।
২৪ বছরের সিনিয়র-জুনিয়র একই পদে : সরকারের একচোখা নীতির কারণে জনপ্রশাসনে পদোন্নতি বন্ধ্যত্ব কাটছে না। শুধু সিনিয়র সহকারী সচিব পদে কাজ করছেন ১৬টি ব্যাচের কর্মকর্তারা। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, ২৪ বছরের সিনিয়র ও জুনিয়র কর্মকর্তারা একই পদে কাজ করছেন। একই ব্যাচের কোনো কোনো কর্মকর্তা যখন সচিব হিসেবে ক্ষমতা এনজয় করছেন, তখন সিনিয়র সহকারী সচিব পদে কাজ করছেন ওই ব্যাচেরই অনেকে। দলীয় কালার না থাকায় এসব কর্মকর্তা বার বার পদোন্নতিবঞ্চিত হন বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে। সিভিল সার্ভিসের ইতিহাসে বাংলাদেশ ছাড়া আর কোথাও এমন নজির নেই।
উপসচিব পদেও একইভাবে ৯টি ব্যাচের ১ হাজার ৫৪০ কর্মকর্তা কর্মরত রয়েছেন। চাকরি জীবনের ১২ বছরের জুনিয়র ও সিনিয়র কর্মকর্তাকে একই পদে কাজ করতে হচ্ছে। ফলে প্রশাসনজুড়ে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। কাজের ক্ষেত্রে চেইন অব কমান্ড থাকছে না। বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। সময়মত পদোন্নতি দিতে না পারা এবং পদোন্নতির ক্ষেত্রে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত সুস্থ ধারা না থাকায় এ অবস্থা তৈরি হয়েছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সিনিয়র সহকারী সচিব পদে ২০০৬ সালের ২৫তম বিসিএস কর্মকর্তারা যেমন রয়েছেন, তেমনি আছেন ২৪ বছর আগের ’৮২ ব্যাচের কর্মকর্তারা। ’৮২ ব্যাচের ৯ জন, ’৮৪ ব্যাচের ১১, ’৮৫ ব্যাচের ১৭, ’৮৬ ব্যাচের ৪০, ’৯১ (জানুয়ারি) ব্যাচের ৪৮, ’৯১ (ডিসেম্বর) ব্যাচের ৫৩, ১১তম ব্যাচের ৬৮, ১৩তম ব্যাচের ১১০, ১৫তম ব্যাচের ১০৮, ১৭তম ব্যাচের ৬৩, ১৮তম ব্যাচের ৯১, ২০তম ব্যাচের ২৭৪, ২১তম ব্যাচের ১৭০, ২২তম ব্যাচের ২৬৮, ২৪তম ব্যাচের ২৯১ এবং সম্প্রতি পদোন্নতি পাওয়া ২৫তম ব্যাচের ৭৫ কর্মকর্তা একই পদে কাজ করছেন।
উপসচিব পদে ’৮২ ব্যাচের পাশাপাশি ১২ বছরের জুনিয়র ১৯৯৪ সালের ১৩তম ব্যাচের কর্মকর্তারা কাজ করছেন। এদের মধ্যে ’৮২ ব্যাচের ৩৩, ’৮৪ ব্যাচের ১৯৬, ’৮৫ ব্যাচের ৫০৯, ’৮৬ সালের ২০৬, ৯১ (জানুয়ারি) ব্যাচের ৮১, ’৯১ (ডিসেম্বর) ব্যাচের ১৪৫, ১১তম ব্যাচের ১৫০ এবং ১৩তম ব্যাচের ১৪ কর্মকর্তা রয়েছেন। যুগ্ম সচিব পদে কাজ করছেন ’৮২ (রেগুলার), ’৮২ (স্পেশাল) ও ’৮৪ ব্যাচের কর্মকর্তারা।
এদিকে প্রশাসনে ৯টি ব্যাচের ১ হাজার ৫৪০ কর্মকর্তা উপসচিব। উপসচিবের ৮৩০টি পদের বিপরীতে এখন অতিরিক্ত কর্মকর্তার সংখ্যা ৭১০ জন। এটিও প্রশাসনের ইতিহাসে একটি নজিরবিহীন রেকর্ড। পদের তুলনায় এত বেশিসংখ্যক কর্মকর্তা এর আগে কখনও দেখা যায়নি। বড় বড় ব্যাচের চাপ সামাল দেয়াসহ রাজনৈতিক পছন্দ ও অপছন্দকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে গত কয়েক বছরে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে পদের বাইরে বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। অর্থাত্ পদ নেই, তবুও পদোন্নতি দিতে হয়েছে। এসব অতিরিক্ত কর্মকর্তার চাপ সামাল দিতে গিয়ে ২০০৬ সাল থেকে প্রশাসনে উপসচিবের সুপারনিউমারি পদ সৃষ্টি করা হয়। মোট ৪৫০ উপসচিবের পদকে সুপারনিউমারি দেখিয়ে বছর বছর সংরক্ষণ করে বেতন-ভাতা দেয়া হচ্ছে। যারা সিনিয়র সহকারী সচিবের চেয়ারে (পূর্বপদ) বসেই কাজ করছেন।







