সরকার পরিচালিত সয়েল রিসোর্সেস ডেভলপমেন্ট ইনস্টিটিউটের পরীক্ষায় দেখা গেছে, স্থানীয় এবং আমদানিকৃত উভয় সারে ৪০ ভাগ ভেজাল রয়েছে। ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা একটি ইংরেজি দৈনিককে জানিয়েছেন, নিজেদের উদ্যোগে তারা কোন নমুনা সংগ্রহ করেননি। তবে কৃষি সম্প্রসারণ, থানা-জেলা প্রশাসন, পুলিশ বিভাগ, শুল্ক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, স্থানীয় সার উৎপাদক এবং আমদানিকারকরা যে নমুনা তাদের দিয়েছে, তার ভিত্তিতেই তারা ভেজাল শনাক্ত করেছেন। বাংলাদেশ কৃষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মনে করেন, ভেজাল সারের অধিকাংশই ভারত থেকে পাচার হয়ে আসছে এবং চীন থেকে আমদানি করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞ ও কৃষকরা বাজারে ভেজাল সারের সরবরাহে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশ পাট উৎপাদক সমিতির সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, দেশের অধিকাংশ কৃষকই অক্ষরজ্ঞানহীন। তারা বাজার থেকে সার নিয়ে থাকে। হঠাৎ করেই তারা দেখতে পায় সার ঠিক মত কাজ করছে না। ভূমি ও কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ভেজাল সার কৃষি জমির উর্বরতা কমে যাওয়ার পাশাপাশি পরিবেশ এবং শস্যের জন্য ক্ষতিকর, মানবদেহের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। কৃষি কর্মকর্তা এবং সার ডিলাররা জানিয়েছেন, উৎপাদক, অসৎ আমদানিকারক এবং ডিলারসহ সংশ্লিষ্টদের সংঘবদ্ধ চক্র সার ভেজাল প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত। এর বাইরেও কোন কোন ডিলার অধিক মুনাফার আশায় নিম্মমানের সার মানসম্মত সারের সাথে মিশ্রণ করে বিক্রি করছে। বাংলাদেশ পাট উৎপাদক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মনে করেন, মোবাইল কোর্ট অপারেশন ভেজাল প্রক্রিয়া বন্ধে সহায়তা করতে পারে। সামগ্রিক বিবেচনায় ঘটনার ব্যাপ্তি বিচারে বলা যায়, যথাযথ কর্তৃপক্ষের তদারকির অভাব অথবা অবৈধ অর্থের লেনদেনের কারণেই এমন হয়ে থাকতে পারে।
আধুনিক কৃষিতে রাসায়নিক সারের ব্যবহার নিয়ে নানা প্রাসঙ্গিক আলোচনা এমনিতেই রয়েছে। মানসম্মত রাসায়নিক সারের ব্যবহারেও কার্যত ভূমি উর্বরতা হারায়। পরিবেশের উপর বিরূপ পার্র্শ্বপ্রতিক্রিয়া পড়ে এবং সেই সাথে মাছ উৎপাদনেও নেতিবাচকতা পরিলক্ষিত হয়। সেই সাথে কীটনাশকের ব্যবহার নিয়েও নানা নেতিবাচক প্রভাবের কথা বলা হচ্ছে। কৃষি প্রধান দেশগুলোতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার বন্ধ অথবা কমিয়ে এনে জৈব সারের ব্যবহার এবং পোকামাকড় দমনে প্রাকৃতীক কৌশল অবলম্বনের পক্ষে সুপারিশ করা হচ্ছে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও স্বাস্থ্যঝুঁকি কমিয়ে আনার মূল উদ্যোগের বিপরীতে বাংলাদেশে সারে ভেজাল নিয়ে যা ঘটছে তা রীতিমত উদ্বেগজনক। একে একমাত্রিকতায় দেখার কোন সুযোগ নেই। পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে, ২০১৩-১৪ অর্থ বছরে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে ইউরিয়া সারের প্রয়োজন হবে ২৪.৫ লাখ টন। সে ক্ষেত্রে সরকারি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৭.৫ লাখ টন। প্রায় ১৭ লাখ টন ইউরিয়া আমদানি করতে হবে। এর বাইরেও অভ্যন্তরীণ ব্যবহারের জন্য প্রায় ৬.৫ লাখ টন ডিএপি এবং ৮ লাখ টন এমওপি ও ৬.৭৫ লাখ টন টিএসপির প্রয়োজন হবে। ইউরিয়া ব্যতিরেকে বাকি সকল সারই আমদানি করতে হবে। উদ্বেগজনক বিষয় হচ্ছে, অধিকাংশ ভেজাল সারই বাংলাদেশে উৎপাদন হয় বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। সার আমদানিকারক সমিতির সভাপতি বলেছেন, আমরা জানি না নিম্মমানের ডিএপি, টিএসপি এবং অন্যান্য সার চীন, অস্ট্রেলিয়া, তিউনেসিয়া, মরোক্কো বা অন্য কোন জায়গা থেকে আমদানি করা হয় কি না। সঙ্গতভাবেই সামগ্রিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে কৃষি বিভাগ তথা কৃষি মন্ত্রণালয়ের তদারকির অনুপস্থিতির বিষয়টি বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে। কারণ কৃষক পর্যায় কৃষির দেখভাল করার দায়িত্ব তাদের উপরই বর্তায়। অন্যদিকে বাংলাদেশে যে সার উৎপাদিত হয় সেখানে কিভাবে মারাÍক ভেজাল ঢুকছে সেই প্রশ্নের পাশাপাশি ভেজাল সার কিভাবে আমদানি হয়ে কৃষক পর্যন্ত পৌঁছতে পারছে সে প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। সীমান্ত দিয়ে নিম্মমানের ভেজাল সার দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারার ক্ষেত্রে সীমান্ত রক্ষায় যারা দায়িত্বে রয়েছেন তাদের দায়মুক্ত হবার কোন সুযোগ নেই। উল্লেখ করা প্রয়োজন, এই অভিযোগ নতুন নয়। গত বছরও নিম্মমানের এমনকি বিক্রি নিষিদ্ধ সার ভালমানের সার নামঙ্কিত বস্তায় ভরে বেশি দামে বিক্রি করা হয়েছে। কিন্তু তারপরেও পরিস্থিতির কিভাবে পূণরাবৃত্তি হতে পেরেছে সেটা অবশ্যই খতিয়ে দেখা দরকার।
এবারের রিপোর্টেও ভেজাল অব্যাহত থাকার কথা স্বীকার করা হয়েছে। ২০১২ সালে নমুনা পরীক্ষা করে দেখা গেছে, বাজারে বিক্রি হওয়া ৪২ থেকে ৫০ শতাংশ সারে ভেজাল রয়েছে। ২০১১ সালের পরীক্ষায় ৪০ শতাংশ ভেজাল পাওয়া গিয়েছিল। আমাদের অর্থনীতির প্রাণ কৃষি। সেই কৃষিতে সারের ব্যবহারে গুরুতর যে অভিযোগ উঠেছে তার ফলে শুধু কৃষক এবং ভূমি নয় বরং গোটা দেশের অর্থনীতি ঝুঁকির মধ্যে পড়ার আশঙ্কায় রয়েছে। দেশের অন্যান্য ক্ষেত্রের মত এ খাতও যে উদাসীনতা এবং অবহেলার শিকার তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ক্ষমতা প্রলম্বিত করা অথবা টিকে থাকার জন্য সরকার যেভাবে আইনশৃ´খলা বাহিনীর দেখভাল করাকে অধিকতর ও গুরুত্বের বিবেচনায় নিয়ে থাকেন তার বিপরীতে অর্থনীতির জন্য অতীব প্রয়োজনীয় সারের ভেজাল রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া গেলে সেটাই হত জনগণের প্রকৃত কল্যাণ চিন্তা। ভেজাল সার যাতে কৃষক পর্যন্ত পৌঁছতে না পারে তার সর্বাÍক ব্যবস্থা গ্রহণ সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।






