মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতের সহকারী সেক্রেটরি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর অক্টোবর পর্যন্ত ফাঁসি কার্যকর করা ঠেকাতে তৎপর জামায়াত।
এজন্য জোটের প্রধান শরিক বিএনপি নেতাদের দিয়ে সংবাদ সম্মেলন, বিদেশি পত্রিকায় রায়কে বির্তকিত করানোর চেষ্টা চালাচ্ছে দলটি। পাশাপাশি সরকারের সঙ্গে জোর লিয়াজোঁও চালিয়ে যাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র বিরোধিতাকারী ধর্মভিত্তিক এই দলটির একটি টিম।
জামায়াতের একটি সূত্র এই তথ্য জানিয়েছে।
দলটি মনে করে, ২৪ অক্টোবরের পর শেখ হাসিনার সরকারের সাংবিধানিক ক্ষমতা শেষ হচ্ছে। এর মধ্যে যদি রায় বাস্তবায়ন করতে না পারে, তবে পরবর্তী সরকার রায় বাস্তবায়ন করার সাহস দেখাবে না।
দলটি আরও মনে করছে, অক্টোবরের পরে তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে বিএনপিসহ ১৮ দল মাঠে গরম আন্দোলনে থাকবে। এছাড়া আওয়ামী লীগ তখন নির্বাচনমুখী থাকবে। সুতরাং যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে জামায়াত মাঠে নামুক সেটা সরকার চাইবে না।
সরকারকে আরও চাপ দিতে গত বৃহস্পতিবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ এমপি সংবাদ সম্মেলনে রিভিউ আবেদনের নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত রায় কার্যকর না করার জন্য দাবি জানান। জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের ব্যানারে ওই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হলেও এর নেপথ্যে জামায়াতই ছিল, একথাও নিশ্চিত করে জানিয়েছে ওই সূত্র।
যদিও সুপ্রিম কোর্টের রায় প্রকাশের পর কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি সাবেক এই আইনমন্ত্রী।
এছাড়াও ব্রিটেনের প্রভাবশালী পত্রিকা টেলিগ্রাফ, ইকোনমিস্ট, যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও ব্রিটেনের মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালকে দিয়ে রায় নিয়ে নেতিবাচক প্রতিবেদন প্রকাশ করানোর জন্য তৎপর জামায়াত। পাশাপাশি ফাঁসি কার্যকর না করতে সরকারের সঙ্গে জোরালো লিয়াজোঁ চালাচ্ছে জামায়াতের দেশি-বিদেশি একটি টিম।
জানা গেছে, সুপ্রিম কোর্টে আগামী ১০ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত অবকাশে থাকবে। পূর্ণাঙ্গ রায় যদি অবকাশের আগে প্রকাশিত হয়, তাহলেও এর আগে রিভিউ আবেদনের শুনানি হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
কারণ, পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের ৩০ দিনের মধ্যে রিভিউ আবেদন করতে পারবেন বলে দাবি জামায়াতের আইনজীবীদের।
তবে রাষ্ট্রপক্ষ বলছেন, রিভিউ আবেদন করার কোনো সুযোগ নেই। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হলে তা কার্যকর করা হবে।
এদিকে সুপ্রিম কোর্টের অবকাশের আগেও যদি রায় প্রকাশিত হয়, তারপরও অবকাশকালীন ২৩ দিন সময় ৩০ দিনের গণনা থেকে বাদ যাবে বলে দাবি করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার বেলায়েত হোসেন।
তিনি বলেন, রায় প্রকাশের পর যদি কোনো বন্ধ/অবকাশ থাকে তাহলে সে সময়টা গণনা থেকে বাদ যাবে।
এ বিষয়ে জামায়াতের একাধিক নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে আইনি এই বিষয় নিয়ে কেউ মন্তব্য করতে রাজি হননি।
আর কাদের মোল্লার প্রধান আইনজীবী ও জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকের মোবাইলে একাধিকবার কল দিলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।
সংবিধানের ১০৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সংসদের যেকোনো আইনের বিধি-বিধানাবলী সাপেক্ষে এবং আপিল বিভাগ কর্তৃক প্রণীত যেকোনো বিধি সাপেক্ষে আপিল বিভাগের কোনো ঘোষিত রায় বা প্রদত্ত আদেশ পুনর্বিবেচনার ক্ষমতা উক্ত বিভাগের থাকিবে’।
যদিও এই রিভিউ আবেদন নিয়ে ইতোমধ্যে দ্বিমত পোষণ করেছেন আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ ও অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট মাহবুবে আলম।
তারা বলেন, সংবিধান সংশোধন করে এই আইন করা হয়েছে। এটি একটি বিশেষ আইন। তাই রিভিউয়ের কোনো সুযোগ নেই।
অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক, অপরাধ আইন বিশেষজ্ঞ অ্যাডভোকেট আনিসুল হক, বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেনসহ বিএনপি ও জামায়াতপন্থী কয়েকজন আইনজীবী বলেছেন, সংবিধানের ১০৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আসামির রিভিউ আবেদন দায়েরের অধিকার রয়েছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজও একই মত প্রকাশ করেছেন।
তাদের মতে, কাদের মোল্লাকে এই সাংবিধানিক অধিকার দেওয়া হলে এই রায়ের স্বচ্ছতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন উত্থাপিত হবে না। তবে তার রিভিউ পিটিশন গ্রহণ করা বা না করার সম্পূর্ণ এখতিয়ার আপিল বিভাগের রয়েছে।
যে আইনে মানবতাবিরোধীদের বিচার হচ্ছে সেই আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন’১৯৭৩ এর ২০(৩) ধারায় বলা আছে, ‘এই আইনের অধীন প্রদত্ত দণ্ড কার্যকর হইবে সরকারের আদেশাবলী অনুযায়ী’।
অর্থাৎ রাষ্ট্রপতি প্রাণভিক্ষার আবেদন যেদিনই নাকচ করবেন সেদিন থেকে যে কোনো দিন মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা যাবে।
সুতারাং, সরকার ইচ্ছা করলেই এই রায় কার্যকর করতে কিংবা তা আটকে রাখতে পারে। ওই আইনে ফাঁসি কার্যকর করার সময়সীমা নির্দিষ্ট করে দেওয়া নেই।
তাই কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর না করতে সব চেষ্টা-তদ্বির চালাচ্ছে স্বাধীনতাযুদ্ধের সশস্ত্র বিরোধিতাধী দল জামায়াত। এরই অংশ হিসেবে সরকারের শীর্ষমহলের কয়েকজনের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগও রাখছেন দলটি কয়েকজন নেতা।
জামায়াত মনে করছে, সরকার পরিবর্তিত হলে রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে ক্ষমা করিয়ে কাদের মোল্লাকে ছাড়িয়ে আনা যাবে।
এজন্য রিভিউ আবেদন নামঞ্জুর কিংবা খারিজ হওয়ার পর রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাওয়া থেকে বিরত থাকবেন কাদের মোল্লা। যাতে করে আগামীতে সরকার পরিবর্তন হলে রাষ্ট্রপতির এই অপশনটি ব্যবহার করা যায়।
এদিকে ১৭ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ড দিলেও ২৮ সেপ্টেম্বর শনিবার পর্যন্ত আপিল বিভাগের দেওয়া ফাঁসির পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়নি। রায় প্রকাশের পর রিভিউ আবেদন দায়ের করবেন দণ্ডিত পক্ষ।
অন্যদিকে অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট মাহবুবে আলম এখন পর্যন্ত বলে যাচ্ছেন, যুদ্ধাপরাধের দায়ে দণ্ডপ্রাপ্তদের রিভিউ আবেদন দাখিলের কোনো সুযোগ নেই।