মানুষের ঢল নেমেছে এশিয়ার সর্ববৃহৎ শপিংমল যমুনা ফিউচার পার্কে। রাজধানী ও আশপাশের এলাকা থেকে ছুটে আসা অজস্র মানুষের এ আগমন রাত পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। উদ্বোধনের পর দ্বিতীয় দিন শনিবার সকাল থেকেই নানা বয়সী মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে লেভেল ফাইভের বিভিন্ন আয়োজনে। শিশুদের ফিউচার ওয়ার্ল্ডের প্রতিই ছিল বেশি আগ্রহ। ফুড কোর্টগুলোও জমজমাট হতে থাকে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই। দুপুর পৌনে ১২টা থেকেই ব্লকবাস্টার সিনেমাসের হলগুলোতে শুরু হয় চলচ্চিত্র প্রদর্শনী। ইমপ্রেস টেলিফিল্মের ছবি মৃত্তিকা মায়া ও অনন্ত জলিলের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা-দুটি ছবির প্রতিই দর্শকদের আগ্রহ ছিল বেশি। তাছাড়া অবলিভিয়ন, ডিসপিকেবল মি-২ থ্রিডি, ফাস্ট অ্যান্ড ফিউরিয়াস-৬, পার্সি জ্যাকশন : সি অব মনস্টার্স থ্রিডি ও জুরাসিক পার্ক থ্রিডি সিনেমাগুলোর প্রতিও ছিল তরুণ-তরুণীদের বিশেষ ঝোঁক। ভোগ লাইফ স্টাইল লাউঞ্জেও সৌন্দর্য ও ফ্যাশন সচেতন নারী-পুরুষরা কৌতূহল নিয়ে ঢুকেছেন।
বিকালে প্রচণ্ড ভিড় হয় আউটডোর রাইডসগুলোতে। প্রতিটি আয়োজনের টিকিট কাউন্টারেই ছিল উৎসাহী মানুষের দীর্ঘ সারি। বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম শপিং মলের নির্মাণশৈলী ও আলোকবিন্যাসসহ সার্বিক ব্যবস্থাপনা দেখে অভিভূত হন দর্শকরা। অন্যদিকে শনিবার ফিউচার পার্কে আসা যানবাহনের জন্য সুশৃংখল পার্কিং ব্যবস্থার কারণে মানুষের চলাফেরা ছিল স্বাভাবিক ও স্বাচ্ছন্দ্যময়।
দুপুরে লেভেল ফাইভে আলাপকালে রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী সোবহান আলী যুগান্তরকে বলেন, উদ্বোধনের দিন শুক্রবারও ফিউচার পার্ক দেখতে এসেছিলাম। কিন্তু মানুষের ভিড়ের কারণে ভালোভাবে দেখা হয়নি। আজ (শনিবার) সময় নিয়ে দেখলাম। ভবনটি যতই দেখছি, ততই বিস্মিত হচ্ছি। বাংলাদেশে এমন ভবন হতে পারে, তা না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। তিনি বলেন, একটি ফ্লোরের উদ্বোধনেই ফিউচার পার্কে মানুষের যে ঢল দেখা যাচ্ছে, পুরে শপিংমল চালু হলে রীতিমতো হুলুস্থূল পড়ে যাবে। তখন সকালে এসে খাওয়া-দাওয়া ও কেনাকাটা করে রাতে বাড়ি ফিরতে পারবেন অনেকেই। কারণ সারাদিন কেনাকাটা, বিনোদন, শরীর চর্চা, বিশ্রাম, খাওয়া-দাওয়াসহ আনন্দময় সময় কাটানোর সব ধরনের ব্যবস্থাই একই ছাদের নিচে থাকায় এখানে কেউ নিরানন্দ বোধ করবেন না।
ফুড কোর্টের দোকানগুলোতে একটু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পড়ে যায় খাওয়ার ধুম। উদ্বোধনের দ্বিতীয় দিনেই ব্যবসার এ অবস্থা দেখে ভবিষ্যতের উজ্জ্বল সম্ভাবনায় দারুণভাবে আশান্বিত হন ব্যবসায়ীরা। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেল, কোনো দোকানেই আসন খালি নেই। ব্যবসায়ীরা ব্যস্ত ক্রেতা সামলাতে। এমন অবস্থায় কথা হল এ ব্লকের ‘আয়রন শেফ’ দোকান মালিক জাহিদের সঙ্গে। তিনি বলেন, লেভেল ফাইভে প্রচুর লোকজন আসছে। ক্রেতাও পাচ্ছি ভালো। ভবিষ্যতে এখানকার ব্যবসা আরও ভালো হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
‘দি বিরিয়ানি ক্যাসেলের’ মালিক মোঃ আলী বাবু জানান, শুক্রবার উদ্বোধনের দিন যে ক্রেতা তিনি পেয়েছিলেন, শনিবার দ্বিতীয় দিনে পেয়েছেন তার চাইতেও বেশি। ফুড কোর্ট ক্যাশ টোকেন কাউন্টারের এক্সিকিউটিভ ইনভিজিলেটর মনির হোসেন বলেন, সকাল থেকেই প্রচুর লোক লেভেল ফাইভে আসছে। খাবারের দোকানগুলোতে প্রচুর বিক্রিও হচ্ছে। আমরা কাস্টমারদের নিয়ে প্রচণ্ড ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে সময় পার করছি।
লেভেল ফাইভের বি ব্লকে ‘স্পোর্টস ওয়ার্ল্ড’ নামের দোকানটি খেলার ও শরীর চর্চার সামগ্রী দিয়ে সাজানো। বিকালে প্রচুর লোকজনকে দোকানের ভেতর বিভিন্ন পণ্য পরখ করতে দেখা যায়। আলাপকালে ম্যানেজার আব্বাস বলেন, বিশ্বের নামকরা ব্র্যান্ডের স্পোর্টস ও জিম সামগ্রী এ দোকানে রাখা হয়েছে। প্রতিটি পণ্যই গুণগত মানসম্পন্ন। পৃথিবীর নামকরা প্রতিটি ব্র্যান্ডের পণ্য এ দোকানে সুলভে পাওয়া যাচ্ছে। ফিউচার পার্কের ব্যবস্থাপনা ও দর্শক আগমনে ব্যবসা প্রসারে আশাবাদী তিনি।
লেভেল ফাইভের আরেক আকর্ষণ ফিউচার ওয়ার্ল্ড। গত দু’দিনেই শিশুদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে ফিউচার ওয়ার্ল্ড। শনিবার দিনভর বিপুলসংখ্যক নারী, পুরুষ ও শিশুকে এখানে প্রবেশ করতে দেখা যায়। বিশেষ করে শিশুরা ইনডোর রাইডগুলোতে চড়ে আনন্দ উপভোগ করেছে প্রাণভরে। কর্মকর্তারা জানান, ফিউচার ওয়ার্ল্ডে জনপ্রতি প্রবেশ ফি ৫০ টাকা। যাদের উচ্চতা তিন ফুটের নিচে তাদের প্রবেশ ফ্রি। ভেতরে রয়েছে দশটি ইভেন্ট। প্রতি ইভেন্টের জন্য লাগে ২০০ টাকা।
প্রগতি সরণি থেকে ফিউচার পার্ক প্রাঙ্গণে প্রবেশ করলে প্রথমেই পড়ে আউটডোর রাইডস। সারা পৃথিবীতে তোলপাড় করা ছয়টি রোমাঞ্চকর রাইড রয়েছে এখানে। বর্ণিল আলোকচ্ছটায় উদ্ভাসিত ফিউচার পার্কের এই আউটডোর রাইডসের রোলার কোস্টার, স্কাইড্রপ, ম্যাজিক উইন্ডমিল, পাইরেট শিপ, ফ্লাইং ডিসকো ও টাওয়ার চ্যালেঞ্জার রীতিমতো শিহরণ জাগানিয়া। বিকাল থেকে এ রাইডগুলোতে ছিল হাজারও মানুষের ভিড় ও উৎসুক দৃষ্টি। দীর্ঘ লাইন পড়ে যায় টিকিট কউন্টারে।
তরুণদের সাহসিকতা প্রদর্শনের একটি বিশেষ উপলক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে যমুনা ফিউচার পার্কের আউটডোর রাইডগুলো। শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণী সবার মধ্যে এ রাইডগুলো জনপ্রিয় হয়ে ওঠতে শুরু করেছে। আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের বিবিএ তৃতীয় সেমিস্টারের ৬ জন শিক্ষার্থী শনিবার সন্ধ্যায় দেশের একমাত্র ৩৬০ ডিগ্রি ঘূর্ণন বিশিষ্ট রোলার কোস্টারটিতে চড়েন। দ্রুতগতির ও রোমাঞ্চকর এ রাইডটি উপভোগের পর যুগান্তরের পক্ষ থেকে তাদের অনুভূতি জানতে চাওয়া হয়। তারা জানান, আমরা সবগুলো রাইডে ওঠার পরিকল্পনা করেছি। শেষ পর্যন্ত যার অবস্থা সবচেয়ে স্বাভাবিক থাকবে তাকে নিজেদের মধ্যে সবচেয়ে সাহসী খেতাব দেয়া হবে। আউটডোর রাইডগুলোর প্রতিটিই এমন দুঃসাহসিক চ্যালেঞ্জের উত্তেজনায় ভরপুর। শনিবার ফিউচার পার্কের দর্শনার্থীদের অনেকেই বলেছেন, স্কাইড্রপের ৮০ ফুট উঁচু থেকে হঠাৎ ঝরে পড়া কিংবা টাওয়ার চ্যালেঞ্জারের মাটি থেকে ১২০ ফুট উঁচু নাগরদোলায় চেপে তীরবেগে লাটিমের মতো ঘোরার অনুভূতি নিতে হলে কিছুটা সাহস আসলেই জরুরি।
শনিবার সকাল থেকেই হাজার হাজার মানুষের আগমনে গোটা ফিউচার পার্ক মুখরিত হয়ে ওঠে। মানুষের এই ভিড় আরও ব্যাপক হয়ে ওঠে বিকালে আউটডোর রাইড চালু হওয়ার পরে। উৎসাহী মানুষের কেউ কেউ যেমন প্রতিটি রাইডে চড়ে উত্তেজনাকর সময় পার করেছেন, তেমনি অনেকেই আবার কাছ থেকে এই রোমাঞ্চকর দৃশ্য দেখে মজা পেয়েছেন। রাত ৯টা দিকে ফিউচার পার্কের প্রবেশ পথ বন্ধ করে দেয়া হলেও প্রচুর মানুষ তখনও ভেতরে ঢোকার জন্য প্রবল আগ্রহ নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। প্রগতি সরণি দিয়ে চলাচলকারী প্রতিটি যানবাহনের যাত্রীদের মধ্যেও ছিল ভেতরের বিপুল এই কর্মযজ্ঞ সম্পর্কে প্রচণ্ড আগ্রহ। তাছাড়া ফিউচার পার্কের আশপাশের প্রতিটি সুউচ্চ ভবনের ছাদেও দিনভর ছিল উৎসাহী মানুষের উঁকিঝুঁকি।
সুষ্ঠু পার্কিং ব্যবস্থা : যমুনা ফিউচার পার্কের লেভেল ফাইভে অসংখ্য যানবাহনের আগমন ঘটলেও এখানে পার্কিং ব্যবস্থা ছিল নজিরবিহীন। ফিউচার পার্কের আন্ডারগ্রাউন্ড পার্কিং খুলে দেয়া হয়েছে। এসব গাড়ি রাখা হয় সুশৃংখলভাবে। অন্যদিকে কুড়িল ফ্লাইওভার হয়ে বাড্ডা-রামপুরামুখী গাড়ি সোজা দক্ষিণ দিকে চলে যায়। এগুলোর মধ্যে যেসব গাড়ি যমুনা ফিউচার পার্কে যেতে চেয়েছে সেগুলো টয়োটা শোরুম লাগোয়ো বামে মোড় নিয়ে ফিউচার পার্কে ঢুকে পড়ে। ফিউচার পার্কের সামনের খালি জায়গায় কোনো গাড়ি দাঁড়াতে দেয়া হয়নি। ট্রাফিক পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেছেন, শনিবারের পরিস্থিতি অনেক ভালো। তবে বসুন্ধরা মোড়ের কারণে যানজট পরিস্থিতি সেই আগের মতোই রয়েছে।
শনিবার সন্ধ্যায় যমুনা ফিউচার পার্কের রাস্তার উল্টো দিকের চায়ের দোকানদাররা জানিয়েছেন, শুক্রবার যে পরিমাণ যানজট সৃষ্টি হয়, শনিবার তার সিকিভাগও হয়নি। এ দোকানদাররা শনিবার সকাল থেকে ফিউচার পার্কে নিয়ম-শৃংখলা মেনে গাড়ি ঢুকতে ও বের হতে দেখেছেন। স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, বসুন্ধরা ক্রসিং বন্ধ করে দেয়া হলে এ রাস্তায় কোনো যানজটই থাকবে না। প্রগতি সরণির দুই পাশেই ব্যাপক চওড়া রাস্তা রয়েছে। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার গাড়ির সংখ্যা যতই হোক, সেগুলো মাত্র ৩ কিলোমিটার দূরের কুড়িল ফ্লাইওভারের ইউটার্নে ঘুরে এলেই এ রাস্তার যানজট দূর হতে বাধ্য।