তিন শ’ আসনে প্রার্থী বাছাই কাজ শুরু করেছে আওয়ামী লীগ

0
146
Print Friendly, PDF & Email

পুরোদমে নির্বাচনের প্রস্তুতিতে শাসক দল আওয়ামী লীগ। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশব্যাপী সাংগঠনিক সফর, নির্বাচনী ইশতেহার প্রণয়ন, নির্বাচন পরিচালনা কমিটি গঠনের পর এবার তিন শ’ আসনে প্রার্থী বাছাইয়ের কাজ শুরু করেছেন দলটির সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
জানা গেছে, তিন শ’ আসনেই দলের সম্ভাব্য প্রার্থীদের তথ্য-উপাত্ত এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে। কয়েকদফা মাঠ জরিপের মাধ্যমে সংগৃহীত গত সাড়ে চার বছরের দল ও মহাজোটের এমপিদের আমলনামাও তাঁর ল্যাপটপে বন্দী। আগামী ৪ সেপ্টেম্বর থেকে জেলা ও তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে সিরিজ বৈঠকের মাধ্যমে প্রার্থিতার ব্যাপারে একান্তে তাদের মতামত গ্রহণ করবেন তিনি। এই সিরিজ বৈঠকে গৃহীত মতামত ও জরিপের তথ্য পর্যালোচনা করেই পার্লামেন্টারি বোর্ডে প্রার্থিতা চূড়ান্ত করার উদ্যোগ নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। দলের সব মন্ত্রী-এমপিদের আমলনামা পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং কয়েকদফা মাঠ জরিপের রিপোর্টের ভিত্তিতে ‘অনেকটাই ঝুঁকিমুক্ত’ নেতাদের চিহ্নিত করে আগেভাগেই গ্রীন সিগন্যাল দিয়ে নির্বাচনী ভোটযুদ্ধে নামানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটির হাইকমান্ড। তিন শ’ আসনেই দলের বর্তমান মন্ত্রী-এমপিদের তৃণমূলে অবস্থান, জনপ্রিয়তায় হ্রাস-বৃদ্ধি, গত সাড়ে চার বছরে তাঁদের কর্মকা-, সংসদীয় আসনগুলোতে দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে দলেরই সম্ভাব্য কারা কারা বিরোধিতা করতে পারেন, বিরোধী দলের সম্ভাব্য প্রার্থী কে হতে পারে, বিরোধী প্রার্থীর সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থান ও দুর্বলতাসহ প্রতিটি আসনের আমলনামা সরকারী ও দলীয়ভাবে কয়েকদফা জরিপ চালিয়ে সংগ্রহ করেছেন শেখ হাসিনা। এসব আমলনামা পর্যালোচনা এবং তৃণমূল নেতাদের মতামত সংগ্রহ করেই প্রধানমন্ত্রী ‘ঝুঁকিমুক্ত’ প্রার্থীদের আগাম গ্রীন সিগন্যাল দিয়ে মাঠে নামানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে জানা গেছে।
প্রার্থীদের ব্যাপারে তৃণমূল নেতাদের সর্বশেষ মতামত নিতেই আগামী ৪ সেপ্টেম্বর থেকে তাঁর সরকারী বাসভবন গণভবনে সিরিজ বৈঠকের উদ্যোগ নিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। দলটির উপদফতর সম্পাদক এ্যাডভোকেট মৃণাল কান্তি দাস জনকণ্ঠকে জানান, ওইদিন প্রথম পর্যায়ে ভোলা, মানিকগঞ্জ, দিনাজপুর, জামালপুর, রাজবাড়ী, লালমনিরহাট ও গাজীপুর জেলা ও জেলাধীন সকল থানা, উপজেলা ও প্রথম শ্রেণীর পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের সঙ্গে বৈঠক করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই বৈঠকে আগামী দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের ব্যাপারে তৃণমূল নেতাদের মতামত গ্রহণ করবেন তিনি।
তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর এই বৈঠকের কারণ সম্পর্কে দলটির একাধিক সূত্র জানায়, বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে একান্তে কথা বলার পাশাপাশি তাদের দিয়ে একটি জরিপের ফর্ম পূরণ করাবেন। ১০টিরও অধিক প্রশ্নসংবলিত এই জরিপের ফলাফলে ওঠে আসবে- নিজ নিজ জেলার সংসদীয় আসনের দলীয় সম্ভাব্য প্রার্থীদের সর্বশেষ অবস্থা কেমন, প্রার্থীর ব্যক্তি ইমেজ কেমন, তৃণমূলের সঙ্গে যোগাযোগ কেমন? দলের জন্য ওই প্রার্থী ইতিবাচক নাকি নেতিবাচক ভাবমূর্তি বয়ে আনবে? এসব নানা প্রশ্নের উত্তর নিয়ে এবং প্রয়োজনে তৃণমূল নেতাদের নিয়ে একান্তে কথা বলে প্রধানমন্ত্রী দলের প্রার্থিতা বাছাই করবেন। ৪ সেপ্টেম্বরের পর দ্বিতীয় পর্যায়ে আরও ১০টি জেলার সঙ্গে ৮ সেপ্টেম্বর পরবর্তী বৈঠক হতে পারে গণভবনে।
দলটির একাধিক নীতিনির্ধারক নেতার সূত্রে জানা গেছে, সংবিধান অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়েই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে দশম জাতীয় নির্বাচনের অনুষ্ঠানের পক্ষে দৃঢ় অবস্থানে থেকেই আওয়ামী লীগ নির্বাচনী প্রস্তুতির কাজ আগেভাগেই সম্পন্ন করতে চায়। মুখে অনড়ভাব দেখালেও শেষ পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনেই বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেÑ নানা সূত্র থেকে এটা নিশ্চিত হয়েই এখন থেকে শাসক দলের সব কর্মকা-ই নির্বাচনভিত্তিক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটির হাইকমান্ড।
সূত্র জানায়, সারাদেশে বিদ্যমান দলীয় অভ্যন্তরীণ কোন্দল, দ্বন্দ্ব-বিবাদ ও একাধিক প্রার্থিতার সম্ভাবনার বিষয়টি মাথায় রেখেই আগেভাগেই তিন শ’ আসনেই দল ও মহাজোটের প্রার্থী বাছাইয়ের কাজ শেষ করতে চান আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা। সকল এমপি-মন্ত্রীদের আমলনামা পর্যালোচনা করেই যেসব যাদের সঙ্গে সাধারণ মানুষ ও তৃণমূল নেতাদের দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-কোন্দল রয়েছে- তা চিহ্নিত করে দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি। সাংগঠনিক সফরে যাওয়া দলের সকল কেন্দ্রীয় নেতাদেরও দলীয় প্রার্থীদের সম্পর্কে সবকিছু তথ্য সংগ্রহ করে রিপোর্ট প্রদানের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
জানা গেছে, তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে এই সিরিজ বৈঠক শেষ হওয়ার পর পরই ঝুঁকিমুক্ত বা অপেক্ষাকৃত ঝুঁকিমুক্ত মন্ত্রী-এমপিদের সঙ্গেও সিরিজ বৈঠক করবেন প্রধানমন্ত্রী। ২০-২৫ জন এমপিদের নিয়ে টিম করে ধারাবাহিক বৈঠকের মাধ্যমে তাঁদের ত্রুটি-বিচ্যুতি ও নির্বাচনী মাঠে করণীয় সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দেবেন তিনি। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা দলীয় বিভিন্ন ফোরামের বৈঠকে আগেই সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, দলের যেসব মন্ত্রী-এমপি অতি ঝুঁকিপূর্ণ, জনবিচ্ছিন্ন ও ইমেজ সঙ্কটে রয়েছেন তাঁদের কাউকেই আগামী নির্বাচনে তিনি মনোনয়ন দেবেন না। সেক্ষেত্রে আগামী নির্বাচনে প্রায় শতাধিক আসনে প্রয়োজনে প্রার্থিতা পরিবর্তনেরও ইঙ্গিত দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অভ্যন্তরীণ কোন্দল, দ্বন্দ্ব ও বিভেদের কারণে পাঁচটি সিটি কর্পোরেশনে ভরাডুবির পর এখন অনেকটাই সতর্ক শাসক দলটি। এই পাঁচ সিটিতে পরাজয়ের কারণ অনুসন্ধানের পর সম্ভাব্য ভুল-ভ্রান্তিগুলো চিহ্নিত করেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে দলটিতে। এছাড়া গত সাড়ে চার বছর ধরেই বিদ্রোহী প্রার্থিতাই ভুগিয়েছে দলটিকে। শুধু অভ্যন্তরীণ কোন্দল-বিবাদ ও বিদ্রোহী প্রার্থিতার কারণেই উপনির্বাচনসহ স্থানীয় সরকারের অনেক নির্বাচনেই দলের জনপ্রিয় প্রার্থীদের ভরাডুবি ঘটেছে।
এসব দিক বিবেচনা করেই আগে ‘নিজের ঘর’ ঠিক করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েই কোমর বেঁধে নির্বাচনী ভোটযুদ্ধে নামার প্রস্তুতি চলছে আওয়ামী লীগে। জাতীয় নির্বাচনের কোন আসনেই যাতে দল বা জোটের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে দলের কোন নেতা বা অংশ বিরোধিতা করতে না পারে, সে লক্ষ্য নিয়েই সারাদেশের তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে সিরিজ বৈঠকের উদ্যোগ নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। প্রতিটি আসনের জরিপে উঠে আসা তথ্য সতর্কতার সঙ্গে পর্যালোচনা করেই প্রার্থী বাছাইয়ের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী।
সূত্রগুলো এও জানান, বেশ কয়েক দফায় সারাদেশে এই জরিপ চালানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা, দল সমর্থিত সাবেক আমলা, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক ও সাবেক ছাত্র নেতাদের দিয়ে এবং কয়েকটি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে তিন শ’ আসনে এই জরিপ চালানো হয়েছে। এসব জরিপে দলের মন্ত্রী-এমপি ও সম্ভাব্য প্রার্থীদের সর্বশেষ অবস্থান, তাঁদের ব্যক্তিগত ইমেজ, তৃণমূল নেতাকর্মীসহ এলাকার জনগণের সঙ্গে সুসম্পর্ক আছে কিনা, ক্ষমতার সাড়ে চার বছরে স্বজনপ্রীতিসহ দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত কিনা, পারিবারিক প্রভাব, নেতাকর্মীদের সঙ্গে আচার-আচরণ এবং বিপরীতে বিরোধী দলের সম্ভাব্য প্রার্থী, তাদের সামাজিক-পারিবারিক অবস্থান, অতীত কর্মকা- এবং বিরোধী প্রার্থীদের দুর্বলতার দিকগুলোও উঠে এসেছে এসব জরিপে। এসব জরিপের ভিত্তিতেই প্রার্থী বাছাইয়ের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী।

শেয়ার করুন