সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের নেতৃত্ব যতই দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হওয়ার কথা বলছে, জনমনে ততই দলনিরপেক্ষ সরকারের দাবি জোরদার হচ্ছে। কারণ মানুষ কোনোভাবেই নির্বাচনকালীন অশান্তি ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা চায় না। সবাই চায় শান্তিপূর্ণ অবস্থায় সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। এ অবস্থায় নির্বাচন কমিশন (ইসি) নিয়ে বিতর্ক ও তার কাজে হতাশা দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিকে জনগণের দাবিতে পরিণত করেছে।
গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য যেখানে স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের (ইসি) বিকল্প নেই, সেখানে উল্টো পথে হাঁটতেই যেন আগ্রহী বর্তমান কমিশন। ফলে বিরোধী দল বিএনপি ও ১৮ দলীয় জোট এই বিতর্কিত ইসির অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার ঘোষণা দিয়েছে। শুধু তাই নয়, বর্তমান সরকারের অংশীদার ও আওয়ামী মহাজোটের প্রধান শরিক জাতীয় পার্টিও পরিষ্কার ভাষায় বলে দিয়েছে, এই ইসির অধীনে কোনোভাবেই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। এ অবস্থা অবশ্য একদিনে সৃষ্টি হয়নি। বর্তমান সরকারের আমলে বিভিন্ন নির্বাচনে কমিশনের ভূমিকাই তাকে বিতর্কিত করেছে। মানুষ ধীরে ধীরে আস্থা হারাতে শুরু করেছে। একইভাবে সরকারের ভূমিকাও বেশি করে প্রশ্নবিদ্ধ হতে থাকে।
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তত্কালীন ইসি সেনা মোতায়েন করতে চাইলেও সরকার তা বাতিল করে দেয়। এক্ষেত্রে ইসির নতজানু ভূমিকাই প্রমাণ করেছে কতটা স্বাধীন ও শক্তিশালী এই প্রতিষ্ঠানটি। আর বর্তমান ইসি নির্বাচনী আইন জনপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) থেকে নির্বাচনে সেনা মোতায়েন করার ক্ষমতাই বাতিল করার সুপারিশ করেছে। অথচ সাবেক নির্বাচন কমিশনারসহ অনেকেই মনে করেন, সেনাবাহিনী ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। একইভাবে সবাই যখন মনে করছে ইসিকে শক্তিশালী করা জরুরি, তখন তারা নিজেদের দুর্বল করতেই উঠেপড়ে লেগেছে। সম্প্রতি আরপিও’র ৯১ই ধারা বাতিল করে প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতাও খর্ব করতে চেয়েছিল বর্তমান ইসি। তুমুল আপত্তির মুখে অবশেষে আইন মন্ত্রণালয়ের পরামর্শে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলেও ইসির আসল চেহারা একেবারে প্রকাশ হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন কাজে প্রতিষ্ঠানটি প্রমাণ করেছে, সাংবিধানিক সংস্থা হিসেবে জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থাভাজন হওয়ার চাইতে সরকার ও সরকারি দলের অনুগত থাকতেই তারা আগ্রহী। অতিসম্প্রতি কমিশনাররা না জানলেও কমিশন সচিবের মুখ থেকে আগামী জাতীয় নির্বাচনের তারিখ সম্পর্কিত কথা থেকে তার ওপর সরকারের প্রভাব প্রকাশ হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় সরকারের ইচ্ছার বাইরে ইসি কিছু করবে সে ভরসা কেউই পায় না।
সরকার ও সরকারি দল কয়েক হাজার স্থানীয় সরকার ও উপনির্বাচনে ইসির সাফল্যের কথা বললেও তা কারও মনে দাগ কাটে না। কারণ, তারা যে কথাটি আড়াল করতে চায় তা হলো, এসব নির্বাচনে সরকার পরিবর্তন হয় না। তারপরও টাঙ্গাইল উপনির্বাচন ও গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মতো অনেক স্থানেই ইসির বিতর্কিত ভূমিকা কারও চোখ এড়ায়নি। আর জাতীয় নির্বাচনে একদিনে ৩০০ আসনে নির্বাচন হওয়ায় ইসি, পর্যবেক্ষক ও মিডিয়া কর্মী কারও পক্ষেই সর্বত্র যথাযথ ভূমিকা পালন করা অসম্ভব, এতে সন্দেহ নেই। এমনিতেই প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্নের শেষ নেই। দলীয় সরকার বাছাই করে কীভাবে নিজস্ব লোকদেরই গাজীপুর নির্বাচনে নিয়োগ দিয়েছিল সেটা সবাই জানে। এক্ষেত্রেও ইসি গ্রহণযোগ্য ভূমিকা পালনে সক্ষম হয়নি। আর সাম্প্রতিক যাচ্ছেতাই ভূমিকা ইসিকে এতটাই বিতর্কিত করেছে যে, তার গ্রহণযোগ্যতা তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। এ অবস্থায় নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকেও ইসির যা খুশি তাই করার অধিকার নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এই বিতর্কিত কাজের জন্য একদিন জনতার কাঠগড়ায় ওঠার হুশিয়ারিও দেয়া হয়েছে।
তবে কোনোকিছু বিবেচনায় নিতে রাজি নন বলেই সাফ জানিয়ে দিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি)। তার এক কথা, কারা কী বলল সেটি তাদের বিষয় নয়। তিনি আইন অনুযায়ী কাজ করে যাবেন। একেবারে সাচ্চা ঈমানদারের মতো কথা! সেজন্যই তো সেনাবাহিনী মোতায়েনের আইন বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে। প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতাও ছেড়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। নির্বাচনের আগে আরও কত কী করে ইসিকে নখদন্তহীন ব্যাঘ্রে পরিণত করা হবে, সেটা আমাদের জানা নেই। তবে এটাও যে আইনসম্মতভাবে করা হবে, নেপথ্যে হয়তো এমনই আয়োজন তৈরি করা হয়েছে। ঠিক যেভাবে সংবিধান সংশোধন করে প্রধানমন্ত্রী এখন কট্টর সংবিধানপন্থী হয়ে উঠেছেন। আসন্ন নির্বাচনকালে যে কোনো ধরনের দলনিরপেক্ষ সরকারের বিকল্প যে নেই সেটা তিনি শুনতেই রাজি নন। একেবারে সেই বাকশালী মনোভাব বলা যায়। তবে এভাবে যে শেষ রক্ষা হয় না সেটি এদেশে বার বারই দেখা গেছে। শেষ পর্যন্ত জনগণের রায়ই সবকিছু নির্ধারণ করে।