জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরে আমাদের বাংলাদেশের দ্বিতীয় গর্ব হলেন গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর বিগত ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ এর শাসনামলে দেশ বিদেশে ড. ইউনূস এবং গ্রামীণ ব্যাংকের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। সেই তিনি এবং তাঁর সরকার ২০০৯ সালে নতুন করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে ব্যক্তিগত আক্রোশে ড. ইউনূসকে সুদখোর-ঘুষখোর বলছেন, গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি থেকে তাঁকে অপসারণ করেছেন। নতুন চেয়ারম্যান বসিয়েছেন, সংস্কারের নামে এটাকে ১৯ খন্ড করার নগ্ন খেলায় মেতে উঠেছেন এবং সরকারী করণ করার উগ্র ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছেন।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস কর্তৃক ১৯৭৪ সালে চট্টগ্রামের জোবরা গ্রাম থেকে হত দরিদ্র মহিলাদেরকে নিজের পকেটের টাকায় এবং পরবর্তীতে জনতা ব্যাংক থেকে নিজ জিম্মায় টাকা দিয়ে দেশে নারীর ক্ষমতায়ন এবং দারিদ্র মুক্তির সংগ্রাম শুরু করেন। বহু চড়াই উতরাই পার করে গ্রামীণ ব্যাংকের ৯৭ ভাগ মহিলা ঋণ গ্রহীতাদের জন্য তিনি মুক্তির স্বপ্নের বাস্তব সিঁড়ি তৈরী করেন। এই সিঁড়ি বেয়ে ৯৭ ভাগ নারীরাই হলেন গ্রামীণ ব্যাংকের মালিক। এর মধ্যে পুরুষ ঋণ গ্রহীতা মালিক মাত্র ৩ শতাংশ । গ্রামীণ ব্যাংকের মূল মালিকানার ক্ষেত্রে যেখানে সরকারের মালিকানা মাত্র ৩ শতাংশ সেখানে গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ গ্রহীতাদের মালিকানা ৯৭ শতাংশ। গ্রামীণ ব্যাংকের মহিলা ঋণগ্রহীতার সংখ্যা প্রায় ৮০ লাখ। এরাই ব্যাংকটির মূল মালিক। আমাদের প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রায়ত্ব সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারীর আদলে সোনালী ব্যাংকের মতো গ্রামীণ ব্যাংককে সরকারীকরণ করতে চান। আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী একশো বছর চেষ্টা করলেও ড. ইউনূসের মতো একটি গ্রামীণ ব্যাংক দেশবাসী এবং বিশ্বকে উপহার দিতে পারবেন না। ড. ইউনূস এবং তাঁর গ্রামীণ ব্যাংকের অভূতপূর্ব সাফল্যের জন্য ২০০৬ সালের ১৩ অক্টোবর নরওয়ের অসলোতে যৌথভাবে শান্তিতে নোবেল পেয়েছে। ড. ইউনূস এর প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক সমাজের অবহেলিত হতদরিদ্র নারীদেরকে অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী করে সমাজে ওদের মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছে অন্যদিকে এ সমস্ত নারী এবং তাদের পরিবারের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা চিকিৎসার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরণের প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে ওদেরকে নাগরিক অধিকার এবং কর্ম সংস্থানে স্বাবলম্বী হতে সহায়তা করেছে। গ্রামীণ ব্যাংকের সাথে আজ দেশের প্রায় সাড়ে চার থেকে পাঁচ কোটি মানুষের জীবন জীবিকার সম্পর্ক জড়িত। গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ গ্রহীতা নারীদের সন্তানেরা উচ্চতর শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দেশ বিদেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন। সংগত কারণে প্রশংসা করতে হয় যে, দেশের প্রান্তিক অর্থনৈতিক কাঠামোকে ড. ইউনূস এবং তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক একটি শক্ত কাঠামোর উপর দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছেন। গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ আদায়ের পরিমাণ ৯৯ ভাগ কিংবা তারও উপরে। বর্তমানে এর ঋণ গ্রহীতার সংখ্যা প্রায় পঁচাশি লাখ এবং ঋণ গ্রহীতারাই এই ব্যাংকটির মূল মালিক। একটি বিশেষায়িত ব্যাংক হিসেবে গ্রামীণ ব্যাংকের ধারণা এখন বিশ্ব অর্থনৈতিক ধারণার ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংকের মডেল এবং তাঁর সামাজিক ব্যবসার ধারণা ইউরোপ, আমেরিকা, এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকার প্রায় একশোটি দেশে অনুস্মরণীয় অর্থনীতির নতুন দর্শন উপহার দিয়েছে এবং এর সুফলও আশাতীতভাবে অর্জিত হচ্ছে । যা ক্ষুধা দারিদ্র ও বেকারত্বমুক্ত নতুন অর্থনৈতিক বিশ্ব উপহার দেবে বলে অনেকেই মনে করেন। বিশ্বব্যাপী নতুন অথনৈতিক ধারণা ড. ইউনূসের অর্থনীতির দর্শন বিংশ শতাব্দীর শেষে এবং একবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে ক্ষুধা দারিদ্রমুক্ত বিশ্ব উপহারের নতুন দর্শন। ড. ইউনূস আমেরিকার প্রেসিডেন্ট এওয়ার্ড ও ঐদেশের সর্বোচ্চ খেতাব কংগ্রেসনাল এওয়ার্ড থেকে শুরু করে পুরো বিশ্বে প্রায় দুইশত পঞ্চাশের মতো আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন। জীবিত অবস্থায় আজ পর্যন্ত পৃথিবীর ইতিহাসে কোন ব্যক্তির পক্ষে এতো পুরস্কার পাওয়া অতীতে সম্ভব হয়নি। ড. ইউনূস এর প্রতিষ্ঠিত গ্রামীন ব্যাংক এখন বিশ্ব প্রতিষ্ঠান। গ্রামীণ ব্যাংককে টুকরো টুকরো করার অধিকার এবং এর স্বাধীন বেসরকারী নিয়ন্ত্রণ ব্যাহত (রহিত) করার অধিকার বাংলাদেশ সরকারের নেই। আমি দৃঢ়তার সাথে বলতে চাই সরকার এ ব্যাপারে সফল হবে না।
সংকীর্ন মানসিকতা নিয়ে কোন মানুষ বড় হতে পারেন নি। যিনি সৃষ্টিকর্তাকে বিশ্বাস করেন কিন্তু তাঁর মানব সন্তান এবং সৃষ্টিকে ভালোবাসতে পারেন না তিনি সৃষ্টিকর্তাকেও ভালোবাসেন না। দিগন্ত আকাশে পাখিরা ডানা মেলে এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে বিচরণ করে। তেমনি একজন মহৎ মানুষের চিন্তা কোন বিশেষ গোষ্ঠি, জাতি,বর্ণ এবং ধর্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। ড. ইউনূস তাঁর কৃতকর্ম দিয়ে পৃথিবীর মানুষের অন্তরাত্মাকে জয় করতে পেরেছেন। সে কারণে তিনি আজ শুধু বাংলাদেশের নাগরিক নন- তিনি বিশ্ব নাগরিকও বটে। একজন বিশ্ব নাগরিককে নিয়ে কোন একটি নির্দিষ্ট দেশের প্রধানমন্ত্রী. তাঁর মন্ত্রী, আমলা-কামলারা কি বললেন, সেটা কিন্তু আন্তর্জাতিক ভাবনা নয়। এটা নিতান্ত ব্যক্তিগত অভিরুচির বহিঃপ্রকাশ। আমার বিবেচনায় এ সময় পৃথিবীর সব প্রেক্ষিত এবং ব্যক্তিদের গুনাগুন ও অবদান বিচার করলে ড. ইউনূসের স্থান প্রথম। পৃথিবীর একজন প্রধান ব্যাক্তিকে নিয়ে তাঁর দেশের রাজনীতির নায়ক নায়িকারা অনেক মিথ্যা ও উদ্ভট আস্ফালন করেছেন। মানুষের মুক্তির প্রতি সম্মান রেখে এই তর্কবাগিশরা নিজেদেরকে সংযত করবেন, সংযত আচরণে অভ্যস্ত হবেন এটাই আশা করি ।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির স্রষ্টা। একথা কেউ অস্বীকার করলে বা কেউ তাঁকে হেয় করার চেষ্টা করলে তিনি যেমন নিজেই হেয় হবেন তেমনি তার পবিত্র আত্মাকেও বিকৃত করবেন। তদরূপ এ দেশের আরেকজন শ্রেষ্ঠ সন্তান শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসের ক্ষেত্রেও তা সত্য। তবে অবদানের দিক থেকে এখানে আমি কারো সাথে কাউকে তুলনা করতে চাইনি। আত্মার পবিত্রতার জন্য আসুন আমরা সুবচনে অভ্যস্ত হই। আত্মাকে কুলুশ মুক্ত করি। আমাদের সামনে আরো অনেক পথ বাকী।