বিশ্বে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের কদর ভালো। নানা প্রান্তের সাধারণ ক্রেতারা এসব কিনছেন। কিন্তু এ দেশের কোনো কারখানায় দুর্ঘটনা ঘটলেই বাধে বিপত্তি। পুরো বিশ্বই তখন পোশাক খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নসিহত করতে থাকে। বেশি উচ্চারিত হয় কারখানার কর্মপরিবেশ উন্নত করার বিষয়টি।
তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ড এবং রানা প্লাজা ধস—এই দুই ঘটনার পর কারখানার নিরাপত্তা নিয়ে দেশে-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। সে কারণে সম্প্রতি সংশোধিত শ্রম আইনে এ বিষয়ে কয়েকটি ইতিবাচক বিধানও রাখা হয়েছে। কিন্তু সেগুলো আদৌ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে পারবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেছে।
শ্রমিকনেতা ও শ্রমিকস্বার্থ নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো বলছে, কারখানার কর্মপরিবেশ নিশ্চিত হলে কখনোই কোনো কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ কিংবা ভাঙচুরের মতো ঘটনা ঘটতো না। কারখানায় অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা রাখা, বিকল্প সিঁড়ি থাকা, পর্যাপ্ত আলো-বাতাস ঢোকার মতো ব্যবস্থা নিশ্চিত করলেই কর্মপরিবেশ নিশ্চিত হয় না।
কিন্তু অসদাচরণের কারণে যেকোনো সময় চাকরিচ্যুতি ও এ জন্য ক্ষতিপূরণ না দেওয়া, ছয় মাস মাতৃত্বকালীন ছুটি না রাখার মতো আইনে এমন কয়েকটি ধারা রাখা হয়েছে, যাতে শ্রমিকেরা কোনোভাবেই কারখানাকে আপন করে নিতে পারবেন না। আবার কারখানার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মালিকদের দায়বদ্ধতা কিংবা তাঁদের শাস্তি বাড়ানোর বিষয়েও শ্রম আইন নিশ্চুপ।
শ্রমিকের কর্মপরিবেশ নিয়ে সরকারি পর্যায়েও উদ্যোগের কিছু দুর্বলতা রয়েছে। কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকের নিরাপত্তাসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ১২টি কনভেনশন থাকলেও একটিতেও সই করেনি বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বর্তমান অভিজ্ঞতার আলোকে কোনো দুর্ঘটনা এড়াতে কারখানার কর্মপরিবেশের মানোন্নয়নে যে ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন ছিল, তেমন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। আইনে শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়ে মৌলিক পরিবর্তন আসেনি। শ্রমিকদের চাকরির নিরাপত্তা, সংগঠিত হওয়া ও মতামত প্রকাশের বিষয়টি নিশ্চিত হয়নি।’ তিনি বলেন, শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব মালিকের। তা না করলে মালিকের শাস্তি কী হবে, তা আইনে বলা হয়নি। তা হলে তো নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে না।
বিজিএমইএর সভাপতি আতিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, শ্রমিকের নিরাপত্তার ওপরে কিছু নেই। এই মুহূর্তে পোশাক খাতকে এগিয়ে নিতে হলে ভবনের নিরাপত্তা এবং অগ্নিদুর্ঘটনা রোধের পরই কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্য নিরাপত্তার ওপর বেশি জোর দিতে হবে।
শ্রম আইন ও নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন: আইনে শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়ে একগুচ্ছ ইতিবাচক পদক্ষেপ রাখা হয়েছে। বলা হয়েছে, অনুমোদিত কারখানা ভবনের নকশার সঙ্গে কারখানার যন্ত্রপাতি স্থাপনের নকশার কাঠামোগত কোনো পরিবর্তন করা যাবে না। কাজ চলার সময় প্রতিষ্ঠানের বাইরে যাওয়ার কোনো দরজা বন্ধ রাখা যাবে না। কমপক্ষে ১০০ জন শ্রমিক কাজ করা প্রতিষ্ঠানে বিমা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। শ্রমিক মারা গেলে মালিক বিমা দাবি আদায় করে তা সরাসরি পোষ্যদের দেবেন অথবা শ্রম আদালতে পাঠাবেন।
এ ছাড়া শ্রমিকের চাকরির মেয়াদ নয় মাস হলেই তিনি ওই প্রতিষ্ঠানের সুবিধাভোগী বিবেচিত হবেন। শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শ্রমিকদের জন্য গ্রুপ বিমা থাকবে। যেসব প্রতিষ্ঠানে পাঁচ হাজার বা এর বেশি শ্রমিক কাজ করেন, সেখানে স্থায়ী স্বাস্থ্যকেন্দ্র থাকতে হবে। পেশাগত রোগে আক্রান্ত শ্রমিকদের সুস্থ হওয়া পর্যন্ত চিকিৎসার দায়িত্ব মালিককে নিতে হবে।
তবে এই পদক্ষেপগুলোর বাস্তবায়ন পুরোপুরি মালিকের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করছে। সে কারণেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়ন না হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস করা শ্রমিকদের দীর্ঘদিনের দাবি হলেও আইনে আগের মতোই চার মাস ছুটি রাখা হয়েছে। ছুটি ভোগের পর কাজে যোগ দিলে দুই মাসের মূল বেতন প্রণোদনা হিসেবে পাবেন নারী শ্রমিকেরা। তবে প্রসূতিকল্যাণে বাধা দিলে মালিকের অর্থদণ্ড পাঁচ হাজার থেকে বাড়িয়ে ২৫ হাজার টাকা করা হয়েছে।
মূল দাবি উপেক্ষিত হওয়ায় ক্ষুব্ধ শ্রমিকনেত্রী মোশরেফা মিশু প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারি আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস করার দাবি ছিল। কিন্তু আইনে তা করা হয়নি। সরকার মালিকপক্ষের স্বার্থ রক্ষা করেই আইন করেছে।’
আইনে সবচেয়ে বড় খড়্গ হচ্ছে, অসদাচরণের দায়ে মালিক কোনো ক্ষতিপূরণ দেওয়া ছাড়াই যেকোনো সময় যেকোনো শ্রমিককে বরখাস্ত করতে পারবেন। শ্রমিকনেতারা মনে করেন, এতে শ্রমিকেরা কখনোই স্বস্তি নিয়ে কাজ করতে পারবেন না।
আইন অনুযায়ী, একজন শ্রমিক চাকরি ছেড়ে দেওয়ার পর আট বছরের কম সময় চাকরি করে থাকলে গ্র্যাচুইটি হিসেবে প্রতি বছরের জন্য ৩০ দিন আর আট বছরের বেশি হলে ৪৫ দিনের মজুরি পাবেন। তবে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে গ্র্যাচুইটি দেওয়ার ব্যাপারে বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়নি। এ কারণেই শ্রমিকেরা এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে পারেন—এমন আশঙ্কাও থেকে যায়।
আন্তর্জাতিক কনভেনশন উপেক্ষিত: শ্রমিক নিরাপত্তাসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ১৮৯টি কনভেনশন আছে। বাংলাদেশ ৩৩টিতে সই করেছে এবং বাস্তবায়ন করছে। তবে সই করেনি কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকের নিরাপত্তাসংক্রান্ত ১২টি কনভেনশনের একটিতেও।
এ প্রসঙ্গে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, এসব কনভেনশন সই না করায় এখনই কোনো প্রভাব পড়বে না। তবে শ্রমিকদের মান উন্নত করার বিষয়ে বাংলাদেশের যে বৈশ্বিক অঙ্গীকার আছে, তার পরিপন্থী হবে।
গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, এসব কনভেনশনে সই করলে বৈশ্বিক ফোরাম ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর কাছে বিভিন্ন শর্ত পালন না করলে বাংলাদেশকে জবাবদিহি করতে হবে। আবার একইভাবে এসব শর্ত পূরণ করতে বিনিয়োগ করতে হবে এবং তদারকিও করতে হবে। এসব ক্ষেত্রে তখন বাংলাদেশ সহায়তাও চাইতে পারে।
জানতে চাইলে শ্রমসচিব মিকাইল শিপার প্রথম আলোকে বলেন, আইএলওর এসব কনভেনশন নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে।
কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তাসংক্রান্ত আইএলওর যে ১২টি কনভেনশন সই করেনি বাংলাদেশ
অকুপেশনাল সেফটি অ্যান্ড হেলথ কনভেনশন, ১৯৮১; অকুপেশনাল হেলথ সার্ভিস কনভেনশন, ১৯৮৫; প্রমোশনাল ফ্রেমওয়ার্ক ফর অকুপেশনাল সেফটি অ্যান্ড হেলথ কনভেনশন, ২০০৬; হাইজিন (কমার্স অ্যান্ড অফিসেস) কনভেনশন, ১৯৬৪; অকুপেশনাল সেফটি অ্যান্ড হেলথ কনভেনশন, ১৯৭৯; সেফটি অ্যান্ড হেলথ ইন কনস্ট্রাকশন কনভেনশন, ১৯৮৮; সেফটি অ্যান্ড হেলথ ইন অ্যাগ্রিকালচার কনভেনশন, ২০০১; রেডিয়েশন প্রোটেকশন কনভেনশন, ১৯৬০; অকুপেশনাল ক্যানসার কনভেনশন, ১৯৭৪; ওয়ার্কিং এনভায়রনমেন্ট (এয়ার পলুশন, নয়েজ অ্যান্ড ভাইব্রেশন) কনভেনশন, ১৯৭৭; অ্যাসবেসটস কনভেনশন, ১৯৮৬;