জেনারেল মাসুদ হঠাত্ ঢাকায়

0
137
Print Friendly, PDF & Email

লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী। ওয়ান-ইলেভেনের রূপকারদের অন্যতম একজন। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় গুরুতর অপরাধ দমন সমন্বয় কমিটির প্রধান হিসেবে দেশজুড়ে সর্বমহলে তার নামডাক ব্যাপক পরিচিতি পায়। ফখরুদ্দীন সরকারের শেষ সময়ে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিয়ে তত্কালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটলে তার চাকরি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হয়। নিয়োগ পান অস্ট্রেলিয়ায় হাইকমিশনার হিসেবে। সৌভাগ্যবান এই সেনা কর্মকতা হাইকমিশনার হিসেবে ৩ বছর মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও দুই দফায় তার মেয়াদ বেড়েছে। সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেয়ার পরও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সেনাসমর্থিত সরকার যখন দেশে ফিরতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে তখন জেনারেল মাসুদ তাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন বলে কথিত আছে। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে বিদেশ পাঠানোরও বিরোধিতা করে জেনারেল মইনের চক্ষুশূল হন তিনি। অবশ্য তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকোর নির্যাতনের ঘটনায় খালেদা জিয়া পরিবারের সঙ্গে তার আত্মীয়তার দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। ভায়রা ভাই মেজর সাঈদ এস্কান্দরের মৃত্যুর সময় এমনকি মাস তিনেক আগে সাঈদ এস্কান্দরের ছেলের বিয়েতে পর্যন্ত তিনি আসেননি।

সম্প্রতি হঠাত্ করে তার দুই সপ্তাহের ব্যক্তিগত ঢাকা সফর নিয়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মহলে চলছে ব্যাপক আলোচনা। কেউ কেউ বলার চেষ্টা করছেন তিনি বিশেষ কারণেই ঢাকায় এসেছেন। এমনও কথা উঠেছে তাকে বিশেষ একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গাতে বসানো হতে পারে। এই জন্য তাকে ঢাকায় ডেকে পাঠানো হয়েছে। ঢাকায় অবস্থানকালে তিনি একাধিক ভিআইপির সঙ্গেও বৈঠকে বসেছেন। এমনকি কারো কারো নৈশ ভোজেরও অতিথি হয়েছেন। আরও বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে তার দেখা হওয়ার কথা রয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যখন অকল্পনীয় ঘোলাটে ঠিক তখন তার এই ব্যক্তিগত সফর এবং তত্পরতা কেউ কেউ সন্দেহের চোখে দেখছেন। সন্দেহের তীর ছুড়ে কেউ বলছেন, তিনি সরকারের শেষ সময়ে কোরামিন দিতে এসেছেন। আবার কেউ বলছেন আগামী দিনে বিএনপিকে কোণঠাসা করতেই তাকে ঢাকায় আনানো হয়েছে।

তাকে নিয়ে এসব আলোচনা-সমালোচনায় তিনি নিজেই বিস্মিত। বললেন এসব তার কানেও যাচ্ছে। এই ব্যাপারে জানতে চাইলে তার সোজাসাপ্টা উত্তর— মানুষ না জেনে অনুমানের ওপর অনেক কথা বলে। যার কোনো ভিত্তি নেই। তিনি বলেন, আমি স্পষ্ট করেই বলতে চাই, আমি কোনো সরকারি ছুটিতে কিংবা সরকারি সফরে ঢাকায় আসিনি। নিজ পয়সা খরচ করে ব্যক্তিগত ছুটি নিয়ে ঢাকায় এসেছি। এটা স্রেফ ব্যক্তিগত ছুটি। এ নিয়ে যারা নানা কথা বলছেন তা শতভাগ মিথ্যা। ছুটি শেষ করে ফিরে যাব। আমি এসেছি এটা গোপন নয়, সবাই জানে। নিজের বাড়িতেই আছি।

তিনি বলেন, আপনারা যেমন অনেক কথা শোনেন, আমিও অনেক কথা শুনি। কিন্তু এইসব কথার কোনো ভিত্তি নেই। আমি আমার ছুটি শেষ হলে চলতি সপ্তাহেই আবার আমার স্টেশনে ফিরে যাচ্ছি।

জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী গত ১৪ আগস্ট ঢাকায় আসেন। ২৫ আগস্ট তার অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে যাওয়ার কথা। হাইকমিশনার হিসেবে তৃতীয় দফা তার চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা আগামী ২৯ ডিসেম্বরে। নতুন করে তাকে আর কোনো দেশে রাষ্ট্রদূত নিয়োগ না করা হলে কিংবা অস্ট্রেলিয়াতে হাইকমিশনার হিসেবে চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো না হলে তিনি ফিরে আসবেন দেশে। সেইভাবেই প্রস্তুতি নিয়েছেন। তবে তার ছেলে আদর ও মেয়ে কুন্তলা থাকবেন অস্ট্রেলিয়াতে। সেখানে তারা লেখাপড়া করেন। ছেলে মাস্টার্স ও মেয়ে গ্র্যাজুয়েশন করছেন। তারা লেখাপড়া শেষ করার পর দেশে ফিরবেন।

সূত্র জানায়, সেনাপ্রধান জেনারেল আবদুল মুবীন যখন চাকরি থেকে অবসরে যান, তখন ছয়জন জেনারেলের নাম ছিল সম্ভাব্য সেনাপ্রধান হওয়ার তালিকায়। ওই তালিকায় নাম ছিল জেনারেল মাসুদেরও। তাকে সেনাপ্রধান বানানো হতে পারে এমন খবরও ছড়িয়ে পড়ে। এই খবর শোনার পর অনেকেই তার বিরোধিতা করেন। যে যেদিক থেকে পেরেছেন সেই দিক থেকে চেষ্টা করেছেন তার বিরুদ্ধে বলে প্রধানমন্ত্রীর কান ভারী করার জন্য। যারা হতে চেয়েছিলেন তাদের কেউ কেউ তার ব্যাপারে বিরোধিতা করেন। এই কারণে শেখ হাসিনার সম্ভাব্য তালিকায় তার নাম থাকলেও পরে তা আর হয়নি।

সম্প্রতি দুদকের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান অবসরে যাওয়ার পর বেশ কয়েকজনের নাম সম্ভাব্য চেয়ারম্যানের তালিকায় আসে। এর মধ্যেও ওয়ান-ইলেভেনের সময়কার তার দুর্নীতিবিরোধী অভিযান ও অভিজ্ঞতার গুরুত্ব বিবেচনা করে শেখ হাসিনা জেনারেল মাসুদকে চেয়ারম্যান করার ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করেন। কিন্তু সেখানেও বাদ সাধেন কয়েকজন। তাদের একটাই কথা জেনারেল মাসুদকে কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদে বসতে দেয়া যাবে না। কারণ তিনি বেগম খালেদা জিয়ার বেয়াই। তাকে পদে বসালে আওয়ামী লীগের জন্য ক্ষতি হবে। কিন্তু শেখ হাসিনা জানেন খালেদা জিয়ার সঙ্গে তার সম্পর্ক ভালো নয়। তারেক রহমান ও খালেদা জিয়া কেউ তাকে আগের মতো পছন্দ করেন না। এক সময়ে জেনারেল মাসুদকে খালেদা জিয়াও সেনাপ্রধান করতে চেয়েছেন। তিনি তালিকায়ও ছিলেন। কিন্তু বারবার সেনাপ্রধানের পদ তার হাতছাড়া হয়েছে।

সূত্রমতে, আওয়ামী লীগের একটি মহল মনে করে, জেনারেল মাসুদকে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসালে আওয়ামী লীগের লাভ হবে। কারণ বিএনপি তাকে দেখতে পারে না। মূলত তারেক রহমানের ওপর নির্যাতন ও খালেদা জিয়ার পরিবারের ওপর যে নির্যাতন করা হয়েছে এর সব দায়ভার তার ওপরে চাপানোর চেষ্টা করা হয়েছে। কৌশল করেই তাকে বিএনপি চেয়ারপারসনের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। যারা ষড়যন্ত্র করেছে তারা সফল হয়েছে।

এমনকি আওয়ামী লীগের কাছ থেকেও তাকে দূরে রাখার চেষ্টা করা হয়। এই জন্য নানা তথ্য সরবরাহ করা হয়। শেখ হাসিনা জানেন বলেই তাকে ভুল বোঝেননি। তার ঘনিষ্ঠ সূত্র জানায়, ওয়ান-ইলেভেনের সময় শেখ হাসিনাকে মাইনাস করার অংশ হিসেবে চিকিত্সার জন্য তিনি যখন বিদেশে যান তখন তাকে দেশে ফিরতে দেয়া হবে না বলে সিদ্ধান্ত নেয় ওই সময়ের সরকার। এই জন্য তারা তার দেশে ফেরার ওপর নিষেধাজ্ঞাও জারি করে। কিন্তু শেখ হাসিনা দেশে ফিরবেনই এই জন্য চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন। তার দেশে ফেরা নিয়ে তত্কালীন সরকারের ওপর চাপ বাড়তে থাকে। জেনারেল মইন তাকে দেশে ফিরতে দেবেন না এমন সিদ্ধান্ত নিলেও অটল থাকতে পারেননি। কারণ ওই সময়ের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার (পিএসও) জেনারেল মাসুদের কাছেও বিভিন্ন রাষ্ট্রদূতদের তরফ থেকে তার দেশে ফেরার ব্যবস্থা করার জন্য বলা হয়। জেনারেল মাসুদ বাস্তব অবস্থা বিবেচনা করে সেনাপ্রধান জেনারেল মইনের সঙ্গে দেখা করে শেখ হাসিনার দেশে ফেরার নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে বলেন এবং তাকে দেশে ফেরাতে বলেন। মইনকে বিপদ ও আশঙ্কার কথা বুঝিয়ে তিনি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করান ও চিঠি লেখান। এরপর জেনারেল মাসুদই শেখ হাসিনাকে লন্ডনে ফোন করে বলেন, ম্যাডাম আপনি আমাকে একটা দিন সময় দিন। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আমি আপনার দেশে ফেরার ব্যবস্থা করব। শেখ হাসিনা ছিলেন ভীষণ বিরক্ত। তিনি নিজ দেশে ফিরতে পারবেন না, এটা হতে পারে না। তার এক সময়ের অধস্তনরা তাকে দেশে ফিরতে দেবেন না, এটা তিনি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেননি। পরে জেনারেল মাসুদ তাকে বাস্তব অবস্থা বুঝিয়ে পুরো বিষয়ের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করেন। শেখ হাসিনাকে তিনি বলেন, ম্যাডাম আপনি কালকের পর যে কোনো সময়ে দেশে আসতে পারবেন কোনো সমস্যা হবে না। এর মধ্যে আমি সব ব্যবস্থা করে ফেলব। ওয়ান-ইলেভেনের অন্য নায়কদের বিরোধিতার মুখেই শেখ হাসিনাকে মাসুদ দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করেন।

তার ঘনিষ্ঠ সূত্র আরও জানায়, ওয়ান-ইলেভেনের সময় দুই নেত্রীকে মাইনাস করার জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়। চেষ্টা করা হয় দুজনকে বিদেশে পাঠানোর। তাদের বাদ দিয়ে নতুন নতুন দল গঠন করার। গঠনও করা হয় কয়েকটি দল। কিংস পার্টিও গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়। বিভিন্ন সংস্কারবাদী নেতা বিশেষ বিশেষ জায়গায় গিয়ে মিটিং করতেন আর তারা খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে মাইনাস করার পরিকল্পনা করতেন। কিংস পার্টি গঠন ও দুই নেত্রীকে মাইনাস করার একমাত্র বিপক্ষে ছিলেন জেনারেল মাসুদ। তার কারণেই কিংস পার্টি গঠন করা সম্ভব হয়নি। কিংস পার্টি গঠনের কাজ অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু জেনারেল মাসুদও সেখানে বসে উল্টো গুটি চালেন। তিনি ঠিক করেন, শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে। আর খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠানো ঠেকাতে হবে।

দুই নেত্রীকে গ্রেফতারেরও তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী। বলেছিলেন, তাদের গ্রেফতার করলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে না। সরকারপ্রধান এবং সেনাপ্রধানকে এ ধরনের হঠকারী সিদ্ধান্ত না নেয়ারও অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু তারা তা শোনেননি। মাসুদ সৌদি আরবে ওমরাহ পালন করতে গেলে গ্রেফতার করা হয় শেখ হাসিনাকে। আর যুক্তরাষ্ট্র সফরে যাওয়ার পর গ্রেফতার করা হয় খালেদা জিয়াকে। দুই নেত্রীর বিরুদ্ধে তিনি কোনো অভিযোগ দেননি। কোনো এফআইআর অনুমোদনও করেননি। তার আইনজীবীদের বলে দেন— দুই নেত্রীর নামে কোনো মামলায় কোনো ধরনের সহায়তা না করতে। তিনি বলেছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ এনে মামলা করা হলে ওই মামলা টিকবে না। মামলা টেকানোর মতো এভিডেন্স নেই।

খালেদাকে যখন সৌদি আরবে পাঠানোর পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয় তখন যাতে তার ভিসা না হয় সেই জন্য কাজ করেন জেনারেল মাসুদ। এক পর্যায়ে সৌদি আরবে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হলে খালেদা জিয়া আবেদন না করলে ভিসা দেবেন না বলে জানিয়ে দেন সৌদি রাষ্ট্রদূত। খালেদা আর ভিসার জন্য আবেদন করেননি— সৌদি আরব ভিসাও দেয়নি। ওই মিশন ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার পর ওয়ান-ইলেভেনের বেশ কয়েকজন ক্রীড়নক তাকে অন্য দেশে পাঠানোর চেষ্টা করেন। এই জন্য তার ভিসা লাগানোসহ সব ব্যবস্থা করেন। এমনকি সঙ্গে দেয়ার জন্য ডলারও দেন। গভীর রাতে তাকে একটি বিশেষ বাহিনীর গাড়িতে করে মইনুল রোডের বাড়ি থেকে সেনানিবাসের ভিতরের রাস্তা দিয়ে বিমানবন্দরে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করে। তার বাড়ির সামনে গাড়িও পাঠানো হয়। কিন্তু মাসুদের তত্পরতায় শেষ পর্যন্ত সব পরিকল্পনা ভণ্ডুল হয়।

জেনারেল মাসুদের ঘনিষ্ঠ সূত্র জানায়, মূলত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বেশ কয়েকজন নীতি নির্ধারকের সঙ্গে এইসব নিয়ে তার বিরোধ বাধে। আর ওই বিরোধের কারণে তাকে নবম পদাতিক ডিভিশন থেকে সরানো হয় সশস্ত্রবাহিনী বিভাগে। যখন তিনি কিংস পার্টি তৈরির বিরোধিতা করেন তখন সেনাবাহিনী থেকে তার চাকরি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হয়। সূত্রমতে, খালেদা জিয়ার পরিবারের বিরুদ্ধে কিছু না করেও তাকে বদনামের ভাগিদার হতে হয়েছে। এখনও খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান তাকে ভুল বুঝে আছেন। ক্ষমতায় আসতে পারলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেছেন। কিন্তু ওই সূত্র জানায়, বেগম খালেদা জিয়া ও তার পরিবারের ব্যাপারে সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়ার তিনি ছিলেন ঘোরতর বিরোধী। কোকোকে নিয়ে যখন নির্যাতন করা হয়, তখন তিনি তার অধস্তন কর্মকর্তাকে ডেকে পাঠিয়ে বলেন, কোকোর ওপর আর একটু নির্যাতন করা হলে বরদাস্ত করা হবে না। এমনকি যারা তাকে নির্যাতন করার জন্য নির্দেশ দিয়েছে তাদেরসহ যারা নির্যাতন করছে তাদের কারো চাকরি থাকবে না। কোকোর চিকিত্সার জন্য তিনি বিশেষ ভূমিকা রাখেন।

তারেক রহমানকে আটক করার পর তাকে নিয়ে অবর্ণনীয় নির্যাতন করা হয়। তাকে ওপরে তুলে মাটিতে ফেলে দেয়া হয়। ওই সময়ে খবর ছড়ানো হয় জেনারেল মাসুদের নির্দেশে তারা নির্যাতন করছেন। এই ব্যাপারে সূত্র জানায়, এটি সম্পূর্ণ বানানো কথা। কারণ তারেক রহমানকে আটক করার পর গোপন জায়গাতে নিয়ে যাওয়া হয়। কোথায় নেয়া হয়েছে এটাও জানতে দেয়া হয়নি মাসুদকে। যারা তাকে ধরে নিয়ে নির্যাতন করেছেন তারা জানেন যে, তাকে কোথায় রাখা হয়েছে এই খবর জানতে পারলে তিনি তারেক রহমানকে নিয়ে যাবেন। ছেড়ে দেবেন। এই কারণে তাকে গোপনে রাখা হয়। নির্যাতন করা হয়। তার ওপর প্রতিশোধ নেন কয়েকজন কর্মকর্তা।

বেগম খালেদা জিয়াকে দুর্বল করে তাকে বিদেশে যেতে রাজি করতে তারেক রহমানকে মামলায় হাজির করার নামে গণমাধ্যমের সামনে আনা হয়। ওই সময়ে টিভিতে ছবি দেখে জেনারেল মাসুদ বুঝে যান তাকে নির্যাতন করা হয়েছে। তিনি সোর্স লাগান। তাকে কাথায় রাখা হয়েছে এবং কারা নির্যাতন করছে ওই সব অফিসারের নাম সংগ্রহ করেন। এরপর প্রধান ব্যক্তিকে ডেকে পাঠিয়ে তাদের সতর্ক করে দেন তারেক রহমানের ওপর আর একটু নির্যাতন করা হলে সহ্য করা হবে না। কিন্তু তিনি তখনও জানেন না তারেক রহমানের কাছে তার নাম করে তার নির্দেশেই তাকে মারা হচ্ছে বলে খবর বলা হয়েছে। তার কণ্ঠও পরিবর্তন করে তা শোনানো হয়েছে। কিন্তু এই ঘটনা খালেদা জিয়ার কাছে পৌঁছে যায়। এরপর তিনি তারেক রহমানের নির্যাতন বন্ধ করানোর জন্য উদ্যোগ নেন। সেনাপ্রধানকে বলেন, আপনি তারেক রহমানের ওপর নির্যাতন বন্ধ করান। না হলে কিন্তু খুব খারাপ হবে। সে একজন সেনাপ্রধানের ছেলে, তার ওপর এইভাবে নির্যাতন করার অধিকার আপনাদের নেই। যারা করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন।

জেনারেল মাসুদ যখন গুরুতর অপরাধ দমন সমন্বয় কমিটির প্রধান সমন্বয়কারী তখন খবর বের হয় তিনি টাকার খনি হয়ে উঠেছেন। নানা সমালোচনাও তৈরি হয়। সূত্র জানায়, তখনও অনেকেই জানেন না জেনারেল মাসুদের নামে লোটাস কামালের ভাইয়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে এসেছেন। তিনি ওই টাকার কথা জানার পর ওই ব্যক্তিকে ডেকে পাঠান। এরপর টাকা ফেরত দেয়ার ব্যবস্থা করেন। ওই সময়ে দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে এক হাজার দুইশ কোটি টাকা অনিয়ম করে নেয়া হয়েছে। জোরপূর্বক ও ভয়ভীতি দেখিয়ে তা নিয়ে বাংলাদেশে ব্যাংকের একটি বিশেষ শাখায় জমা করানো হয়েছে। ব্যবসায়ীরা অনেক কষ্ট করে নির্যাতন সহ্য করে টাকা দিয়েছিলেন। ওই টাকা নেয়ার জন্য একজন বিশেষ কর্মকর্তার নেতৃত্বে একটি টিম কাজ করে। ওই টিমই বিভিন্ন ব্যবসায়ীর সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের টাকা দিতে বলেন। ওই সময়ে টাকা কোন খাতে কোন নামে নেয়া হবে এ নিয়ে সমস্যা দেখা দিলে এর দায়ও জেনারেল মাসুদের গুরুতর অপরাধ দমন জাতীয় সমন্বয় কমিটির ওপর চাপানোর চেষ্টা করে এর নাম ব্যবহার করা হয়। অফিসিয়ালি টাকা নেয়া হয়নি। গুরুতর অপরাধ দমন সমন্বয় কমিটি অফিসিয়াল ছিল। কিন্তু তাতে মাসদু রাজি হননি।

তার যুক্তি ছিল ওইভাবে টাকা নেয়া অন্যায়। এটা হয় না। এই জন্য তিনি জেনারেল মইনকে ওইভাবে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা নেয়া বন্ধ করার জন্য বলেন। তিনি তার কমিটির নামে কোনো টাকা নেবেন না বলেও জানিয়ে দেন। এরপর চিঠিও ইস্যু করা হয়। পরে গুরুতর অপরাধ দমন জাতীয় সমন্বয় কমিটির নামে আর টাকা জমা করানো সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশে ব্যাংকের হিসাবে টাকা জমা করা হয়।

একজন ব্যবসায়ী বলেন, ওই সময়ে যেভাবে টাকা নেয়া হয়েছে তা অমানবিক। আমরা টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য চেষ্টা করলে এখনও পাইনি।

এছাড়াও ওয়ান-ইলেভেনের সময়ে একটি অংশ চেষ্টা করে নিজেরাই একটি রাজনৈতিক দল করে তাদের নিজেদের লোককে ক্ষমতায় বসানোর। ওই দল গঠনের ব্যাপারেও তিনি বিরোধিতা করেন। ওই সময়ে জেনারেল মাসুদের মত ছিল— কোনোভাবেই সেনাবাহিনীর কেউ ক্ষমতায় যেতে পারবে না। সেটা যেতে দেয়া হবে না। ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে হবে গণতান্ত্রিক সরকারের হাতে। এই জন্য যথাসময়ে নির্বাচন করানোর জন্য। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টার অফিসে বৈঠক করেই ওই সময়ের তিন মাসের সরকারকে দুই বছরের সরকার করে ফেলা হয়।

তবে কেউ কেউ বলেন, জেনারেল মাসুদ যেমনটি চেয়েছিলেন তেমনটি না হওয়ার কারণে ও তার স্বপ্ন পূরণ না হওয়ার কারণে তিনি হতাশ ছিলেন। এই কারণে তিনি ওই সরকারের সব কাজের বিরোধিতা করেন। আরও অনেক বিষয়েই তাদের সঙ্গে তার দূরত্ব তৈরি হয়। আর এই দূরত্বের কারণে ওয়ান-ইলেভেনের সময়ে যে কোর কমিটি করা হয়েছিল ছয় সদস্য বিশিষ্ট, ওই কমিটিতে মূলত কাজ করেন মাত্র ২ জন। বাকিরা বাদ পড়ে যান। বাদ পড়া দলে জেনারেল মাসুদও ছিলেন। সূত্র জানায়, তাদের মধ্যে বিরোধের কারণেই ওয়ান-ইলেভেনের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়ে যায়। পরে পরিস্থিতি সামাল দিতে লাইনচ্যুত ট্রেনকে লাইনে তোলার দায়িত্ব নেন জেনারেল মইন। শেষ পর্যন্ত তিনি সফলভাবে একটি গণতান্ত্রিক সরকারের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে সক্ষম হন। অনেকেই ওই সময়ে জেনারেল মইনের নাম ব্যবহার করেও অনেক কাজ করেছেন। যেগুলো জেনারেল মইন জানতেন না।

এদিকে কেউ কেউ বলার চেষ্টা করছেন, জেনারেল মাসুদকে আবারও সেনাবাহিনীতে ফেরত আনা হতে পারে। চুক্তিভিত্তিক শীর্ষ পদে নিয়োগ দেয়া হতে পারে। এই ব্যাপারে জেনারেল মুস্তাফিজুর রহমানকে ফিরিয়ে আনার উদাহরণও টানার চেষ্টা করেন কেউ কেউ। এই ব্যাপারে সূত্র জানায়, জেনারেল মুস্তাফিজুর রহমানকে অবসরে পাঠানোর পর তিনি এলপিআরে ছিলেন। এলপিআরে থাকা অবস্থায় তাকে শেখ হাসিনা ফিরিয়ে আনেন। জেনারেল করেন এবং সেনাপ্রধান করেন। কিন্তু জেনারেল মাসুদের বেলায় সেটি সম্ভব হবে না। কারণ তিনি সেনাবাহিনী থেকে অবসরে গেছেন। এখন আর এলপিআরেও নেই। এলপিআরে থাকলে কোনো কর্মকর্তাকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। কিন্তু তিনি এলপিআরে নেই। এই কারণে তাকে আর ফেরানো সম্ভব নয়। তিনি অস্ট্রেলিয়ার হাইকমিশনার হিসেবে শেষ যখন আরও এক বছরের এক্সটেনশন পান তখন তাকে এলপিআরে থাকার বিষয়টি সারেন্ডার করে দিতে হয়েছে।

সরকারি চাকরিতে ফিরিয়ে আনার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিয়ে জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী বলেন, এগুলো সব গুজব। এর কোনো ভিত্তি নেই। সেনাবাহিনীতে একবার কেউ অবসরে চলে গেলে তাকে ফিরিয়ে আনা যায় না।

শেয়ার করুন