আসন্ন দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রায় একশ আসনে বিকল্প প্রার্থী খুঁজছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এসব আসনে নবম সংসদ নির্বাচনে যারা জয়লাভ করেছিলেন তাদের বাদ দিয়ে এবার নতুন প্রার্থী দেয়া হবে। এ লক্ষ্যে গত বুধবার থেকে সম্ভাব্য প্রার্থীদের জনপ্রিয়তা যাচাইবাছাইয়ে ষষ্ঠবারের মতো তৃণমূল পর্যায়ে জরিপ শুরু হয়েছে।
গত ১৮ আগস্ট অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেছেন, আগামীতে কমপক্ষে ৭০ থেকে ৮০ জন এমপি-মন্ত্রী দলীয় মনোনয়ন পাবেন না। জরিপ চলছে। তৃণমূলের মতামতের ভিত্তিতে মনোনয়ন দেয়া হবে। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন এমন একাধিক সূত্র তথ্যটি নিশ্চিত করেছেন।
দলের হাইকমান্ড সূত্রে জানা গেছে, মন্ত্রী এবং এমপিদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা গত প্রায় পাঁচ বছরে নিজ নিজ এলাকায় নানা কারণে বিতর্কিত হয়ে পড়েছেন। এ ধরনের বিতর্কিত মন্ত্রী এমপিদের নির্বাচনী এলাকার সংখ্যা প্রায় একশ। এদের মধ্যে ৭০ থেকে ৮০ জন সম্পর্কে খোদ প্রধানমন্ত্রীর নেতিবাচক ধারণা পেয়েছেন। এছাড়া আরও ১৫ থেকে ২০ জন আছেন যাদের অবস্থাও খুবই খারাপ। এইসব মিলে একশ আসনে বিকল্প প্রার্থীর সন্ধান চলছে। বর্তমান মন্ত্রী, এমপি এবং আগামী নির্বাচনে সম্ভাব্য প্রার্থীদের জনপ্রিয়তা যাচাইরের জন্য সারা দেশের তিনশ আসনের ওপরই জরিপ চালানো হচ্ছে। তবে এই বিতর্কিত একশ আসনের ওপর বিশেষভাবে জরিপ চালানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। এই আসনগুলোতে বর্তমানে যারা সংসদ সদস্য আছেন আগামীতে তাদের মনোনয়ন না দেয়ার সম্ভাবনাই বেশি বলে সরকারের নীতিনির্ধারণী সূত্রে জানা গেছে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নূহ-উল আলম লেনিন বলেন, এমপিদের কর্মকাণ্ডের মূল্যায়ন নিয়ে দলের জরিপ চলছে। আওয়ামী লীগ সব সময় তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মতামতের গুরুত্ব দেয়। আশা করি, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এমপিদের কর্মকাণ্ডের মূল্যায়ন করে দলীয় মনোনয়ন দেয়া হবে। তখন বেশ কিছু আসনে পরিবর্তন আসবে।
সূত্রটি জানায়, দলের কার্যনির্বাহী বৈঠকে আসন্ন নির্বাচনে এমপিদের মনোনয়ন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। এই বৈঠকের আগেই দলের মন্ত্রী-এমপিদের কর্মকাণ্ডের ওপর ভিত্তি করে তৃণমূল থেকে পাঠানো একাধিক মূল্যায়ন রিপোর্ট সরকারের নীতিনির্ধারকদের হাতে পৌঁছায়। এসব রিপোর্টের ভিত্তিতেই বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। জানা গেছে, এ যাবত্ মোট পাঁচ দফায় দলীয় মন্ত্রী এবং এমপিদের কাজের ওপর জরিপ চালানো হয়। সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য এবং জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমেও জরিপগুলো চালানো হয়। আগের চারটি জরিপের ফল খুব ভালো এসেছিল। সেই জরিপ রিপোর্টগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জরিপে অংশগ্রহণকারীদের বরাত দিয়ে সুপারিশ করেছেন, সরকার যদি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকর করতে পারে তবে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের আবারও ভালো করার সম্ভাবনা আছে। একটি বিদেশি সংস্থার জরিপেও বলা হয়েছে, সরকার তার উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের প্রচার ভালোভাবে চালাতে পারলে আওয়ামী লীগের সম্ভাবনা আরও উজ্জ্বল হবে। এসব জরিপের ভিত্তিতেই প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন, আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসবে।
তবে সর্বশেষ জরিপের যে রিপোর্ট সরকারের হাতে পৌঁছেছে তাতে ফল খুব ভালো আসেনি। সর্বশেষ রিপোর্ট ভালো না আসায় আগামী নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে আরও বেশি সাবধান হওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এ সময় বলা হয় তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকদের মনোভাব একই সঙ্গে সাধারণ ভোটারের আকাঙ্ক্ষার দিকে নজর দিতে হবে। তৃণমূলের কর্মী-সমর্থক এবং ভোটারদের মূল্যায়ন করা না হলে নির্বাচনের ফল আশানুরূপ না হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ কারণে দলের বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গত বুধবার থেকে সর্বশেষ জরিপ শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে।
কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে উপস্থিত একাধিক সূত্র জানায়, বিতর্কিত হয়ে পড়া মন্ত্রী-এমপিদের বেশিরভাগের নামেই বিস্তর অভিযোগ রয়েছে দলের হাইকমান্ডের কাছে। ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, অর্থের লোভে আত্মীয়স্বজন আর নিজেদের পছন্দের লোকদের সরকারি সুযোগ-সুবিধা দিয়ে দলের কোমর ভেঙে দিয়েছেন অনেকে। দিনের পর দিন এলাকায় আসেননি। এলাকার লোকজন বা নেতাকর্মীরা ঢাকায় এসে এমপির সঙ্গে দেখা পর্যন্ত করতে পারেননি। আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে এলাকার কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছেন। এসব কারণে তাদের সঙ্গে বিরোধ তৈরি হয়েছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের। ক্ষমতার গরমে রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়া এসব নেতাকে ভালো চোখে দেখছেন না ওইসব আসনের ভোটাররাও। এধরনের প্রার্থীদের বিষয়গুলো মাথায় রেখেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের এমপিদের জনপ্রিয়তা যাচাই ও বিতর্কিতদের বিকল্প জনপ্রিয় প্রার্থী কে হতে পারেন— এ নিয়ে সর্বশেষ জরিপের কাজ শুরু হয়েছে। গত রবিবার সরকারের একটি বিশেষ সংস্থার আট সদস্যের একটি দল নরসিংদী জেলার দুটি আসনে এ জরিপ কাজ শুরু করেছে। নরসিংদীর শিবপুর ও রায়পুরা উপজেলায় জরিপের কাজ শেষ হয়েছে। নরসিংদীর পর জরিপ পরিচালনাকারী দলটির নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে যাওয়ার কথা রয়েছে। এরপর পর্যায়ক্রমে সারাদেশের তিনশ আসনেই জরিপ চালানো হবে। এটাই শেষ জরিপ। আগামী মনোনয়নে এই জরিপ বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া হবে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এবার ১০০টি আসনে বিকল্প প্রার্থী খোঁজার কাজ করছেন তারা। বিতর্কিত এমপিদের আসনকে প্রাধান্য দিয়ে এ জরিপ চালানো হচ্ছে। তৃণমূল কর্মী ও তরুণদের সাক্ষাত্কার গ্রহণ করে যোগ্য প্রার্থীর নাম সুপারিশ করবেন তারা। এদিকে সব জরিপে বিতর্কিত হিসেবে যাদের নাম উঠে এসেছে, তাদের সংখ্যা একশরও বেশি। এসব আসনে বর্তমান এমপির বিকল্প প্রার্থী কে হতে পারেন তা যাচাই করা হচ্ছে। সংস্থার পাশাপাশি দলীয় কয়েকটি টিমও এজন্য কাজ করছে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ এ বিষয় গতকাল দৈনিক বর্তমানকে বলেন, আগামী নির্বাচনে এমপি মনোনয়নে কিছু পরিবর্তন আসবে এটা সত্যি। তবে বিষয়টি আমাদের দলীয় সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং পালামেন্টারি বোর্ড বসে নির্ধারণ করবে। ইতিমধ্যে দলের পক্ষ থেকে আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন পেতে আগ্রহী ব্যক্তিদের সম্পর্কে মতামত নেয়া শুরু হয়েছে বলেও জানান তিনি।