সম্প্রতি অনুষ্ঠিত দেশের ৫টা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বি,এন,পি নেতৃত্বাধীন ১৮-দলীয় জোটের সমর্থিত প্রার্থীদের কাছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোট তথা সরকার সমর্থিত প্রার্থীদের শোচনীয় পরাজয় বিরোধী শিবিরকে আপাতত চাঙ্গা করলেও সামনের জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে নিয়ে অনিশ্চয়তা ও আশংকাও বৃদ্ধি পেয়েছে। রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফলের ধারাবাহিকতায় মাত্র ৩ সপ্তাহের ব্যবধানে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও একই রকম ফলাফল হওয়ায় আর কয়েক মাস পর জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও এমন ফলাফল তথা সরকারের ভরাডুবি হতে পারে বলে সরকার যে আশংকা ও উৎকন্ঠায় পড়েছে তা অবশ্যই দেশবাসীর কাছে বোধগম্য। সরকার হয়ত ভাবছে ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় প্রশাসনসহ নির্বাচনের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল উপাদান সরকারের অনুকূলে ও নিয়ন্ত্রণে থাকা সত্ত্বেও যখন নির্বাচনের ফলাফল সরকারের পক্ষে যায় নাই তখন জাতীয় সংসদ নির্বাচন যদি বিরোধী জোটের দাবী মেনে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ ( তত্ত্বাবধায়ক ) সরকার ব্যবস্থার অধীনে অনুষ্ঠিত হয় তবে আওয়ামী জোটের জন্য নির্বাচনী ফলাফল আরো খারাপ হবে। এ আশংকা থেকেই ৫টা সিটি করপোরেশনের ফলাফলের পর সরকার প্রধান থেকে শুরু করে সরকারের মন্ত্রী ও শরীক দলের নেতারা বেশ জোরালোভাবে একই সুরে বলছে- সিটি করপোরেশনের নির্বাচনগুলো প্রমাণ করেছে যে এ সরকারের অধীনে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়। অতএব, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনও এ সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু হবে। কাজেই নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থার আর কোন প্রয়োজন নাই। বিরোধী জোটের দাবীকে সরকার পক্ষ এখন অসাড় ও অযৌক্তিক বলেই প্রচারণা চালাচ্ছে। বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী দলীয় সরকারের অধীনেই আগামী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে সরকার প্রধান শেখ হাসিনা দেশে ও বিদেশে বেশ দৃঢ়তার সাথে বলে বেড়াচ্ছেন।
উল্লেখ্য, সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের পর একটা গ্রহণযোগ্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য তথা দেশকে আরো সহিংসতা ও সংঘাত থেকে মুক্ত করার স্বার্থে বিরোধী জোটের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবীর ব্যাপারে সরকার নমনীয় ও সহনশীল হবে বলেই দেশবাসী প্রত্যাশা করেছিল। কিন্তু সরকার এ ব্যাপারে আরো অনমনীয় ও কঠোর অবস্থান নিয়েছে। সরকারের এ অবস্থান ও মনোভাবের ফলে এ কথাই স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দিলে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফল সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফলের চেয়েও সরকারের বা সরকারী দলের জন্য আরো খারাপ ফল বয়ে আনতে পারে বলে সরকার চরম উৎকন্ঠা ও আশংকার মধ্যে পড়েছে। যে কারণে সরকার বলছে বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী দলীয় সরকারের অধীনেই আগামী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
সরকারের এ অবস্থানের দুটো কারণ আছে, একটা হলো বিরোধী জোটের নির্দলীয় সরকারের দাবী মানা না হলে বা এ ব্যাপারে কোন সমঝোতা না হলে বিরোধী জোট বিশেষ করে প্রধান বিরোধী দল বি,এন,পি নির্বাচনে অংশ নিবেনা। সরকার তখন এরশাদের জাতীয় পার্টি এবং অন্যান্য কিছু দলকে ( মূল দলের বিদ্রোহী অংশকে নিয়ে ) দিয়ে নতুন নতুন জোট তৈরী এমনকি জামায়াতের সাথেও আঁতাত করে জামায়াতকে বি,এন,পি জোট থেকে বের করে নির্বাচনে অংশ গ্রহণের কৌশল অবলম্বন করতে পারে। এমন অপচেষ্টা অতীতে অন্যান্য সরকারও করেছিল, কিন্তু কেউ শেষ পর্যন্ত সফল হতে বা টিকে থাকতে পারেনি।
সরকারের এ অবস্থানের আর একটা কারণ হলো যদি বিরোধী জোট সরকার দলীয় ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ না নেয় তবে বর্তমান সরকার জাতীয় নির্বাচন নির্ধারিত সময়ে না দিয়ে ১/১১ এর কথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মত ক্ষমতায় থাকার মেয়াদ বৃদ্ধি করার ব্যবস্থা করতে পারে, এ ব্যাপারে তারা বর্তমান সংশোধিত সংবিধানের ফাঁক-ফোকর খুজে তাকে কাজে লাগাতে পারে বা তাদের দলীয় রাষ্ট্রপতিকে ব্যবহার করে অনির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা চালাতে পারে। সুরঞ্জিত সেনসহ আরো অনেক নেতা এ ধরনের কূট কৌশলের কথা প্রকাশ্যে বলছেন এবং সেভাবে শেখ হাসিনাকে হয়ত পরামর্শও দিচ্ছেন।
অপরদিকে সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলোতে অসাধারণভাবে ভাল ফলাফল হওয়ায় বিরোধী জোটও মানষিক ও সাংগঠনিকভাবে এখন শক্তিশালী অবস্থানে আছে, যার ফলে জাতীয় সংসদ নির্বাচন নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের দাবীও এখন আরো জোরালো হয়ে উঠেছে। বর্তমান সরকার বা দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচেনে তারা কোন অবস্থাতেই অংশ নিবেনা বলে আরো দৃঢ়ভাবে ও জোরালো কন্ঠে উচ্চারণ করছে। বিরোধী দল বলছে রোজার পর তাদের দাবী আদায়ের জন্য সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর আন্দোলন শুরু করবে। সরকার ও বিরোধী দলের এমন পরস্পর বিরোধী কঠোর অবস্থান আগামী দিনগুলোতে দেশকে আরো ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে ঠেলে দিতে পারে।
দেশের মানুষ মনে করেছিল সিটি করপোরেশনগুলোর ফলাফল দেখে সরকারের বোধদয় হবে এবং বিরোধী দলের সাথে আলাপ-আলোচনা ও সমঝোতা করতে উদ্যোগী হবে। কিন্তু অবস্থা দেখে মনে হয় সরকার সমঝোতার পথে হাটার চেয়ে সংঘাতের পথেই দেশকে ঠেলে দিতে চাচ্ছে। একটা নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন দিতে সরকারের সমস্যা বা অসুবিধা কোথায় বা কেন ? নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারতো আর বি,এন,পি’র দলীয় সরকার নয় যে নির্বাচেনে তারা আওয়ামী লীগের সব ভোট ছিনিয়ে নিবে ? এটা উভয় দলের জন্যই নির্বাচনে একটা নিরপেক্ষ রেফারী হিসেবে কাজ করবে, কাজেই বি,এন,পি’র এ দাবী মেনে নিতে সরকারের ভয় কিসের ? জনগণের উপর আস্থা থাকলে জনগণ যাকে ভোট দিবে সেই জয় লাভ করবে। এক দলের আর এক দলের উপর আস্থা নাই বলেইতো ১৯৯৬ সালে এ ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছিল, ২০১৩ সালে এসেও আস্থার জায়গায় কোন উন্নতি হয়নি, তাইতো তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা বহাল আছে। উল্লেখ্য, যেটা রাজনৈতিক বিষয় এবং যেটা রাজনীতিবিদরাই সমাধান দিবেন সে বিষয় আদালতে টেনে আনা যেমন ঠিক নয় আদালতেরও এমন রাজনৈতিক (স্পর্সকাতর) বিষয় উপেক্ষা করাই দেশ ও জাতির স্বার্থে শ্রেয়।
সরকার বলছে আদালতের রায়ের ভিত্তিতেই তারা তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে সংবিধান সংশোধন করেছে, সুতরাং তাদের সংবিধানের বাইরে যাওয়ার কোন সুযোগ নাই। প্রশ্ন হচ্ছে: একটা দেশের জনগণ বড় নাকি সংবিধান বড় ? সংবিধান দেশের জনগনই তথা মানুষেই তৈরী করেছে, এটা ৪র্থ আসমান থেকে ‘অহি’ বা আল্লার কিতাব নয়, যে এটাকে পরিবর্তন করা যাবেনা। এ দেশের শাসক ও জনপ্রতিনিধিরাই বর্তমান সংবিধানকে জনগণের তথা নিজেদের প্রয়োজনে ১৪/১৫ বার কাট-ছাট করে সংশোধন করেছে। দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে, দেশকে সহিংসতা ও নৈরাজ্য থেকে রক্ষা করার স্বার্থে, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটা নির্বাচন করার স্বার্থে প্রয়োজনে আবারও সংবিধান সংশোধন করা কোন পাপ বা কবিরা গুনা হবেনা। ১৯৯৬ সালের নির্বানের আগে আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য দলের তীব্র আন্দোলনের মুখে তৎকালীন বি,এন,পি সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা মেনে নিয়ে তাকে সংবিধানে সংযোজন করেছিল। রাজনৈতিক সমঝোতা বা ঐক্যমতের পরেই সংধিানে তা সংযোজন করা হয়েছিল। এখনও রাজনৈতিক সমঝোতার পর সংসদে বিল পাশ করে তা আবার সংবিধানে সংযোজিত করলেই হয়।
যদি ধরে নেওয়া হয় বর্তমান সরকারের অধীনেই বি,এন,পি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে গেল এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করল। ৫ বছর পর বি,এন,পি সরকারের অধীনে পরবর্তি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কি অংশ গ্রহণ করবে (যদি মাগুড়ার মত কোন ঘটনা না হয় ) ? আওয়ামী লীগ কি এখন এ অংগীকার লিখিতভাবে করবে ? যদি আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ হেরে যায় তবে কখনও সংসদ বর্জন করবেনা, হরতাল, জ্বালাও-পোড়াও করে রাজপথে সহিংস আন্দোলন করবেনা, সরকারকে ৫ বছর শান্তিপূর্নভাবে দেশ চালাতে সহযোগিতা করবে, প্রয়োজনে শুধু সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা ও গণতান্ত্রিকভাবে প্রতিবাদ করবে – এ অংগীকার কি আওয়ামী লীগ এখন করবে ?
শুধু ক্ষমতায় থাকার উদ্দেশ্যে স্বীয় স্বার্থ বিবেচনা করে কেবল নির্বাচনের ক্ষেত্রে ওয়েস্ট মিনিস্টার বা পাশ্চাত্যের নির্বাচনের অনুকরনে বাংলাদেশেও নির্বাচন হবে – একথা উচ্চারণে করতে আমাদের দেশের ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদদের লজ্জাও হয়না। একবারও তারা উপলব্ধি ক তে চায়না- যে আমরা কি অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের মত বিগত ৪২ বছরে প্রকৃত অর্থে গণতান্ত্রিক হতে পেরেছি ? কথিত ’৯০ এর গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পর “গণতন্ত্র” ছিনিয়ে এনে বিগত ২৩ বছরে কি দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে বা গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পেরেছি ? বরং গণতন্ত্রকে সহিংসতা ও সন্ত্রাসে পরিনত করেছি, কথিত গণতান্ত্রিক যুগের প্রতিটি নির্বাচনের সময়েই দেশে রাজনৈতিক হানা-হানি ও সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠেছে। আমরা এমন গণতন্ত্রই প্রতিষ্ঠা করেছি যে একটা নির্বাচনও আমরা শান্তিপূর্নভাবে সম্পন্ন করতে পারিনা। গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান উপাদান হলো পরমত সহিষ্ণুতা। উন্নত গণতান্ত্রিক দেশের জনগণ বা রাজনীতিবিদদের মত আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের মধ্যে কি একই গণতান্ত্রিক মানষিকতা আছে ? আমাদের দেশে বিরোধী বা নিরপেক্ষ মতকে যেভাবে কটাক্ষ ও সমালোচনা করে উপেক্ষা করা হয় এবং বিরোধী দলকে দমন ও পীড়ন করা হয় পৃথিবীর অন্য কোন গণতান্ত্রিক দেশে কি সেভাবে করা হয় ? আমাদের দেশে বিরোধী দল যেভাবে গণতান্ত্রিক অধিকারের নামে সহিংসতা করে এবং আপরদিকে সরকারও যেভাবে বিরোধী দলীয় নেতাদের রাজপথে চোরের মত পিটায়, গুলি করে মারে, মামলার পর মামলা, রিমান্ডে নিয়ে অমানুষিক অত্যাচার এমনকি রাজনৈতিক নেতাদের চোর-ডাকাতের মত ডান্ডা-বেরী পড়িয়ে রাখা হয়, পৃথিবীর অন্য কোন গণতান্ত্রিক বা সভ্য দেশে কি তা হয় ? আমাদের দেশে তথাকথিত সংসদীয় গণতন্ত্রের আবরনে যেখানে এক ব্যক্তি স্বৈরাচারের মত ক্ষমতা প্রয়োগ করে অন্য কোন গণতান্ত্রিক দেশে কি তা আছে ? আমাদের দেশে লাগাতার সংসদ বর্জনের যে সংস্কৃতির চর্চা চলছে অন্য কোন গণতান্ত্রিক দেশে কি তা আছে ? অন্যান্য দেশের সংসদে যে কোন বিষয়কে কেন্দ্র করে উত্তেজনা বা মারামারিও হয়, কিন্তু সেসব দেশে আমাদের দেশের সংসদের মত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে নিয়ে কুৎসিত মন্তব্য, অসভ্য ও অশ্লীল ভাষায় গালাগালি ও মারামারির উপক্রম হয়না, ঐসব দেশের রাজনীতিবিদরা দাবী আদায়ের বা সরকারের বিরোধিতার জন্য রাজপথে সাধারণ মানুষকে কষ্ট দিয়ে এমন সহিংস আন্দোলন করেনা। আমাদের দেশের ক্ষমতাসীন দল পরবর্তি মেয়াদে আবারও ক্ষমতায় আসার উদ্দেশ্যে নির্বাচন কমিশনসহ নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কেন্দ্র থেকে মাঠ পর্যায় পর্যন্ত প্রশাসনের সর্বস্তরে যেভাবে দলীয় আনুগত্যের লোকজনকে বসিয়ে দলীয়করনের নজীর স্থাপন করে পৃথিবীর অন্য কোন গণতান্ত্রিক দেশে কি এমনটি হয় ? আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় যাওয়ার পর বিচারালয়সহ সব কয়টা সাংধিানিক ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে দলীয়করন করে যেভাবে কলুষিত ও ধ্বংশ করে পৃথিবীর অন্য কোন গনতান্ত্রিক দেশে কি তা করা হয় ? আমাদের দেশে নির্বাচনের আগে কোটি কোটি টাকার মনোনয়ন বানিজ্য (Horse Trading) হয়, ভোটের আগে টাকা-পয়সা দিয়ে ভোটার কেনা যায়, পৃথিবীর অন্য কোন গণতান্ত্রিক দেশে কি তা হয় ? এমন আরো অনেক বিষয় ও ক্ষেত্র আছে যা অন্যান্য গনতান্ত্রিক দেশে বিদ্যমান, কিন্তু আমাদের দেশে অনুপস্থিত। কাজেই কেবল স্বীয় রাজনৈতিক স্বার্থে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের উদ্দেশ্যে পৃথিবীর অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের নির্বাচনের উদাহরন বা তুলনা দেওয়া কি আমাদের দেশের রাজনীতিবিদ বা ক্ষমতাসীন সরকারের বেলায় শোভা পায় ? অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের মত গণতন্ত্রের মূল ও প্রতিটি বিষয় যদি আমরা অনুসরন করতাম তবে নির্বাচনের ব্যাপারেও অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের ব্যবস্থা বা পদ্ধতিকে অনুসরণ করা বা তুলনা দেওয়া যথার্থ ও যৌক্তিক বলে বিবেচনা করা যেত।
আমাদের মত বিতর্কিত ও বিকৃত গণতান্ত্রিক দেশে একটা সুষ্ঠু, ১০০% অবাধ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার তত্ত্বাবধায়ক বা নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থাকে যারা অগণতান্ত্রিক ও পিছিয়ে থাকার মানষিকতা হিসেবে বুঝাতে চাচ্ছেন, তারা অপরদিকে সমস্ত প্রশাসন যন্ত্রকে প্রভাবিত করে ১০০% কারচুপি করার সম্ভাবনা ও সুযোগ সম্বলিত ক্ষমতাসীন দলের অধীনে দেশে বিদেশে সবার কাছে অগ্রহণযোগ্য একটা নির্বাচন করাকে গণতান্ত্রিক ও সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার চাবিকাঠি বলে মনে করছেন। অথচ পৃথিবীর অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের মত আমাদের দেশের গণতন্ত্রকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য গণতান্ত্রিক চর্চায় ও মানষিকতায় আমাদের যে ঘাটতি রয়েছে সবার আগে সেখান থেকে বের হয়ে আসার কোন ফরমূলা উনারা তাদের সমর্থিত সরকারকে দেননা। শুধু দলীয় সরকারের অধীনে একটা নির্বাচন করলেই কি আমরা তাদের ভাষায় সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রায় এগিয়ে যাব ? ২৩ বছর যাবততো দেশের মানুষ নির্বাচন দেখছে, কিন্তু প্রকৃত গণতন্ত্র কি দেখতে পাচ্ছে ?
সরকারী মহল ও তাদের সমর্থকেরা প্রায়ই এ কথাও বলে যাচ্ছেন এ সরকারের আমলে প্রায় ৬০০০ এর মত স্থানীয় ও কয়েকটা উপ-নির্বাচন হয়েছে, কোথাও কোন কারচুপি বা সরকারী হস্তক্ষেপ হয়নি। স্থানীয় ও উপ নির্বাচন আর জাতীয় নির্বাচনের অবস্থা এক নয়। এসব নির্বাচনে জয় পরাজয় সরকার বা বিরোধী দলের কোন মাথা ব্যাথার কারণ নয়। এ কারণে এসব নির্বাচনে সরকারের তেমন হস্তক্ষেপ করা বা কারচুপি করার প্রবনতা কম থাকে। বর্তমান ৫ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনই তার প্রমান, এমন ফলাফলের পরেও সরকারের ক্ষমতা ছাড়ার কোন সুযোগ বা আশংকা নাই। কিন্তু জাতীয় নির্বাচন বা ৩০০ আসনের সংসদ নির্বাচন সরকার ও বিরোধী দলের কাছে সবচেয়ে বেশী গৃরুত্বপূর্ন। কারণ এ নির্বাচনে সরকার বা ক্ষমতার পরিবর্তন হয়, দেশ চালানোর জন্য সরকার পরিবর্তন হয়, ক্ষমতার মসনদ দখল করার সুযোগ হয়। এ কারণে জাতীয় নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার ও কারচুপি করার সম্ভাবনা বা আশংকাও বেশী থাকে। একসাথে একই দিনে সারাদেশে একই সময়ে ৩০০ আসনে নির্বাচন হয় বলে প্রতিটা আসনে, প্রতিটা ভোট কেন্দ্রে পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা যেমন কঠিন, তেমনি দেশের সব কয়টা টিভি চ্যানেল, পত্রিকা সাংবাদিক ও নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের পক্ষেও একই দিনে ব কয়টা আসনের খবর সংগ্রহ ও নজরদারী বা তদারকি করা সম্ভব নয় (পর্যাপ্ত লোকবলের ও সাজ-সরঞ্জামের অভাবে)। ক্ষুদ্র পরিসরে স্বল্প সংখ্যক আসনে কেবল সেটা সম্ভব।
আমাদের দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে পারষ্পরিক অবিশ্বাস ও অনাস্থার জন্ম নিয়েছে, অগণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চর্চার যে প্রসার ঘটেছে, দলীয়করন ও দূর্বৃত্তায়নের যে ন্যাক্কারজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ছলে বলে কৌশলে (পুনরায়) ক্ষমতায় যাওয়ার যে মানষিকতা,েএ অবস্থায় একটা দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন কি বিরোধী দল মেনে নিবে ? ২০০৭ এর ২২ জানুয়ারী’র নির্বাচনের সময় বি,এন,পি ক্ষমতায় ছিলনা, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা যার (বিচারপতি কে,এম,হাসান) হওয়ার কথা ছিল তার কোন এক কালে বি,এন,পি’র সাথে সংশ্লিষ্টতার কথিত অভিযোগে তাকে প্র্রধান উপদেষ্টা মেনে নিবেনা বলে আওয়ামী জোট তাকে মেনে নেয়নি এবং তার প্রতিবাদে ব্যাপক হিংসাত্মক আন্দোলন শুরু করেছিল। আর এখন ২০১৪ সালের নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়কের পরিবর্তে শেখ হাসিনাকে সরকার প্রধান রেখে ক্ষমতাসীন আওয়ামী জোটের একটা নিরংকুশ দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে সে নির্বাচনে বিরোধী দল অংশগ্রহণ করবে বা নির্বাচনকে মেনে নিবে এটা প্রত্যাশা করা কি অস্বাভাবিক ও দিবাস্বপ্ন নয় ?
আমাদের দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে এবং নজীরবিহীন গণতান্ত্রিক পরিবেশে সবার অংশগ্রহণের ভিত্তিতে একটা সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার জন্য একটা নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থার বিকল্প এখনো চিন্তা করার সময় আসেনি (যতক্ষন পর্যন্ত আমরা বিশেষ করে রাজনীতিবিদরা মন-মানষিকতায়, চিন্তা-চেতনায় এবং আচার-আচরনে অন্যান্য উন্নত গণতান্ত্রিক দেশের জনগণের সমতুল্য হতে না পারব)।
তাই আগামী সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে দেশের চলমান সংকটকে কার্যকরভাবে সমাধান করতে হলে আলোচনা বা সংলাপের মাধ্যমে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থার ব্যাপারে একটা সমঝোতা বা ঐক্যমতে পৌছানো ছাড়া আর কোন পথ খোলা আছে বলে মনে হয়না। একগুয়েমী বা একতরফা সিদ্ধান্ত কখনও সবার তথা দেশের জন্য সুফল বয়ে আনবেনা। বিশেষ করে ৫ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফলের প্রেক্ষিতে বিরোধী দলের অবস্থান ও বাস্তবতাকে আমলে নিয়ে সরকারকে একগুয়েমী বা স্বার্থান্বেষী মহলের কুপরামর্শকে পরিহার করতে হবে। সরকারের অন্ধ দাম্ভিকতা, উগ্রতা ও বাস্তবতাকে উপলব্ধি করার ব্যর্থতাই সিটি করপোরেশনে তাদের ভরাডুবির অন্যতম প্রধান কারণ। আর যে কোন অযুহাতে প্রধান বিরোধী দলকে বাদ দিয়ে একতরফা নির্বাচন করলে বা নির্বাচন না দিয়ে ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করা হলে তা হবে আত্মঘাতি, সাময়িক, অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা – যা দেশ ও জনগণের তথা শাসক গোষ্টির জন্য শেষ পরিনতিতে হবে অশুভ ও অকল্যাণকর।
রিয়াদ, সউদী আরব