একাত্তরে সেলিনা পারভীনকে ধরে নেয়া আল বদর বাহিনীর দলে চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ছিলেন বলে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে বলেছেন নিহত সাংবাদিকের ছেলে।
Related Stories
-
ট্রাইব্যুনালে আসবেন না মুঈনুদ্দীন
2013-07-20 20:43:47.0
-
আশরাফ-মুঈনুদ্দীনই বাবার অপহরণকারী: মুনীর চৌধুরীর ছেলে
2013-07-18 20:52:05.0
-
আশরাফ-মুঈনুদ্দীনের বিচার শুরুর আদেশ
2013-06-24 06:03:41.0
একাত্তরের অপরাধ অস্বীকার করে আল জাজিরাকে দেয়া মুঈনুদ্দীনের সাক্ষাৎকার প্রচারের একদিন বাদে রোববার ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেন সুমন জাহিদ।
একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে মূল ভূমিকা পালনকারী আল বদর বাহিনীর অপারেশন-ইন চার্জ মুঈনুদ্দীনের অনুপস্থিতিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তার বিচার চলছে।
যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত মুঈনুদ্দীন কাতারভিত্তিক টেলিভিশনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারকে ‘প্রহসন’ আখ্যায়িত করে আদালতে হাজির হবেন না বলে জানিয়েছেন।
১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর আট বছর বয়সী সুমন জাহিদের সামনেই চোখ ও হাত বেঁধে তুলে নেয়া হয় মা সেলিনা পারভীনকে। সাক্ষ্যে মায়ের হত্যার ঘটনার বর্ণনার সময় কেঁদে ফেলেন তিনি।
বর্তমানে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সুমন জাহিদ বলেন, তখন তার এক মামা মুঈনুদ্দীনকে চিনতে পেরেছিলেন এবং পরে তিনি গবেষণা করে বিষয়টি নিশ্চিত হন।
দুজনেই ফেনী জেলার বাসিন্দা হওয়ায় এবং এক সময় এক পত্রিকায় কাজ করার সুবাদে মুঈনুদ্দীন সেলিনা পারভীনকে ‘বুবু’ বলে সম্বোধন করতেন বলে জানান সুমন।
চৌধুরী মুঈনুদ্দীন বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের তৃতীয় সাক্ষী হিসেবে বিচারপতি ওবায়দুল হাসান নেতৃত্বাধীন ট্রাইব্যুনাল-২ এ সাক্ষ্য দেন সুমন জাহিদ। এই মামলায় যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী মো. আশরাফুজ্জামানও অভিযুক্ত।
১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর মধ্যরাতে আল বদর বাহিনীর সদস্যরা রাজধানীর নিউ সার্কুলার রোডের বাড়ি থেকে সেলিনা পারভীনকে ধরে নিয়ে যায়। ওই সড়কটির এখন নাম শহীদ সেলিনা পারভীন সড়ক।
রাত দেড়টার দিকে আল বদর বাহিনী বাড়িতে হানা দিয়েছিল বলে জানান সুমন। তখন ওই বাড়িতে সেলিনা পারভীনের এক ভাইও ছিলেন।

“আমি ও মামা বাসার ছাদে ছিলাম, মা রান্না করছিলেন। আমাদের বাসার সামনে কিছু গাড়ি এসে থামলো। ছাদ থেকে উঁকি দিয়ে দেখতে পাই- একটি জিপ ও একটি মাইক্রোবাস, বেশ পেছনে একটি মিলিটারি লরি।”
মাইক্রোবাসটি চারিদিকে যে কাদামাটি দিয়ে লেপা ছিল তা এখনো মনে আছে তখনকার শিশু সুমনের।
গাড়িগুলোর আসার কিছুক্ষণের মধ্যেই বাড়ির কলাপসিবল গেইট নাড়ার শব্দ শুনতে পান সুমন। তখন পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দা তখনকার জাতীয় পরিষদ সদস্য অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম সৈয়দ সালাহউদ্দিন গেইট খুলে দেন বলে জানান তিনি।
সুমন জানান, আগন্তুকরা তার মায়ের বাসা কোনটি, তা জানতে চাইলে সালাহউদ্দিন দেখিয়ে দেন। এরপর আগন্তুকদের নির্দেশে নিজের ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়েন সালাউদ্দিন।
সেলিনা পারভীনের বাসায় কড়া নাড়া শুরু হলে সুমন ও তার মামা ছাদ থেকে সিঁড়ি বেয়ে নেমে উঁকি দিয়ে দেখতে চেষ্টা করেন, কারা এসেছে বাড়িতে।
“মা দরজা খুলে দেন এবং আগন্তুকরা মায়ের পরিচয় জানতে চান। এসময় তাদের একজন আমাদেরকে দেখে ফেলে এবং বন্দুক তাক করে বলে ‘হ্যান্ডসআপ’। আমি এবং উজির মামা তখন হাত উঁচু করে নেমে আসি।”
আগন্তুকদের প্রশ্নে নিজের ছেলে ও ছোট ভাইয়ের পরিচয় দেন সেলিনা পারভীন। উজিরকে মুক্তিযোদ্ধা বলে সন্দেহ করেন আগন্তুকরা। তখন সেলিনা পারভীন বলেন, তার ভাই একজন ছাত্র এবং তার একটি দোকানও রয়েছে।
সুমন বলেন, “এ সময় আমি মায়ের কাছে গিয়ে আঁচল ধরে দাঁড়িয়ে থাকি। তারা মাকে বলে, আপনাকে আমাদের সঙ্গে সেক্রেটারিয়েটে যেতে হবে। মা বলে, আমার কাছে কারফিউ পাস নেই, আমি কিভাবে যাব? তারা বলে, আমাদের কাছে আছে, অসুবিধা হবে না।
“আমি মায়ের সঙ্গে যেতে চাইলে তাদের একজন বাধা দিয়ে বলে, ‘বাচ্চা লোগ নেহি যায়েগা, অন্দর মে যাও’।”
সুমনের বর্ণনায়, আগন্তুকদের মুখ ছিল মাফলার দিয়ে ঢাকা এবং হাতে ছিল অস্ত্র ছিল।
তাদের ধমকে সুমন ও তার মামা উজির ভয় পেয়ে যান।
“মা আমার মাথায় হাত রেখে বলে, ‘সুমন, তুমি মামার সঙ্গে খেয়ে নিও, আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসব।”
এটাই ছিল মায়ের সঙ্গে সুমনের শেষ কথা, অনেক বুদ্ধিজীবীর মতো আর কখনো ফেরেননি সাংবাদিক সেলিনা পারভীন।
তাদের অনেককে পরে পাওয়া যায় রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে। হত্যার আগে যে তাদের নির্যাতন করা হয়েছিল, তা প্রায় সবার দেহেই ছিল স্পষ্ট।
সুমন জানান, সেলিনা পারভীনের হাতে থাকা গামছা দিয়ে তার চোখ বাঁধা হয় এবং আগন্তুকদের হাতে থাকা মাফলার জাতীয় একটি জিনিস দিয়ে হাত বাঁধা হয় পিঠমোড়া করে। তারপর তোলা হয় কাদামাখা সেই গাড়িতে।
সেই রাতে নিয়ে যাওয়ার পর আর সেলিনা পারভীনের কোনো খোঁজ পায়নি তার পরিবার। এর তিন দিনের মাথায় দেশ স্বাধীন হয়।
বিজয়ের পরদিন ১৭ ডিসেম্বর শহীদ মুনীর চৌধুরীর ভাই শমসের চৌধুরীর কাছ থেকে সেলিনার দুই ভাই জানতে পারেন, রায়েরবাজারে তাদের বোনের লাশ পড়ে আছে। পরদিন লাশ সনাক্ত করে আজিমপুর নতুন কবরস্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সংরক্ষিত স্থানে দাফন করেন তারা।
আল বদরদের ওই দলে মুঈনুদ্দীনের থাকার বিষয়ে সুমন জাহিদ বলেন, “আমার মামা সাহাবউদ্দিন ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া গ্রুপ) করতেন এবং চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ইসলামী ছাত্র সংঘ করতেন। তাদের মধ্যে প্রায়ই রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব হত।”
সাহাবুদ্দিন চৌধুরী মুঈনুদ্দীনকে চিনতেন জানিয়ে সুমন বলেন, “পত্র-পত্রিকায় চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের ছবি দেখে উজির মামা তখন বলেন, মাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় এই লোকটিও ছিল।”
সুমন বলেন, রায়েরবাজার বধ্যভূমি থেকে জীবিত ফিরে আসা একমাত্র ব্যক্তি দেলোয়ার হোসেনের কাছ থেকে ১৯৯৬ সালে তিনি জানতে পারেন, তার মাকে অপহরণ করে মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারের একটি রুমে ২০-২৫ জনের সঙ্গে আটকে রাখা হয়েছিল।
এই পর্যায়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে শহীদের এই সন্তান বলেন, “দেলোয়ার সাহেব বলেছিলেন, তাকে ১৪ ডিসেম্বর সকালে তুলে নিয়ে আমার মায়ের সঙ্গে একই রুমে রাখা হয়। তার কাছ থেকে অপহরণের পরে কিভাবে মাকে হত্যা করা হয়েছে এবং তাদের সঙ্গে কারা কারা আটক ছিলেন, তার সব শুনেছি।”

সাক্ষী বলেন, দেলোয়ার হোসেনের সঙ্গে কথা বলে এবং অন্যান্য সূত্র থেকে তিনি নিশ্চিত হন যে চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ছিলেন আল বদরের অপারেশন-ইন-চার্জ এবং আশরাফুজ্জামান খান ছিলেন আল বদরের একজন।
সুমন জাহিদ বলেন, “১৯৭১ সালে আমার মা এমন কোনো বিখ্যাত সাংবাদিক ছিলেন না। কিন্তু তারপরও তাকে আল বদরের হাতে নিহত হতে হয়, কারণ আমার মায়ের সম্পাদিত ‘শিলালিপি’তে অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, সাংবাদিক শহীদুল্লাহ কায়সার, জহির রায়হান, আ ন ম গোলাম মোস্তফার মতো স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত কবি, সাহিত্যিক, লেখকরা নিয়মিত লেখালেখি করতেন।”
মায়ের অপহরণ এবং হত্যার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে সুমন জাহিদ জেনেছেন, ‘শিলালিপি’ পত্রিকা বিক্রি করে পাওয়া টাকা দিয়ে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতেন সেলিনা পারভীন।
সাক্ষ্য দেয়া শেষ হলে সুমন জাহিদকে জেরা করেন আসামি আশরাফুজ্জামানের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আব্দুস শুকুর খান। পরে চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী সালমা হাই টুনি জেরার প্রস্তুতির জন্য সময় চাইলে শুনানি সোমবার পর্যন্ত মূলতবি করা হয়।
চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানের বিরুদ্ধে গত ২৪ জুন যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ গঠন হয়।
গত ২ মে দুজনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছিল ট্রাইব্যুনাল। দেশে না পাওয়ায় তাদের হাজির হতে দুটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশও হয়েছিল।
বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পরও হাজির না হওয়ায় তাদের অনুপস্থিতিতেই বিচার শুরুর আদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল।
গত ১৫ জুলাই এ মামলার প্রথম সাক্ষ্য দেন শহীদ অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিনের ভাগ্নী মাসুদা বানু রত্না। তারপর সাক্ষ্য দেন শহীদ মুনীর চৌধুরীর ছেলে আসিফ মুনীর তন্ময়।
আশরাফুজ্জামানের গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের বেজড়া ভাটরা (চিলেরপাড়) গ্রামে। চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের বাড়ি ফেনীর দাগনভুঞার চানপুরে।