বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে রাজধানীর তিন বাস টার্মিনাল আধুনিকায়নের কোনো সুফল পাচ্ছে না সাধারণ যাত্রীরা। অনেকে বলছে, নামেই শুধু আধুনিক বাস টার্মিনাল। সেবার নামে চলছে বেসামাল যাত্রী হয়রানি। কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় বেহাল দশা বিরাজ করছে গাবতলী, মহাখালী ও সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে। ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত এ তিন বাস টার্মিনাল যাত্রীদের পদভারে মুখর থাকলেও তাদের দুর্ভোগের শেষ নেই। প্রতিবাদ করলে কপালে জোটে শারীরিক নির্যাতন। নগরীর এ তিন বাস টার্মিনালের সার্বিক দেখভালের দায়িত্ব ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের। এ তিন টার্মিনাল থেকে প্রতিদিন গড়ে সাড়ে চার হাজার দূরপাল্লা ও সিটি সার্ভিসের বাস-মিনিবাস যাতায়াত করে। এর মধ্যে গাবতলী থেকে ১ হাজার ৪০০, মহাখালী থেকে ৭০০ ও সায়েদাবাদ থেকে ৯০০ বাস ছেড়ে যায়। এ ছাড়া সিটি সার্ভিসের ৪১ রুটের আরও ১ হাজার মিনিবাস আসা-যাওয়া করে এসব টার্মিনালে। সম্প্রতি দিনভর তিন বাস টার্মিনাল ঘুরে পাওয়া গেছে যাত্রী হয়রানি ও বিড়ম্বনার নানা চিত্র। এ ছাড়া যাত্রী টানাটানি, মাদকসেবীদের বিচরণ, হকারদের উৎপাত, নোংরা বিশ্রামাগার ও টয়লেটের করুণ দশায় সাধারণ যাত্রীরা সীমাহীন দুর্ভোগে পড়ে এ তিন টার্মিনালে।
সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল : সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে দেখা গেছে, টার্মিনালের নির্ধারিত জায়গার একটু দূরে শতাধিক দূরপাল্লার ও সিটি সার্ভিসের বাস-মিনিবাস এলোমেলোভাবে রাখা। যাত্রীরা বিড়ম্বনা মাথায় নিয়ে টার্মিনালের ভেতরে ঢুকছে। প্রায় সাত একর জমির ওপর নির্মিত টার্মিনালটিতে যাত্রীসেবা নেই বললেই চলে। সকাল ১০টায় ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের সালাম পরিবহনের একটি বাসের হেলপার যাত্রীর জন্য হাঁকডাক দিচ্ছেন। বলছেন, ডাইরেক্ট চট্টগ্রাম। মাত্র ৪০০। এভাবে চার-পাঁচ মিনিট ডাকাডাকির পর আলম নামে এক যাত্রী এগিয়ে আসেন। তিনি জানান, ৩০০ টাকা দেব। এ কথা শুনে তেড়ে যান হেলপার জসিম। এ টাকায় সিট ছাড়াই দাঁড়িয়ে যেতে হবে বলে জানিয়ে দেন। গার্মেন্ট কর্মী শরিফা ফেনী যেতে চান। তাকে দেখে তিন বাসের কর্মচারীরা ঘিরে ধরেন। তাকে টানাহেঁচড়া করে নবীন পরিবহনের একটি বাসে উঠিয়ে নেন। এভাবে আরও তিন যাত্রীকে ওই বাসে ওঠানো হয়। বেলা ১১টায় টার্মিনালের যাত্রী বিশ্রামাগারে গিয়ে দেখা যায়, রুমের ভেতরে ১০-১২টি ভাঙা চেয়ার। চেয়ারের পাশে কয়েকজন হকার ও বখাটে খোশগল্প করছে। রুমের বাইরে চাঁদপুর যাওয়ার অপেক্ষায় একটি পরিবার অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে আছে। কেন ভেতরে যাচ্ছেন না জানতে চাইলে বলেন, ভেতরে যাওয়ার কোনো পরিবেশ নাই। বিশ্রামাগারের পাশেই রয়েছে টয়লেট। টয়লেটের ভেতরের অবস্থা বড়ই শোচনীয়। দুর্গন্ধে ঢোকাই দায়। কালাম নামে এক যাত্রী আক্ষেপ করে বলেন, টার্মিনালে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশেনের তিনজন সুইপার থাকলেও তারা ডিউটি না করে সারা দিন টার্মিনালের ভেতর পান-সিগারেট বিক্রি করেন। কাজ ছাড়াই মাস শেষে বেতন তোলেন। জানতে চাইলে যাত্রী দুর্ভোগ ও বিড়ম্বনার কথা স্বীকার করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ব্যবস্থাপক (টার্মিনাল) মো. মারুফ হাসান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দুর্গন্ধ ও ময়লা-আবর্জনা মুক্ত করতে শীঘ্রই ১০ জন সুইপার নিয়োগ দেওয়া হবে। এ ছাড়া গুলিস্তান ফ্লাইওভার চালু হলে যাত্রীসুবিধা বাড়বে বলে জানান তিনি।
গাবতলী বাস টার্মিনাল : গাবতলী বাস টার্মিনালের ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ল যাত্রীদুর্ভোগের নানা চিত্র। বিশ্রামাগারে দেখা গেল পাঁচ বেকার যুবক তাস খেলছে। টেলিভিশনের নির্ধারিত স্থানে টেলিভিশন নেই। আছে এক পাশে রহিম নামে এক জুতার কারিগরের জুতা পালিশ করার বাঙ্। আরেক পাশে চিনা বাদাম বিক্রির সরঞ্জাম। টয়লেটের সামনে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। ১০০ হাত দূর থেকেও ভেসে আসছে কটকটে দুর্গন্ধ। খুলনার যাত্রী হাসিনা শিরিন বলেন, গাবতলী নামেই আধুনিক টার্মিনাল। একটা ভালো টয়লেট পর্যন্ত নেই। নেই পরিষ্কার বিশ্রামাগার। টার্মিনালের সর্বত্র ছড়িয়ে আছে ময়লা-আবর্জনা। বৃষ্টি ও রোদের সময় অপেক্ষা করার মতো জায়গার অভাব। এ ছাড়া বাস কর্মচারীদের টানাটানির কারণে পছন্দের বাসে যাওয়া যায় না। ডিএনসিসি সূত্র জানায়, সাড়ে পাঁচ একর জমির ওপর ১৯৮৮ সালে নির্মিত এ টার্মিনাল থেকে ১ হাজার ৪০০ বাস ৩৫ জেলায় ছেড়ে যায়। গাবতলী টার্মিনালের দায়িত্বপ্রাপ্ত সুপারভাইজার মো. সিদ্দিক বলেন, জনবল সংকটে সবকিছুর প্রতি লক্ষ্য রাখা যাচ্ছে না। তিনি টয়লেট ও টার্মিনালে অপ্রতুল সেবার প্রসঙ্গ টেনে বলেন, ভাসমান ও বখাটেদের উৎপাতের কারণে কেউ মুখ খুলতে পারে না। এ কারণে টার্মিনালে আসা যাত্রীদের সেবার পরিবর্তে দুর্ভোগ ও যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়। ফরিদপুরের যাত্রী সোহরাব বলেন, হকারদের উৎপাতে এ টার্মিনাল দিয়ে যাতায়াত করা কষ্টকর। কুলিরা মালামাল নিলে ২০ টাকার জায়গায় ৫০ টাকা দাবি করে বসে। না দিলে গায়ে হাত দিতেও দ্বিধা করে না। এ ছাড়া সিটি সার্ভিসের বাস ও মিনিবাসের যত্রতত্র থামানো ও নির্ধারিত পার্কিং ছাড়াই যাত্রী ওঠানো-নামানোর কারণে দিনভর যানজট লেগেই থাকে।
মহাখালী বাস টার্মিনাল : টার্মিনালের প্রবেশমুখে সিটি সার্ভিসের বাস ও মিনিবাসের কারণে ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত যানজট লেগেই থাকে। আর সাধারণ যাত্রীদের দুর্ভোগ ও নানা ধরনের কষ্ট স্বীকার করে ভেতরে ঢুকতে হয়। ময়মনসিংহগামী যাত্রী ফারুক হোসেন বলেন, টার্মিনালে এলেই শুরু হয় টানাটানি। এসব কারণে অনেকে টার্মিনালের বাইরে থেকে বাসে উঠে যাত্রা করেন। সরেজমিনে আরও দেখা গেছে, যাত্রীদের বিশ্রামাগার হকারদের দখলে। টয়লেটে যাওয়ার পরিবেশ নেই। দুই টয়লেটের দরজার সিটকানি নেই। পানির লাইন থাকলেও কলে পানি নেই। এ ছাড়া কোনো যাত্রী ভেতরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে বাসের কর্মচারীরা টিকিট কেনার জন্য টানাটানির যুদ্ধ শুরু করে। দেড় কোটি টাকা ব্যয় করেও যাত্রীদের কোনো আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করা যায়নি। রাতের টার্মিনাল চলে যায় মাদক ও গাঁজাসেবীদের দখলে। স্থানীয় শিল্পাঞ্চল থানায় মাসহারা দিয়ে এসব কর্মকাণ্ড চলছে বলে স্থানীয়রা অভিযোগ করেছে। দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. দেলোয়ার হোসেন কোনো কিছু বলতে রাজি হননি।