পাঁচ সিটি করপোরেশনে সরকার দলের হারের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে জনপ্রশাসনে। প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে কমে গেছে সরকারদলীয় তদবিরকারীদের আনাগোনা। কমছে ফাইল মুভমেন্ট বা চালাচালি। দাফতরিক কাজে ঢিলেঢালাভাব দেখিয়ে সচিবালয়ের সুবিধাবাদী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এখন সরকার পরিবর্তনের হিসাব-নিকাশে ব্যস্ত সময় পার করছেন। আড্ডা, গল্পগুজব ও রাজনৈতিক আলাপ আলোচনা করে কর্মঘণ্টা পার করছেন। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, অধিদফতর ও পরিদফতরের স্বাভাবিক ফাইল ওয়ার্ক বা দাফতরিক কাজেও সম্প্রতি স্থবিরতা দেখা গেছে। গত কয়েকদিন সচিবালয় ঘুরে এসব তথ্য পাওয়া যায়।
সর্বশেষ গত শনিবার গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পরাজয়ের পর গত দু’দিনে সচিবালয়ের কাজে সবচেয়ে বেশি শৈথিল্যভাব দেখা গেছে। এমনকি বেশিরভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারীই এখন কর্মস্থলে আসছেন নির্ধারিত সময়ের এক-দেড় ঘণ্টা পর। তবে মন্ত্রী, সচিব ও সরকার সমর্থক চিহ্নিত কর্মকর্তারা যথা সময়ে কর্মস্থলে উপস্থিত হচ্ছেন। কিন্তু তাদের মধ্যেও দেখা গেছে হতাশার চিত্র।
এছাড়াও সম্প্রতি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে নীতিনির্ধারণ পর্যায়ের সভা হচ্ছে, সেগুলোর অধিকাংশেই বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে। দীর্ঘ মেয়াদি সিদ্ধান্ত, প্রকল্প গ্রহণ, সংস্কার ও নীতিনির্ধারণ পর্যায়ের প্রস্তাব অনুমোদন এখন পিছিয়ে নেয়া হচ্ছে।
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ গতকাল নিজ দফতরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ‘শিক্ষাখাতে যেসব সংস্কার, উন্নয়ন ও পরিবর্তন এই সরকারের আমলে হয়েছে, তা দেশের সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নের জন্যই হয়েছে। আশা করি আগামীতে যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন উন্নয়ন ও সংস্কারের ওই ধারা অব্যাহত থাকবে’।
প্রশাসনে সরকার সমর্থক হিসেবে পরিচিত একজন প্রভাবশালী সচিব গতকাল সংবাদকে বলেন, ‘আমি বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে কোন পদোন্নতি পাইনি, ভালো কোন দফতরের দায়িত্বও পাইনি। বরঞ্চ বেশ কয়েক বছর ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) ছিলাম। কাজেই আমি ওই সরকারের আগমন নিয়ে উদ্বিগ্ন নয়। কারণ বিএনপি-জামায়াত জোট এবার ক্ষমতায় আসলে আমি স্বেচ্ছায় অবসর নেব। এর আগে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করে যাব’।
সচিবালয় ঘুরে দেখা যায়, গৃহায়ন ও গণপূর্ত, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা, ভূমি, বাণিজ্য, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা, স্বরাষ্ট্র, খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাসহ বেশকিছু মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন শাখা ও অধিশাখায় কর্মচারীরা গল্পগুজব করে অলস সময় পার করছেন। আর অনেক কর্মকর্তাকে দফতরেই পাওয়া যায়নি। এসব দফতরের কর্মচারীরা জানায়, ‘কাজ কম। তাই স্যার বাইরে আছেন, কখন আসবেন- জানি না’। এছাড়াও সম্প্রতি সকাল ১১টার আগে কর্মচারীরাও নিজ নিজ দফতরে আসছে না। যথাসময়ে কিংবা কিছুটা বিলম্বে সচিবালয়ে প্রবেশ করলেও নিজ নিজ ডেস্কে বসছেন অনেক দেরিতে। আর কর্মচারী নেতারা সারাদিন তদবির ও ক্যান্টিনে আড্ডা দিয়ে কর্মঘণ্টা পার করছেন। সরকারের শেষ সময়ে কর্মকর্তারাও কর্মচারীদের ক্ষেপিয়ে তুলতে নারাজ।
রোববার ও গতকাল সচিবালয়ে ঘুরে জানা যায়, দুদিনে মাত্র ৪/৫ জন সংসদ সদস্য (এমপি) সচিবালয়ে আসেন। অথচ পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগে প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ থেকে অর্ধশত এমপি সচিবালয়ে আসতেন বিভিন্ন প্রয়োজনে তদবির নিয়ে। আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা ও এর বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের নেতাদের আনাগোনাও এখন চোখে পড়ে না সচিবালয়ে। নেই ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সাবেক ও বর্তমান নেতাদের তদবিরবাজি। এমনকি সরকার সমর্থক বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের নেতাদেরও এখন সচিবালয়ে ঘন ঘন আসতে দেখা যায় না।
প্রশাসনের পর্যবেক্ষকরা জানান, পাঁচটি স্থানীয় নির্বাচনে ক্ষমতাশীন মহাজোট সরকারের প্রার্থীর পরাজয়ের ফলে সরকারের নীতিনির্ধারণ পর্যায়সহ রাষ্ট্রে সর্বোচ্চ প্রশাসনিক স্থান সবিচবালয়েও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। সারা দেশে চলছে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কেন্দ্র থেকে স্থানীয় পর্যায় এই নির্বাচনের পরাজয়ের কারণ খোঁজে চিহ্নিত করা হচ্ছে। আর বিরোধীদলের নেতা-কর্মীরা তাদের দাবির পক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টি হচ্ছে বলে প্রচার করছে। কিন্তু এই পক্ষে-বিপক্ষের আলোচনার বাইরে রাষ্ট্রে নিরক্ষেপ স্থান সচিবালয় দেখা গেছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে উচ্চ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা জানান, ‘গাজীপুরসহ ৫টি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সরকারদলীয় প্রার্থীর পরাজয় এবং বিরোধী জোটের প্রার্থীর বিজয়ের ফলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশাসনে একটি প্রভাব পড়েছে। এতদিন যারা দলের প্রভাব খাটিয়ে সরকারের বিভিন্ন কাজ পাওয়ার জন্য সরকারি কর্মকতাদের ব্যবহার করেছেন তাদের আনাগোনা একটু কম লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তারা আগে যে গতিতে কাজ করতেন তার চেয়ে একটু কম লক্ষ্য করা যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই একটু গতিহীন হয়ে পড়েছে সচিবালয়’।
একই মন্ত্রণালয়ের অপর এক কর্মকর্তা বলেন, ‘স্থানীয় নির্বাচনের প্রভাব জাতীয় নির্বাচনে তেমন পড়বে না। সরকারি দল সিটি করপোরেশন যতটা শক্তি নিয়ে নির্বাচনে কাজ করা উচিত ছিল তেমনটা তারা পারেনি। তাই অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয় পর্যায় চাহিদামত প্রার্থী দিতে ব্যর্থ হওয়ায় আওয়ামী লীগ বিজয়ী হতে পারেনি। এই নির্বাচন থেকে জাতীয় নির্বাচনের জন্য তারা শিক্ষা নিতে পারে। তবে স্থানীয় নির্বাচনে সরকারদলীয় প্রার্থী পরাজয়ের ফলে প্রশাসনে এর প্রভাব পড়েছে, বিষয়টি তেমন নয়। কারণ প্রশাসন নিরপেক্ষভাবে তাদের কাজ করছে এবং যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন প্রশাসন তাদের কাজ করবে এটাই নিয়ম’।
নৌ মন্ত্রণালয়ের একজন উপ-সচিব সংবাদকে বলেন, ‘মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচার পেলে দেশের যেকোন বিষয় এখন জাতীয় ইস্যু হিসেবে কাজ করে’।
তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘যেমন গাজীপুর নির্বাচন একটি স্থানীয় নির্বাচন, কিন্তু নির্বাচনের আগের দিন কয়েকটা পত্রিকায় দেখলাম লেখা হয়েছে ‘গাজীপুর আজ জাতীয় নির্বাচন’ এর মানে কি? এভাবে স্থানীয় নির্বাচনকে জাতীয় নির্বাচন থেকেও বেশি গুরুত্ব দিয়েছে মিডিয়া। যার ফলে এর প্রভাব পড়েছে সাধারণ মানুষসহ সব পর্যায়ে। নির্বাচনে পরাজয়ের ফলে সরকারিদলের মধ্যে দেখা গেছে, হতাশা। এর বিপরীত নির্বাচনে বিজয়ের ফলে বিরোধীদল তাদের দাবি আরও জোরালো করার জন্য আন্দোলনের হুমকি দিচ্ছেন। এই দুই দলের মধ্যে পড়ে জনগণ আজ বিপাকে’।
তিনি আরও বলেন, ‘এই নির্বাচনে সরকারি দল পরাজয়ের কারণে প্রশাসনের মধ্যে প্রভাব কিছুটা তো পড়েছেই। যেমন অনেক কর্মকর্তা আছেন যারা এই সরকারের আমলে তেমন সুযোগ-সুবিধা পায়নি। তারা তো ভেবেই নিয়েছেন আগামীতে কারা ক্ষমতায় আসছেন। তাই ফাইলের গতি আগের চেয়ে কমে যাবে এটাই স্বাভাবিক’।