‘আওয়ামী লীগ হেরেছে, আজমত উল্লা হারেননি’

0
158
Print Friendly, PDF & Email

‘ভোটাররা প্রার্থীর ভালো-মন্দ বিবেচনায় নেননি। তাঁরা দেখেছেন দল আর সরকারের কর্মকাণ্ড। সারা দেশে ছাত্রলীগের অপকর্ম, পদ্মা সেতু ও হল-মার্কের মতো কেলেঙ্কারি, ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের আচরণ এবং জনভোগান্তি নিরসনে ব্যর্থতা মানুষকে ক্ষুব্ধ করেছে। মানুষ ব্যালটের মাধ্যমে সরকারের বিরুদ্ধে তাঁদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। ফলে হারতে হয়েছে আজমত উল্লা খানকে।’ গাজীপুর শহরের রথখোলা মাঠের একটি চায়ের দোকানে বসে গাজীপুরের আজিমউদ্দিন কলেজের মাস্টার্সের ছাত্র নুরুজ্জামান কথাগুলো বলছিলেন। পাশে থাকা মমিনুল ইসলাম, আবুল কালাম ও মিরন হেসেন এ কথায় সায় দেন। তাঁদের সবার মত, গাজীপুরের মানুষ আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছেন। এখানে আজমত উল্লা হারেননি, আওয়ামী লীগ হেরেছে।
গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফল ঘোষণা করা হয়েছে গতকাল রোববার ভোরে। এই নির্বাচনে এক লাখ ছয় হাজার ৫৭৭ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হয়েছেন সরকারি দলের প্রার্থী আজমত উল্লা খান। টেলিভিশন প্রতীক নিয়ে বিএনপির প্রার্থী এম এ মান্নান পেয়েছেন তিন লাখ ৬৫ হাজার ৪৪৪ ভোট। আর দোয়াত-কলম প্রতীক নিয়ে আজমত উল্লা পেয়েছেন দুই লাখ ৫৮ হাজার ৮৬৭ ভোট। ৩৯২টি ভোটকেন্দ্রের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ৩৩৪টি কেন্দ্রেই পরাজিত হয়েছেন আজমত উল্লা। আর যে ৫৮টি কেন্দ্রে তিনি জয়ী হয়েছেন, সেখানে ভোটের ব্যবধান সামান্য। সাবেক টঙ্গী ও গাজীপুর পৌরসভা এবং কোনাবাড়ী, কাশিমপুর, গাছা, পুবাইল, কাউলতিয়া ও বাসন—এই ছয়টি ইউনিয়ন নিয়ে গাজীপুর সিটি করপোরেশন। টঙ্গী আজমত উল্লার নিজের এলাকা, যেখানে তিনি ১৮ বছর পৌর মেয়র ছিলেন। কিন্তু সেখানকার ১৩৪টি কেন্দ্রের ১০০টিতেই পরাজিত হয়েছেন তিনি। ১৯৮৬ সালে পৌরসভা গঠিত হওয়ার পর গাজীপুর শহরে কখনোই আওয়ামী লীগ হারেনি।
’৯১ সালের সংসদ নির্বাচন থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত কোনো জাতীয় নির্বাচনেও সদর আসনটি হারায়নি আওয়ামী লীগ। কিন্তু এবার সদরের ৪৯টি কেন্দ্রের মধ্যে ৪১টিতেই পরাজিত হয়েছেন আজমত উল্লা। গাজীপুরের সবচেয়ে বড় ইউনিয়ন গাছা। এখানে মোট ভোটার এক লাখ ৩৫ হাজার ৩১৭। ’৮৮ সালের পর গাছার স্থানীয় নির্বাচনে সব সময়ই জিতেছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু এবার ৪৭টি কেন্দ্রের মধ্যে মাত্র পাঁচটিতে জিতেছে আওয়ামী লীগ। আহসানউল্লাহ মাস্টারের এলাকা পুবাইল। আজমত উল্লা সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়েছেন এখানে। এখানকার ২২টি কেন্দ্রের মধ্যে ১০টিতে জয় পেয়েছেন তিনি। গাজীপুরের কাশিমপুরে মোট ভোটার এক লাখ ছয় হাজার ৮৬৫। এখানকার ৪০টি কেন্দ্রের ৩৮টিতেই হেরেছেন আজমত। কোনাবাড়ির মোট ভোটার এক লাখ ৩৩। এখানকার ৩৫টি কেন্দ্রের সব কটিতেই হেরেছেন তিনি। একই অবস্থা কাউলতিয়ায়। এখানকার ৩০টি কেন্দ্রের সব কটিতেই হেরেছেন আজমত। বাসনের ৩৫ কেন্দ্রের মধ্যে শুধু বাসন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে এক ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন আজমত উল্লা।
গাজীপুরকে বলা হতো আওয়ামী লীগের ঘাঁটি। কিন্তু সেই ঘাঁটির এ অবস্থা কেন? সেটি জানতেই গতকাল কথা হয় গাজীপুরের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের সঙ্গে। সবার একই কথা, আজমত উল্লা হারেননি, হেরেছে তাঁর দল। বিএনপির স্থানীয় নেতারাও বলছেন, জাতীয় রাজনীতিই জয়-পরাজয়ের কারণ। নির্বাচনে বিপুল বিজয়ের কারণ জানতে চাইলে নবনির্বাচিত মেয়র এম এ মান্নান বলেন, স্থানীয় নয়, এখানে জাতীয় বিষয় কাজ করেছে। মূলত জনগণ সরকারের প্রতি অনাস্থা জানিয়েছে। জাতীয় কোন বিষয়গুলো কাজ করেছে, জানতে চাইলে বিএনপির এই নেতা বলেন, সরকারের নানা ব্যর্থতা, খুন, গুম, লুটপাট, হেফাজতবিরোধী অভিযান ইত্যাদি।
এত বড় ব্যবধানে পরাজয়ের কারণ জানতে চাইলে আজমত উল্লার নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্যসচিব ও সাংসদ জাহিদ আহসান বলেন, দুই প্রার্থীর মধ্যে তুলনা করলে আজমত উল্লা অনেক বেশি যোগ্য। কিন্তু হেফাজত, ধর্মীয় ইস্যুসহ জাতীয় বিষয়গুলো নির্বাচনে গুরুত্ব পেয়েছে। ভোটারদের ভুল বুঝিয়ে প্রচার চালিয়েছে বিএনপি। এসব কারণেই হয়তো এ পরাজয়।
এম এ মান্নানের বিরুদ্ধে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী থাকাকালে হজযাত্রীদের বাড়িভাড়া নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগটি বেশ জোরেশোরেই তুলেছিল প্রতিপক্ষ। সেই সঙ্গে কর ফাঁকির অভিযোগে এনবিআরের ব্যাংক হিসাব জব্দ করার ঘটনায় শেষ মুহূর্তে বেকায়দায় পড়তে হয় মান্নানকে। কিন্তু আজমত উল্লার বিরুদ্ধে এ ধরনের কোনো অভিযোগ ছিল না। তার পরও মানুষ মান্নানকেই বেশি ভোট দিয়েছেন। কেন?
শহরের জয়দেবপুর এলাকায় কথা হচ্ছিল সাবেক টঙ্গী পৌরসভার কাউন্সিলর আব্বাস উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি এর ব্যাখ্যা দিলেন। তাঁর মতে, ‘আজমত উল্লা ভালো মানুষ। কেউ কখনো তাঁকে খারাপ বলতে পারবে না। কিন্তু জাতীয় রাজনীতির কারণে মানুষ আর প্রার্থীর যোগ্যতা দেখেনি। তাঁর দল আওয়ামী লীগ গত সাড়ে চার বছরে যা করেছে, তার সব দায় এসে পড়েছে তাঁর ওপর।’ কিসের দায়? আব্বাস বলেন, শেয়ারবাজার, পদ্মা সেতু, শাহবাগ, হেফাজত—সবকিছুর দায় তার ওপর পড়েছে। কাশিমপুরের একটি পোশাক কারখানার শ্রমিক খোরশেদ আলম বলেন, আজমতের বিরুদ্ধে কারও কোনো অভিযোগ নেই। কিন্তু তাঁর দল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে মানুষের হাজারো অভিযোগ। এটাই পরাজয়ের কারণ। গাজীপুরের একটি থানার ছাত্রদলের যুগ্ম সম্পাদক আনিসুল ইসলামেরও একই মত। তিনি বলেন, আজমত উল্লা ভলো মানুষ। মানুষ কিন্তু আজমতকে প্রত্যাখ্যান করেনি। প্রত্যাখ্যান করেছে আওয়ামী লীগকে। কেন হারলেন আজমত উল্লা? চান্দনা চৌরাস্তা এলাকার চায়ের দোকানি মনিরুল মিয়ার সোজাসাপ্টা জবাব, ‘আমি তো কঠিন কথা বুঝি না। সহজ করে কইলে কইতে হয়, মানুষ আওয়ামী লীগের ওপর খ্যাপা। হের লাইগ্যা মানুষ আজমতরে ভোট দেয় নাই। কারণ, হে আওয়ামী লীগের লোক। এইহানে যদি আওয়ামী লীগের সবচেয়ে ভালো লোক আইসা ইলেকশন করত, তাও ফেল করত।’
জাতীয় নির্বাচনের কয়েক মাস আগে অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনে স্থানীয় সমস্যাগুলোর চেয়ে জাতীয় রাজনীতিই গুরুত্ব পেয়েছে। বিষয়টির সঙ্গে একমত পোষণ করে গাজীপুর সরকারি মহিলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ এম এ বারী বলেন, দেশের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থার প্রতিফলন ঘটেছে এ নির্বাচনে।

শেয়ার করুন