যে সব পৌরসভা ও ইউনিয়নের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ছিল আওয়ামী লীগের, সেগুলো নিয়ে গঠিত গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের প্রথম নির্বাচনে বিপুল ভোটে হেরেছে এই দল সমর্থিত প্রার্থী।
শুধু ইউনিয়ন ও পৌরসভাই নয়, সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন ৩৩০ বর্গ কিলোমিটারে দুটি সংসদীয় এলাকায়ও দীর্ঘদিন ধরে দুই সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের।
১৯৯৬ সাল থেকে সংসদ নির্বাচনে গাজীপুরে আওয়ামী লীগের একচেটিয়া জয়ে রাজধানীর কাছাকাছি এই এলাকাকে নিজেদের ‘ঘাঁটি’ ভেবে আসছিলেন দলটির নেতারা।
সেই ‘ঘাঁটিতে’ শনিবার গোলযোগহীনভাবে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের আজমত উল্লা খানকে ১ লাখের বেশি ভোটে হারিয়েছেন বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থী এম এ মান্নান।
টেলিভিশন প্রতীকে মান্নান পেয়েছেন ৩ লাখ ৬৫ হাজার ৪৪০ ভোট। দোয়াত-কলম প্রতীকে আজমত পেয়েছেন ২ লাখ ৫৮ হাজার ৮৬৭ ভোট।
আয়তনে দেশের সবচেয়ে বড় এই নগরে মোট ১০ লাখ ২৬ হাজার ৯৩৮ জন ভোটারের মধ্যে ৬৩ শতাংশে ভোট দিয়েছেন।
গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের এই নির্বাচন স্থানীয় সরকারের একটি প্রতিষ্ঠানের গণ্ডি ছাপিয়ে জাতীয়ভাবেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল।
রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ভরাডুবির পর জাতীয় নির্বাচনের আগে গাজীপুরের এই নির্বাচনকে ক্ষমতাসীনদের জন্য ‘শেষ পরীক্ষা’ হিসেবে দেখছিলেন রাজনীতি পর্যবেক্ষকরা।
আর তাই বড় দুই দলকেই পূর্ণ শক্তি নিয়ে নামতে দেখা গেছে এই নির্বাচনে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শীর্ষ পর্যায়ের অনেক নেতাকে দেখা গেছে প্রচারে।
আওয়ামী লীগ এই নির্বাচনে মেয়র পদে সমর্থন দিয়েছিল আজমতকে, যিনি ১৯৯৫ সাল থেকে টঙ্গী পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে আসছিলেন।
তবে দলের সিদ্ধান্তের বিপরীতে সাবেক সাবেক ছাত্রলীগ নেতা জাহাঙ্গীর আলম মেয়র পদে প্রার্থী হলেও দলের শীর্ষ পর্যায়ের হস্তক্ষেপে তিনি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন।
মহাজোটের অন্যতম শরিক জাতীয় পার্টির প্রার্থী দিয়ে সরিয়ে নিলেও অনেক ‘নাটকের’ পর দলটির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ শেষ মুহূর্তে আওয়ামী লীগের আজমতকেই সমর্থনের ঘোষণা দেন।
টঙ্গীতে প্রত্যাশিত উন্নয়ন না হওয়ার অভিযোগ উঠলেও দুর্নীতির কোনো অভিযোগ আজমতের বিরুদ্ধে তুলতে দেখা যায়নি বিরোধী শিবিরকেও।
অন্যদিকে আজমতের প্রতিদ্বন্দ্বী মান্নানের বিরুদ্ধে দুই যুগ আগে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী থাকাকালে হজযাত্রীদের বাড়ি ভাড়া নিয়ে ‘দুর্নীতির’ অভিযোগটি বেশ জোরেশোরেই তুলেছিল প্রতিপক্ষ।
সেই সঙ্গে কর ফাঁকির অভিযোগে এনবিআরের ব্যাংক হিসাব জব্দ করার ঘটনা নিয়েও শেষ মুহূর্তে বেকায়দায় পড়তে হয় মান্নানকে; যদিও এটা সরকারি ‘ষড়যন্ত্রের’ অংশ বলে দাবি করে বিএনপি।
তবে বেকায়দায় থাকা মান্নানই শেষ পর্যন্ত জয় করায়ত্ত করে গাজীপুরের প্রথম নগর পিতা হিসেবে আবির্ভূত হলেন।
জাতীয় নির্বাচনের কয়েক মাস আগে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে স্থানীয় ইস্যুগুলোর চেয়ে জাতীয় ইস্যুই যে গুরুত্ব পাবে, সে কথা ভোটাররা আগেই বলে আসছিলেন।
“আজমত উল্লা সাহেব ভালো মানুষ, সবাই তাকে পছন্দ করে। কিন্তু জাতীয় ইস্যুগুলো সামনে আসায় মান্নান সাহেব কিছুটা বাড়তি সুবিধা পাবেন,” দুদিন আগেই বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন জয়দেবপুরের ভোটার আইনজীবী সজীব আহমেদ।
গাজীপুর ও টঙ্গী পৌরসভার সঙ্গে ছয়টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত হয়েছে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন।
টঙ্গীতে যেমন আজমত মেয়র ছিলেন, তেমনি গাজীপুর পৌরসভায় টানা নির্বাচিত হয়ে আসছিলেন আ ক ম মোজাম্মেল হক। আওয়ামী লীগের এই নেতা এখন সংসদ সদস্য।
গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের মোট ভোট ১০ লাখ ভোটের ৬০ শতাংশই গাজীপুর পৌরসভা, টঙ্গী পৌরসভা ও গাছা ইউনিয়নে বাসিন্দা।
গাছা ইউনিয়নে ১৯৮৮ সাল থেকে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে আসছেন।
মোট ভোটের প্রায় ৫ শতাংশ থাকা পুবাইল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন আহসান উল্লাহ মাস্টার, যিনি সংসদ সদস্য থাকা অবস্থায় গত বিএনপির শাসনামলে আততায়ীর গুলিতে নিহত হন।
এই সব কারণে আওয়ামী লীগ সমর্থকরা ভেবেছিল, জয়ের পাল্লা আজমতের পক্ষেই ভারী থাকবে।
কিন্তু এই ভালো অবস্থা যে এই নির্বাচনে যে কাজ করবে না, তার আভাস দুদিন আগেই দিয়েছিলেন গাজীপুর শহরের জোড় পুকুর এলাকার বাসিন্দা শরিফুল ইসলাম।
৬৫ বছর বয়সি এই ব্যক্তি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, “আজমত উল্লা লোক ভালো। তবে মানুষ এবার ব্যক্তি দেখে নয়, দল দেখে ভোট দেবে।”
কেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী ভোট পাবেন না, সেজন্য চারটি যুক্তিও দেখিয়েছিলেন শরিফুল।
প্রথমত, হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে সরকারের সাংঘর্ষিক অবস্থায় যাওয়া, আওয়ামী লীগের শাসনে ‘জনগণের অসন্তুষ্টি’, জাতীয় পার্টির স্থানীয় কিছু নেতার বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী এম এ মান্নানের পক্ষে কাজ করা এবং জাহাঙ্গীর আলম নিয়ে ‘নাটক’ তৈরি হওয়া।
এই নির্বাচনে হেফাজতকর্মীদের বিএনপি নেতা মান্নানের পক্ষে প্রচার চালাতে দেখা গেছে। এটাকে ধরে নির্বাচনে ধর্মের ব্যবহার নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে অভিযোগও করেন আজমত।
এরশাদ ভোটগ্রহণের দুদিন আগে আজমতকে সমর্থনের ঘোষণা দিলেও তার আগে থেকে মান্নানের পক্ষে প্রচারে নামা জাতীয় পার্টির নেতাদের নিরস্ত করা যায়নি।
দলের চেয়ারম্যানের ঘোষণার পরও জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি মাহমুদ হাসান বলেছিলেন, শেষ মুহূর্তে এই সিদ্ধান্ত এলেও নেতা-কর্মীদের ফেরানো সম্ভবপর নয়।
অনেক দিন ধরে মেয়র পদের জন্য প্রচার চালিয়ে আসা জাহাঙ্গীরকে নির্বাচন থেকে সরাতে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা নিজেই হস্তক্ষেপ করেন।
তবে ততদিনে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের সময় পেরিয়ে যাওয়ায় ব্যালট পেপারে জাহাঙ্গীরের নাম ছিল। ৩ হাজারের মতো ভোট তার প্রতীক আনারসেও পড়েছে।
জাহাঙ্গীর পরে আজমতের পক্ষে প্রচারে নামলেও নিজে মনে করেছেন, গাজীপুরে প্রার্থী সমর্থনের ক্ষেত্রে সঠিক তথ্য পাননি শেখ হাসিনা।