মুক্তিযুদ্ধকালের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার আসামি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাংসদ সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী দাবি করেছেন, একাত্তরের ২৯ মার্চ ঢাকা ছেড়ে তিনি পাকিস্তানের করাচি চলে যান। মুক্তিযুদ্ধের বাকি সময় তিনি আর বাংলাদেশে ফেরেননি।
বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীরের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ গতকাল সোমবার আসামিপক্ষের প্রথম সাক্ষী হিসেবে অষ্টম দিনের মতো জবানবন্দিতে সাকা চৌধুরী এ দাবি করেন। আসামিপক্ষের আইনজীবী ফখরুল ইসলাম তাঁর জবানবন্দি নেন।
গতকাল জবানবন্দিতে সাকা চৌধুরী দাবি করেন, একাত্তরের ২৯ মার্চ বিকেলে তিনি করাচির উদ্দেশে ঢাকা ছাড়েন। কাজিন কাইয়ুম রেজা চৌধুরী তাঁকে তেজগাঁও বিমানবন্দরে নিয়ে যান। পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসের (পিআইএ) জেলা ব্যবস্থাপক হামিদ জংয়ের সহায়তায় তিনি পিআইএর বিমানে আসন পান। সন্ধ্যায় তিনি করাচি পৌঁছান। স্কুলজীবনের বন্ধু মুনিব আরজুমান্দ খান ও মাহমুদ হারুনের ব্যক্তিগত সচিব বিমানবন্দরে তাঁকে অভ্যর্থনা জানান। তিনি করাচির সিফিল্ডে হারুনদের বাড়িতে ওঠেন। পাকিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় তাঁর বাবার (ফজলুল কাদের চৌধুরী) রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পৃষ্ঠপোষক ছিলেন স্যার আবদুল্লাহ হারুন। আবদুল্লাহ হারুনের তিন ছেলে—ইউসুফ, মাহমুদ ও সাঈদ হারুন।
সাকা চৌধুরী দাবি করেন, একাত্তরের এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত তিনি হারুন ভাইদের বাড়ি ছিলেন। সেখানে মাহমুদ ও ইউসুফ হারুন, মাহমুদের স্ত্রী ও দুই মেয়ের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। হারুন ভাইয়েরা পাকিস্তানের ডন প্রকাশনা সংস্থার স্বত্বাধিকারী ছিলেন। ইউসুফ বছর খানেক আগে নিউইয়র্কে মারা গেছেন, তাঁর স্ত্রী পাশা হারুন চলাচলে অক্ষম। মাহমুদ তিন বছর আগে মারা গেছেন, তাঁর মেয়ে হেরাল্ড প্রকাশনা সংস্থার বর্তমান চেয়ারম্যান আম্বর হারুন সায়গল। তিনি (সাকা চৌধুরী) যে হারুন ভাইদের বাড়িতে ছিলেন, এটি উল্লেখ করে আম্বর তাঁকে হলফনামা পাঠিয়েছেন। ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিতে আসতে চাইলেও তিনি বাংলাদেশের ভিসা পাননি। করাচিতে থাকার বিষয়ে বন্ধু মুনিব আরজুমান্দ খান ও মোহাম্মদ মিয়া সুমরুও তাঁকে হলফনামা পাঠিয়েছেন। ইসলামাবাদে বাংলাদেশের হাইকমিশন তাঁদেরও ভিসা দেয়নি।
সাকা চৌধুরীর জবানবন্দি অনুসারে, একাত্তরের এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহের শেষে তিনি লাহোরে যান। লাহোরে তিনি খাকওয়ানির বাসায় ছিলেন। সম্মান শ্রেণীর শেষ বর্ষের পড়াশোনা শেষ করতে তিনি পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাসের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে যোগ দেন। সেখানে তাঁর সঙ্গে বন্ধু শামীম হাসনাইনের (বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি) দেখা হয়, যাঁকে তিনি ১৯৬৬ সাল থেকে চেনেন। মে মাসে তিনি বন্ধু নাসির খান খাকওয়ানির বাগদান অনুষ্ঠানে যোগ দিতে মুলতান যান। জুন, জুলাই ও আগস্ট মাসে তিনি চূড়ান্ত পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য লাহোরের বাইরে যাননি। এ সময় তিনি ও শামীম হাসনাইন বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারেই বেশির ভাগ সময় কাটান। লাহোরে থাকাকালে তাঁর সঙ্গে সালমান এফ রহমানের (বর্তমানে বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান) তিন-চারবার দেখা হয়।
সাকা চৌধুরী বলেন, একাত্তরের আগস্টে পরীক্ষা শেষে তিনি বন্ধুদের সঙ্গে পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চলের পাহাড়ি এলাকা ও কাগান উপত্যকায় তিন সপ্তাহের ভ্রমণে যান। সম্ভবত ৮ অক্টোবর তাঁর বাবা লাহোর যান। ১০ অক্টোবর তিনি বাবাকে বিদায় জানিয়ে লন্ডনের উদ্দেশে রওনা হন। সেটাই বাবার সঙ্গে তাঁর শেষ দেখা।
এ সময় সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়ানো সাকা চৌধুরী আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। পরে তিনি বলেন, সড়কপথে নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে তিনি লন্ডনে পৌঁছান। ১৯৭৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত লন্ডনে ছিলেন। এরপর সাকা চৌধুরী রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, প্রফুল্ল রঞ্জন সিংহ ও গৌরাঙ্গ সিংহের সাক্ষ্যের যৌক্তিকতা নিয়ে বক্তব্য শুরু করেন। রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি সুলতান মাহ্মুদ আপত্তি জানিয়ে বলেন, এসব যুক্তি উপস্থাপনের সময় বলার কথা। ট্রাইব্যুনাল সাকা চৌধুরীকে বলেন, ‘আপনি যে সাক্ষ্য দিচ্ছেন, এভাবে কোনো সাক্ষী সাক্ষ্য দেয় না। কোন সাক্ষী কী বলেছে, এটা কেন জবানবন্দিতে আসবে? আপনার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ আপনি অস্বীকার করেছেন, সেটা বলবেন। কিন্তু সাক্ষীদের বক্তব্যের বিষয়ে যুক্তি দেওয়ার জন্য আপনার আইনজীবীরা আছেন।’
সাকা চৌধুরী বলেন, ‘আমি তো আগে কখনো সাক্ষ্য দিইনি। আপনারা আমাকে গাইড করেন।’ রাষ্ট্রপক্ষের অপর কৌঁসুলি জেয়াদ-আল-মালুম এ সময় বলেন, ‘এ কাজ তো করবে আপনার আইনজীবী-ব্যারিস্টাররা। তাঁরা আপনাকে অ্যাসিস্ট করছেন না।’
এ পর্যায়ে জবানবন্দি মুলতবির আরজি জানিয়ে সাকা চৌধুরী বলেন, মঙ্গলবার (আজ) এক ঘণ্টার মধ্যে তিনি জবানবন্দি শেষ করবেন। পরে এই মামলার কার্যক্রম আজ পর্যন্ত মুলতবি করা হয়।