রাশেদা কে চৌধুরী
চার দশক আগে ঘটেছিল যে বাংলাদেশের অভ্যুদয়, যে চেতনা নিয়ে শুরু হয়েছিল রক্তাক্ত মুক্তিসংগ্রাম, বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার যে লক্ষ্য নিয়ে জীবন পণ করেছিলেন স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টারাথ সেই স্বপ্নের অনেকখানি আজও অপূর্ণ রয়ে গেছে। ধনী-দরিদ্র, নারী-পুরুষের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের বড় এক শিকার হয়ে আছে এ দেশের নারী। রাজনৈতিক সদিচ্ছা, বহুমুখী পরিকল্পনা, নানা ধরনের কর্মসূচি, এমনকি নারীর সুরক্ষার জন্য বিশেষ আইনও আছে। তবে নেই যথাযথ প্রয়োগ, সমাজে, সংসারে, কর্মক্ষেত্রে নেই নারীবান্ধব পরিবেশ।
সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এ দেশের এক-তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠী দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। তার মধ্যে অতি দরিদ্রের সংখ্যা প্রায় দশ ভাগ। যে কোনো তথ্য-উপাত্ত, পরিসংখ্যানে এটা সুস্পষ্ট যে, দরিদ্র মানুষের অধিকাংশই নারী। বৈশ্বিকভাবে দারিদ্র্য পরিমাপে যে উপাদান ব্যবহৃত হয় তাতে শুধু দৈনিক মাথাপিছু এক ডলারের নিচে অথবা ২২০০ ক্যালরির কম হলে দরিদ্র হিসেবে ধরা হয়। দারিদ্র্যকে কি শুধু ক্ষুধা পরিমাপ করে বিবেচনা করা সম্ভব? আমাদের গ্রামে-গঞ্জে, বস্তিতে কত শত-সহস্র নারী বসবাস করেন যাদের হয়তো বা ক্ষুধা নিবৃত্তির উপায় আছে, কিন্তু নেই শিক্ষার সুযোগ, নেই স্বাস্থ্যসেবার নিশ্চয়তা। অপুষ্টি তাদের নিত্যসঙ্গী। জীবন ও জীবিকার অনিশ্চয়তা, ঘরে-বাইরে নিরাপত্তার অভাববোধ তাদের সর্বদা আচ্ছন্ন করে রাখে।
এখনও ঘরে-বাইরে যৌতুক, বাল্যবিবাহ, পাচার, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয় এ দেশের অসংখ্য নারী ও মেয়ে শিশুকে। তথ্য-উপাত্ত বলে, নারীর বিরুদ্ধে এসিড সন্ত্রাসের একটি বড় কারণ হচ্ছে জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধ। তার সঙ্গে ইদানীং যুক্ত হয়েছে নৈতিক মূল্যবোধের ক্রমবর্ধমান অবক্ষয়, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব মানবসন্তানের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে পদে পদে, রাস্তাঘাটে, পরিবারে, কর্মস্থলে সর্বত্র।
কিন্তু এত প্রতিকূলতার মধ্যেও এ দেশের মানুষের সংগ্রাম ও অর্জনের ইতিহাস কম নয়। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় অর্জিত হয়েছে ছেলে-মেয়ের সমতা, অন্যান্য স্তরেও নারীর দৃপ্ত পদচারণা লক্ষণীয়। তথাকথিত ‘দরিদ্র, স্বল্পোন্নত’ দেশের জন্য এ এক বিশাল অর্জন। এডুকেশন ওয়াচ গবেষণার মাঠ জরিপ থেকে দেখা যাচ্ছে, মেয়ে শিশুর শিক্ষা ও নারী শিক্ষার হার যেখানে বেশি, সেখানে সাক্ষরতার হারও বেশি। যে বাড়ির মা কোনো সময়ে কোনোক্রমে মাধ্যমিক স্তরে পৌঁছাতে পারেন, সে বাড়ির সন্তানরা কখনও নিরক্ষর হয় না, অপুষ্টিতে ভোগে না, বাড়ির সামগ্রিক কল্যাণ সেখানে ব্যাহত হয় না। বস্তুতপক্ষে বাংলাদেশে সাক্ষরতার হার যেটুকু বেড়েছে তার পেছনে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে মেয়ে শিক্ষার্থীর ক্রমবর্ধমান অংশগ্রহণ একটি বড় কারণ।
এত অর্জন, এত অবদান, এত উন্নয়নের পরও সর্বস্তরে নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এখনও বহুমাত্রিক সংগ্রাম করে চলেছে এ দেশের নারী। তাদের ক্ষমতায়নে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে অনেক কর্মসূচি আছে, রাজনৈতিক সদিচ্ছাও আছে। কিন্তু বিদ্যমান সমাজ কাঠামোয় এই ক্ষমতায়ন কতখানি সম্ভব? প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় ছেলে-মেয়ের সমতা অর্জিত হয়েছে ঠিকই কিন্তু মাঠপর্যায় থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যাচ্ছে ওপরের শ্রেণীগুলোতে, বিশেষ করে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষার আগে মেয়েদের ঝরে পড়ার হার ছেলেদের তুলনায় বেশি। এই হার হ্রাস পেতে পেতে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এসে মেয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা এক-তৃতীয়াংশ হয়ে যায়। উচ্চশিক্ষার কিছু কিছু ক্ষেত্রে, যেমন প্রকৌশল ও চিকিৎসা বিজ্ঞানে মেয়েদের অংশগ্রহণের হার উৎসাহব্যঞ্জক হলেও কৃষি বিজ্ঞান, বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষায় সে হার ৫ শতাংশেরও কম! বাংলাদেশের এই তরুণ নারী জনগোষ্ঠীর বিশাল অংশ এখনও মানবসামর্থ্য উন্নয়নের মূলধারায় আসতে পারেনি।
নারীর কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি বর্তমানে অনেক দৃশ্যমান। কিন্তু যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাব ও মজুরি বৈষম্য নারীর সম-অধিকার প্রতিষ্ঠায় আজও বাধা হয়ে আছে। রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে আমরা অনেকদূর এগিয়েছি। তৃণমূল পর্যায় থেকে সংসদ পর্যন্ত নারীর প্রতিনিধিত্ব অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় ভালো। তবে এখনও কোটা পদ্ধতি ও সংসদে পরোক্ষ ভোটে নারী সদস্য নির্বাচন সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে এসব বাধা উত্তরণে রাজনৈতিক সদিচ্ছা অবশ্যই প্রয়োজন তবে যথেষ্ট নয়। এ সদিচ্ছার দৃঢ় প্রতিফলন তখনই দৃশ্যমান হবে যখন সমনি�ত পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত হবে যথাযথ কৌশল, পর্যাপ্ত বিনিয়োগ, নিবিড় তত্ত্বাবধান ও নিরবচ্ছিন্ন মনিটরিং। আমরা সাম্প্রতিককালে জেন্ডার বাজেটিংয়ের ক্ষেত্রে সরকারের সদিচ্ছা দেখেছি তবে নারীবান্ধব কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বিভিন্ন পর্যায়ে এক ধরনের পুরুষতান্ত্রিক অনীহা প্রায়ই লক্ষণীয় হয়ে উঠছে। বিশেষ করে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীমূলক কর্মসূচিগুলোতে নারীকে নানাভাবে কম সুবিধা দেওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। এর সঙ্গে যখন দুর্নীতির করাল থাবা যুক্ত হয় তখন নারীর অধিকার আরও লঙ্ঘিত হয়।
তেভাগা আন্দোলনের ইলা মিত্র, সশস্ত্র সংগ্রামী প্রীতিলতা, নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার ধ্যান-ধারণায় এ দেশে নারীর মানবাধিকার আন্দোলন দানা বেঁধেছিল। বেগম সুফিয়া কামাল, শামসুন্নাহার মাহমুদ, তারামন বিবি, আর হেনা দাশের মতো নারী নেত্রীর সংগ্রামী জীবন আজও উজ্জীবিত করে চলেছে এ দেশের নারী সমাজকে। লাখ লাখ শহীদ আর মা-বোনের আ�ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার চেতনায় আমরা এখনও উদ্বুদ্ধ হই। কিন্তু এত আ�ত্যাগের মর্যাদা দিতে হলে, এত অর্জন ধরে রাখতে হলে নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই। আনন্দলোকে ভাস্বর হোক আমাদের সেই চেতনা, উজ্জীবিত হোক সেই বোধথ যে চেতনা, যে বোধ সব মানবসন্তানের মানবাধিকার রক্ষায় আমাদের সামনে চলার পথ দেখাবে।
(সংকলিত)