সাম্প্রতিক সময়ে শীর্ষ প্রশাসনিক দফতর সচিবালয়ে বিএনপিপন্থী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কমিটি গঠনের হিড়িক পড়ে গেছে। চারটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সরকারি দলের প্রার্থী হেরে যাওয়ার পর থেকে এ ধরনের তোড়জোড় ক্রমেই বাড়ছে। সচিবালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তারাসহ তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের নিয়ে গঠিত ৭টি সংগঠনের বৃহৎ মোর্চা সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদকে ইতিমধ্যে পুনর্গঠন করা হয়েছে। এই সংযুক্ত পরিষদের ব্যানারে থাকা ৭টি অঙ্গসংগঠনের মধ্যে তিনটি সম্প্রতি পুনর্গঠন করা হয়েছে। অবশিষ্ট চারটি গঠন করার পথে রয়েছে। এর মধ্যে প্রশাসনিক কর্মকর্তা সমিতি বা এও সমিতির নতুন কমিটির নেতাদের নাম এ সপ্তাহের মধ্যে প্রকাশ করা হবে। কমিটি গঠনের এই তোড়জোড়ে অংশ নেয়া কর্মকর্তা-কর্মচারী নেতাদের কয়েকজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, কর্মচারীদের বৃহত্তর স্বার্থে নির্দলীয়ভাবে শক্তিশালী কমিটি গঠন করা হচ্ছে। কিছু কমিটি ইতিমধ্যে হয়েছে, বাকিগুলো হওয়ার পথে। তবে এসব কমিটিকে পলিটিক্যাল কালার দেয়া সমীচীন হবে না। বরং বলতে পারেন সর্বদলীয় কমিটি। তারা ন্যায়সঙ্গত দাবি নিয়ে ভূমিকা রাখার চেষ্টা করবেন। বেশিরভাগ সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারী তাদের সঙ্গে আছেন। বর্তমানে দাবি আদায়ের নামে সচিবালয়ে যেসব সংগঠন কাজ করছে সেগুলো সরকারি দলের ধজ্বাধারী। তারা নিজেদের স্বার্থের বাইরে কিছুই করেননি।
এদিকে এ বিষয়ে জানতে চাইলে সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের মহাসচিব মোঃ রুহুল আমিন যুগান্তরকে বলেন, সচিবালয় সংযুক্ত পরিষদকে বিলুপ্ত করে গত বছর জুন মাসে সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারি ঐক্য পরিষদ গঠন করা হয়েছে। এই ঐক্য পরিষদের অধীনে ৭টি কর্মচারী সংগঠন সক্রিয় রয়েছে। কিন্তু এখন যারা ফের সচিবালয়ে সংযুক্ত পরিষদ গঠন করার পাঁয়তারা করছেন তারা প্রত্যেকে সরকারবিরোধী এবং বিএনপি ও জামায়াতপন্থী বলে পরিচিত। তিনি বলেন, গত সাড়ে চার বছরে এদের কাউকে দাবি নিয়ে কথা বলতে দেখা যায়নি। এখন বিশেষ উদ্দেশ্যে সচিবালয়ের মধ্যে বিশৃংখলা সৃষ্টি করাসহ ঐক্য পরিষদের ন্যায়সঙ্গত দাবি-দাওয়া আদায়ের উদ্যোগ বানচাল করতে সরকারবিরোধী কমিটি গঠন করা হচ্ছে। তিনি জানান, নতুন কমিটিতে যাদের নাম শোনা যাচ্ছে তাদের অনেকে ১৯৯৯ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে চাকরিচ্যুত হন। বিএনপি ক্ষমতায় এসে তাদের পুনর্বহাল করে। তাই তারা আবার কোনো গোলমাল করার চেষ্টা করলে ছাড় দেয়া হবে না। জানা গেছে, বিগত চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রশাসনিক কর্মকর্তা নুরুল আলম ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা আবদুল খালেকের নেতৃত্বে সংযুক্ত পরিষদ গঠন করা হয়। বিরোধের কারণে ওই সময় তাদের মধ্যেও কয়েক দফা পাল্টাপাল্টি কমিটি গঠন করার ঘটনা ঘটে। বিএনপি ক্ষমতা থেকে বিদায় নেয়ার পর সংযুক্ত পরিষদের কার্যক্রম এক প্রকার গুটিয়ে নেয়া হয়। এর মধ্যে নুরুল আলম অবসরে চলে গেছেন। এক বছর আগে আবদুল খালেক ১৯ দফা দাবি পেশ করে আবার হারিয়ে যান। এরপর গত নভেম্বরে তিনি পদোন্নতি পেয়ে সহকারী সচিব হয়েছেন। ফলে সংযুক্ত পরিষদের হাল ধরার মতো উপরের দুই শীর্ষ পদে কেউ নেই। এ রকম একটি অবস্থায় মে মাসের শেষদিকে সংযুক্ত পরিষদের মূল নেতৃত্ব পুনর্গঠন করা হয়। সাবেক ও বর্তমান নেতাদের উপস্থিতিতে কয়েক দফা বৈঠক করার পর পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পিও নজরুল ইসলামকে সভাপতি ও ধর্ম মন্ত্রণালয়ের এও মাহে আলমকে মহাসচিব মনোনীত করে সংযুক্ত পরিষদের মূল নেতৃত্ব গঠন করা হয়। এরপর পর্যায়ক্রমে সংযুক্ত পরিষদের অঙ্গসংগঠনগুলো পুনর্গঠন করার উদ্যোগ নেয়া হয়। মাঝখানে এ উদ্যোগ কিছুটা স্থগিত রাখা হলেও গত সপ্তাহ থেকে ফের জোরেসোরে শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে তিনটি কমিটি পুনর্গঠন করাসহ অবশিষ্ট চারটি কমিটি গঠনের জোর প্রস্তুতি চলছে।
নতুন কমিটি গঠন : নতুন কমিটি গঠনের আওতায় পিও সমিতির সভাপতি হয়েছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নজরুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক কৃষি মন্ত্রণালয়ের মোঃ কামাল হোসেন। স্টেনো টাইপিস্ট কর্মচারী সমিতির সভাপতি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের রেজাউল করিম ও সাধারণ সম্পাদক শ্রম মন্ত্রণালয়ের মোঃ আবদুল হান্নান। চতুর্থ শ্রেণী কর্মচারী সমিতির সভাপতি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও সাধারণ সম্পাদক অর্থ বিভাগের মোঃ আজিম উদ্দিন।
পুনর্গঠন হতে যাচ্ছে : এও সমিতি কমিটি গঠনের জন্য ইতিমধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা খন্দকার মনিরুজ্জামানকে আহ্বায়ক করে গত বুধবার ৫ সদস্যের একটি আহ্বায়ক কমিটি গঠিত হয়। কমিটির অপর সদস্যরা হলেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের জাহেদা নবী, স্থানীয় সরকার বিভাগের মোঃ জাহাঙ্গীর আলম, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বেলায়েত হোসেন ফারুকী এবং সদস্য সচিব ভূমি মন্ত্রণালয়ের আবদুল মতিন। বৃহস্পতিবার বিকালে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে এই কমিটির বৈঠক বসে। এতে আহ্বায়ক কমিটির সদস্যরা ছাড়াও বক্তৃতা করেন ভূমি মন্ত্রণালয়ের মোঃ আনোয়ার হোসেন বখতিয়ার, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সুলতান আহমেদ, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের মাহে আলম, স্থানীয় সরকার বিভাগের মঞ্জুর হোসেন, ভূমি মন্ত্রণালয়ের আবদুল হাই হাবিব, বিজ্ঞান মন্ত্রণালয়ের গাজী আবদুল হাফিজ, ভূমি মন্ত্রণালয়ের মোঃ মহসীন ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের হাবিবুর রহমান। সূত্র জানিয়েছে, এও সমিতির সভাপতি হতে পারেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সুলতান আহমেদ অথবা ভূমি মন্ত্রণালয়ের আনোয়ার হোসেন বখতিয়ার। এছাড়া সাধারণ সম্পাদক হতে পারেন ধর্ম মন্ত্রণালয়ের মাহে আলম। এ ছাড়া পুনর্গঠিত হতে যাচ্ছে অফিস সহকারী কর্মচারী সমিতি। বর্তমানে এই সমিতির সভাপতি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আখতার হোসেন এবং সাধারণ সম্পাদক তথ্য মন্ত্রণালয়ের সালাউদ্দিন আহমেদ। সচিবালয় কম্পিউটার অপারেটর কর্মচারী সমিতিও পুনর্গঠন করা হচ্ছে। এ সমিতির সভাপতি আইএমইডির আবু আলেম মিয়ার পরিবর্তে নতুন সভাপতি করা হচ্ছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আবুল মনসুরকে। এছাড়া আগের কমিটির সাধারণ সম্পাদক জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নজরুল ইসলাম স্বপদে বহাল থাকছেন। অন্যদিকে হিসাব কর্মচারী সমিতির পুনর্গঠন করা হবে। বর্তমানে এই কমিটি একেবারে স্থগিত আছে। সভাপতি নেই এবং সাধারণ সম্পাদক মোঃ তোয়াহা চাকরিচ্যুত আছেন।
এদিকে সচিবালয়ের সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যুগান্তরকে জানিয়েছেন, নবগঠিত সংগঠনের নেতাদের বেশিরভাগ সচিবালয়ে বিএনপি ঘরনার বলে পরিচিত। সরকারের শেষ সময়ে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হয়ে যাওয়ায় এবং ভবিষ্যতে বিএনপি ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা তৈরি হওয়ায় এরা নিজেদের অবস্থান জানান দিতে এখন কমিটি গঠন করে মাঠে নামছেন। অথচ গত পৌনে পাঁচ বছরে এদের কোন কার্যক্রম ছিল না। চারটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সরকারি দলের প্রার্থী হেরে যাওয়ায় এবং গাজীপুরেও ১৮ দলীয় জোটের প্রার্থীর জয়ের সম্ভাবনা থাকায় এরা তড়িঘড়ি মাঠে নামার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তারা বলেন, বাস্তবিক অর্থে কর্মচারীদের ন্যায্য দাবি আদায়ে এরা কেউ সংগঠন কিংবা আন্দোলন করেন না। সচিবালয় সমবায় সমিতি ও মগবাজারে অবস্থিত চতুর্থ শ্রেণী কর্মচারী সমিতির গদি দখলসহ ব্যক্তিগত স্বার্থ আদায়ের জন্য কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী দলীয় সাইনবোর্ড লাগিয়ে ঘুরেফিরে পাল্টাপাল্টি কমিটি গঠন করেন। বাতাস বুঝে এসব কমিটি গঠিত হয়, আবার বাতাস অনুকূলে না থাকলে কোনো ঘোষণা ছাড়াই কমিটির কার্যক্রম হারিয়ে যায়। কিন্তু ১৯৯৬ সালের পর থেকে সত্যিকারার্থে কর্মচারীদের স্বার্থে কেউ কাজ করছেন না। নেতাদের অনেকে হালুয়া-রুটির ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে ব্যস্ত। পছন্দের দল ক্ষমতায় এলে সচিবালয় সমবায় সমিতির দায়িত্ব পাওয়া যায়। এতে করে সকাল-দুপুর ফ্রি রসনা বিলাসী খাবার খাওয়া এবং বাড়তি পয়সা পকেটস্থ করার সুযোগ থাকে। মগবাজারের অফিস দখলে নিতে পারলে আরও পোয়াবারো। উপরন্তু, তদবির করে রাতারাতি ধনী হওয়ার পথ তো আছেই। আর নেতা হতে পারলে তো অনেকের অফিসের কাজই করা লাগে না।
ঐক্য পরিষদ চুপচাপ : সরকারপন্থী হিসেবে পরিচিত সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের সাংগঠনিক কার্যক্রম কিছুদিন থেকে এক রকম স্তিমিত অবস্থায় রয়েছে। সচিবালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তাদের (এওপিও) প্রথম শ্রেণীতে উন্নীত করাসহ কয়েক দফা দাবি আদায়ে সরকারকে আলটিমেটাম দিয়ে তারা অনেকটা পিছু হটেছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সমিতির একজন দায়িত্বশীল নেতা যুগান্তরকে বলেন, চারটি সিটি মেয়রের নির্বাচনে হেরে যাওয়ায় সরকার কিছুটা বেকায়দায় আছে। এ অবস্থায় তারা আবার নতুন করে সরকারকে চাপে রাখতে চান না। এ জন্য গত ২০ জুন তাদের দ্বিতীয় দফা আলটিমেটামের সময়সীমা পার হয়ে গেলেও কার্যত তারা চুপচাপ আছেন। ৬ জুলাই গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের ফলাফল দেখে তারা পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবেন।