বাবা নেই। মা থেকেও কাছে নেই। নাতির ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই মাত্র ছয় মাস আগে নানী রাহেলা খাতুন রায়হানকে (৯) ভর্তি করেছিলেন ময়মনসিংহ শহরতলী শম্ভুগঞ্জ এলাকার সরকারি শিশু পরিবারে। কিন্তু কয়েক মাস যেতে না যেতেই রায়হান ফিরলো লাশ হয়ে।
ভেবেছিলেন আদুরে নাতি পড়াশুনা শিখে মানুষের মতো মানুষ হয়ে একদিন তার কাছে ফিরে আসবে। ফিরে সে এসছে, তবে লাশ হয়ে। বুধবার রাতে সরকারি শিশু পরিবারে রহস্যজনক মৃত্যু হয় শিশু রায়হানের।
নিহতের পরিবার ও স্থানীয়দের দাবি, শারীরিক নির্যাতনের মাধ্যমে রায়হানকে হত্যা করা হয়েছে। এ হত্যাকাণ্ড ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে। আর তাই প্রভাবশালী মহলের চাপে হত্যাকারীদের খুঁজে বের না করে নাটক করছে পুলিশ।
তবে কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) গোলাম সরোয়ার জানান, নাটকের কিছু নেই। লাশের ময়নাতদন্ত রিপোর্ট হাতে পেলে বলা যাবে এটি হত্যাকাণ্ড না অন্য কিছু। প্রাথমিকভাবে সন্দেহের ভিত্তিতে বৃহস্পতিবার বিকেলে সরকারি শিশু পরিবারের সুমন (১৮) নামে এক ছাত্রকে আটক করা হয়েছে।
জানা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ময়মনসিংহ শহরতলী শম্ভুগঞ্জ এলাকার সরকারি শিশু পরিবারে (বালক) ভর্তি করানো হয় সদর উপজেলার আকুয়া মোড়লপাড়া এলাকার প্রয়াত লাল মিয়া ও শিল্পী বেগমের একমাত্র ছেলে রায়হানকে (৯)।
বৃহস্পতিবার সকালে সরকারি শিশু পরিবারের পক্ষ থেকে রায়হানের স্বজনদের তার মৃত্যুর বিষয়টি জানানো হয়। ওইদিন দুপুরে রায়হানের বাড়ি আকুয়া মোড়লপাড়া এলাকায় তার স্বজনদের হাতে লাশ পৌঁছে দেন সরকারি শিশু পরিবারের প্রশিক্ষক আজিজুর রহমান, মেডিকেল অ্যাসিসট্যান্ট সাইফুল ইসলাম ও ছাত্র মিজানুর রহমান।
কিন্তু রায়হানের নিথর দেহে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন স্পষ্টই জানান দেয় অমানুষিক শারীরিক নির্যাতনের মাধ্যমেই এ শিশুটিকে হত্যা করা হয়েছে। হত্যার এসব আলামতে ক্ষুব্ধ নিহত রায়হানের স্বজন ও স্থানীয়রা। এসময় এলাকাবাসী শিশু পরিবারের দু’কর্মকর্তা ও এক ছাত্রকে ঘেরাও করে বৃহস্পতিবার দুপুরেই পুলিশে সোপর্দ করে।
পরে জিজ্ঞাসাবাদের নাম করে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় কোতোয়ালি পুলিশ সরকারি শিশু পরিবারের দু’কর্মকর্তাকে ছেড়ে দিয়েছে। থলের বিড়াল বেরিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় এমনটি করা হয়েছে অভিযোগ রায়হানের স্বজনদের।
শিশু রায়হানকে হত্যা করা হয়েছে শুনে সাভারের গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি থেকে বাড়ি ছুটে এসেছেন মা শিল্পী বেগম। একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে তার কান্না থামছে না। আদরের নাতিকে হারিয়ে পাগলের মতো বিলাপ করছেন আর এ ঘটনায় জড়িতদের বিচার দাবি করছেন নানী রাহেলা খাতুন (৬০)।
রায়হানের মামা রাসেল জানান, রায়হানের মৃত্যু রহস্যজনক। অমানুষিক নির্যাতনের মাধ্যমেই শিশুটিকে হত্যা করা হয়েছে। তার সামনের দাঁত ও ঘাড় ভাঙা, হাত-পা, মুখ ও পুরুষাঙ্গসহ তলপেটে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।
রায়হানের মা শিল্পী বেগম (৩৫) ও নানী রাহেলা খাতুন (৬০) কান্নামিশ্রিত কন্ঠে জানান, শিশু সদনে যাওয়ার আগে রায়হানের শরীরে একটা আচরের দাগও ছিল না। শারীরিক নির্যাতনের মাধ্যমেই অবুঝ এতিম শিশুটিকে মেরে ফেলা হয়েছে।
সরকারি শিশু পরিবারে (বালক) ভর্তি হওয়ার আগে রায়হান থাকতেন আকুয়া মোড়লপাড়া এলাকার লাল মিয়ার বাড়িতে। লাল মিয়া বলেন, “আমার জানামতে ছেলেটার কোনো অসুখ-বিসুখ ছিল না। শারীরিক নির্যাতন করেই তাকে হত্যা করা হয়েছে।”
রায়হানের স্বজনদের দাবি, রায়হান হত্যাকাণ্ড ধামাচাপা দিতে জেলা সমাজসেবা অধিদফতর একটি প্রভাবশালী মহলকে মাঠে নামিয়েছে। ওই প্রভাবশালী মহল মামলা না করতে চাপ ও ভয়ভীতি দেখাচ্ছে রায়হানের স্বজনদের।
এদিকে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় শনিবার সকালে নিহত রায়হানের মা বাদি হয়ে আটক সুমনের নামে কোতোয়ালি মডেল থানায় একটি মামলা দায়ের করেন।