সংসদের বিরোধী নেত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, জাতীয় সংসদে এবারের মতো পরিবেশ আগে কখনও হয়নি। সংসদ মেঠো বক্তৃতা দেয়ার জায়গা নয়। কিন্তু শুরু থেকে যে বক্তৃতা দেয়া হচ্ছে তা খুবই লজ্জাকর। সরকারি দলের শীর্ষ নেতারা আমাদের জাতীয় নেতাদের সম্পর্কে যেসব ভাষায় কথা বলেছেন তার জবাব দেয়ারও রুচিবোধ আমাদের নেই। তিনি বলেন, আমরা তাদেরকে শুধু একটি কথা বলতে চাই। অনেক সময় নীরবতাই হচ্ছে নোংরামির উৎকৃষ্ট জবাব।
শনিবার বিকালে জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনে প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি এসব কথা বলেন।
খালেদা জিয়া বলেন, আমরা যদি গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে চাই তাহলে এই সংসদের পরিবেশ এতো কলুষিত কেন হলো? এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের খোঁজে বের করতে হবে। শুধু নবীন সদস্যদের দোষ দিয়ে তাদের বক্তব্য এক্সপাঞ্জ করে কোন লাভ হবে না।
তিনি বলেন, বিরোধী দলকে মূল্যায়ন করার কথা সংসদ নেতা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। অঙ্গিকার করেছিলেন, বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার নির্র্বাচিত করবেন। অন্যান্য প্রতিশ্রুতির সঙ্গে এই প্রতিশ্রুতিও সময়ের স্রোতে ভেসে গেছে। জাতীয় সংসদ ও বাইরে বিরোধী দলের সঙ্গে যে আচরণ করা হয়েছে তা দেশের ইতিহাসে কালো অধ্যায় হয়ে থাকবে। বিরোধী নেত্রীর তার বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানসহ প্রয়াত জাতীয় নেতাদের স্মরণ করেন।
খালেদা জিয়া যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বাংলাদেশী পণ্যের জিএসপি সুবিধা স্থগিতের বিষয় উল্লেখ করে বলেন, সরকারের ব্যর্থতায় এই সুবিধা বাতিল করা হলেও সরকারের পক্ষ থেকে এখন নানা ধরনের বিভ্রান্তিমূলক অপপ্রচার করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে- আমি এই সুবিধা বাতিলের জন্য চিঠি দিয়েছি। কিন্তু প্রকৃত সত্য হলো আমি এ ধরনের কোন চিঠি দেইনি। বরং আমি এ সুবিধা বহাল রাখতে বারবার বলেছি। এসময় সংসদে উপস্থিত সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদেশী পত্রিকায় প্রকাশিত খালেদা জিয়ার একটি নিবন্ধ তুলে দেখান। এসময় খালেদা জিয়া বলেন, আমি এ ধরনের কোন লেখা লিখিনি।
খালেদা জিয়া তার বক্তব্যে যুক্তরাষ্ট্রকে জিএসপি সুবিধা অব্যাহত রাখার আহবান জানিয়ে বলেন, আমি ইউরোপসহ অন্যান্য দেশের প্রতি অনুরোধ করবো তারা যেন যুক্তরাষ্ট্রের পথ ধরে জিএসপি সুবিধা বাতিল না করে। এটি করলে এদেশের সাধারণ শ্রমিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
খালেদা জিয়া তার বক্তব্যে হেফাজতে ইসলামের ৫ই মে’র অবরোধ পরবর্তী অবস্থানে সরকারি বাহিনীর অভিযানেরও কড়া সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, ওই দিনের সহিংসতা ও সংঘাতে সরকারির দলের কর্মী ও সরকারি বাহিনী জড়িত।
তিনি বলেন, ওই অভিযান নিয়ে মিথ্যাচার করছে সরকার। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে ওই দিন একটি গুলিও করা হয়নি। কিন্তু পত্র পত্রিকায় তথ্য এসেছে ওই দিন দেড় লাখ গোলাবারুদ ব্যবহার করা হয়েছে। বিদেশী পত্রপত্রিকায়ও তথ্য এসেছে। এই ঘটনায় সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে। শাপলা চত্বরের অভিযান সরাসরি সম্প্রচারের জন্য দুটি সংবাদ মাধ্যম বন্ধ করে দেয়া হয়।
ড. ইউনূস প্রসঙ্গে বিরোধী নেত্রী বলেন, তিনি সম্মানীত ব্যক্তি। কিন্তু তাকে অপমানিত ও অপদস্ত করা হয়েছে। গ্রামীণ ব্যাংককে ভেঙে ১৯ টুকরা করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এ কারণে আমরা ড. ইউনূস এবং গ্রামীণ ব্যাংকের পক্ষে আমাদের দৃঢ় অবস্থান প্রকাশ করেছি।
বিরোধী নেত্রী বলেন, দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ভয়াবহ। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদনে তা প্রকাশ হয়েছে। তাদের রিপোর্টে যে তথ্য এসেছে বাস্তবের চিত্র আরও ভয়াবহ। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গুম করার ভয়ংকর প্রক্রিয়া চলছে।
এইসব গুমের ঘটনা বাকশাল আমলে রক্ষীবাহিনী ও সরকারি বিশেষ বাহিনীর হাতে হাজার হাজার যুবক তরুণ হত্যার কথাই মনে করিয়ে দেয়।
তিনি বলেন, দলীয়করণ করার কারণে পুলিশ পেশাগত দায়িত্ব পালন করছে না। আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় র্যাব গঠন করেছিলাম। বিরোধী দল দমনে ব্যবহার করে এই বাহিনী নষ্ট করা হয়েছে। কোন ঘটনা ঘটলেই বিরোধী দলের হাজার হাজার নেতাকর্মীর নামে মামলা দেয়া হচ্ছে। পরে গ্রেপ্তারের ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায় করা হচ্ছে। এটি এখন ওপেন সিক্রেট। পুলিশ বাহিনীর নৈতিকত্থলন অশনি সঙ্কেত হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সংবাদ মাধ্যম ও সাংবাদিকতা শৃঙ্খলিত উল্লেখ করে বেগম জিয়া বলেন, গ্রেপ্তার হামলা ও হুমকির শিকার হচ্ছে সাংবাদিকরা। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনিকে হত্যা করা হয়েছে। আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সাংবাদিক কর্মচারীরা অনিশ্চিত জীবন যাপন করছেন। আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে নির্যাতন চালানো হচ্ছে। সরকারের অনিয়ম দুর্নীতি তুলে ধরার কারণে তার ওপর এ নির্যাতন করা হচ্ছে। তিনি বলেন, আমার দেশ খোলে দেয়ার দাবিতে সম্পাদকরা বিবৃতি দিয়েছেন। আমরাও পত্রিকাটি খুলে দেয়ার দাবি জানাচ্ছি। রাজধানীতে সভা-সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞার সমালোচনা করে খালেদা জিয়া বলেন, আমরা জনগণকে নিয়ে রাজধানীতে সভা-সমাবেশ করতে পারি না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজধানীতে সভা-সমাবেশেরওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। এমনকি মানববন্ধন পর্যন্ত করতে দেন না। এই যদি হয় গণতন্ত্রেও অবস্থা। এক পর্যায়ে আসরের নামাজের বিরতির জন্য বিরোধী নেতার বক্তব্য থামিয়ে দেয়া হয়। নামাজের পর আবার তিনি বক্তব্য রাখেন।
বিরোধী নেত্রী বলেন, মানুষ আজ আতঙ্কিত। ছাত্রলীগ ও যুবলীগ মানুষের কাছে মুর্তিমান আতঙ্কের নাম। মানুষ দ্রব্যমূল্যের কষাঘাতে জর্জরিত।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তুলে ধরে বিরোধী নেত্রী বলেন, শাসক দলের পক্ষ থেকে যুক্তি দেখানো হয় যে সরকারের আমলে যেসব নির্বাচন হচ্ছে তা সুষ্টু হয়েছে। উপজেলা ও ইউপি নির্বাচনে অনিয়ম ও জালিয়াতির অভিযোগ তুলেন তিনি। খালেদা জিয়া বলেন, সিটি করপোরেশন নির্বাচনও সুষ্টু হয়নি। এই নির্বাচন যদি আরও সুষ্টু হতো তাহলে আপনাদের জামানত বাজেয়াপ্ত হতো। নির্বাচনে পুলিশ এবং গুন্ডা বাহিনী দিয়ে যে সন্ত্রাস ও কারচুপি করা হয়েছে তার তথ্য আমাদের কাছে আছে।
তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক বিষয়ে উচ্চ আদালতে সরকার যে আটজন এমিকাস কিউরি নিয়োগ দিয়েছিল তাদের সাতজনই তত্ত্বাবধায়ক রাখার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। আপিল বিভাগের সংক্ষিপ্ত রায়েও জাতীয় স্বার্থে আরও দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক রাখার কথা বলা হয়েছিল।
তিনি বলেন, নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুর সমাধান সরকারকেই করতে হবে। কারণ সাংবিধানিক পরিবর্তনের ক্ষমতা সরকারি দলের আছে। এই ক্ষমতা বিরোধী দলের নেই। তিনি বলেন, আমাদের অবস্থান আমরা কোন দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবো না। তবে আমরা সংঘাত চাইনা। আমরা মনে করি আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা যাবে। বিরোধী দলের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে আপনারা বাধ্য হবেন।