ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শতাধিক জাতীয় সংসদ সদস্য এবার মনোনয়নবঞ্চিত হতে পারেন। সম্প্রতি সরকার ও দলের পক্ষ থেকে চালিত পৃথক পৃথক জরিপের কারণে এক থেকে দেড়শ’ সংসদ সদস্য ভাগ্যবিড়ম্বিত হওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে। এসব জরিপে দেখা গেছে, এমপি এলাকায় জনবিচ্ছিন্ন, দুর্নীতি ও অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত এবং দলে স্থানীয় নেতাকর্মীদের সমর্থন হারানো। কিছু কিছু এলাকায় সরকারদলীয় এমপিদের অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে। বেশ কিছু এলাকায় ক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা এমপিদের ওপর চড়াও হন। বিপুল বিজয় নিয়ে ক্ষমতায় আসার পর এলাকার মানুষের প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ না করা, দলের নেতাকর্মীদের দূরে ঠেলে দিয়ে সব ক্ষেত্রে আত্মীয়করণ, দুর্নীতি ও অনিয়মের সঙ্গে নিজে এবং আত্মীয়-স্বজনদের সম্পৃক্ততার কারণে এমপিরা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র যুগান্তরকে জানায়, জনবিচ্ছিন্ন এ ধরনের এমপিরা দলীয় মনোনয়ন পাচ্ছেন না।
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে সাবেক এক সচিবের নেতৃত্বে একটি টিম, দলের সাংগঠনিক সম্পাদকদের রিপোর্ট এবং সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা বর্তমান এমপিদের হালহকিকত জানতে সারাদেশে পৃথকভাবে জরিপ চালায় বলে জানা গেছে। এসব জরিপের পৃথক পৃথক সুপারিশ প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে দেয়া হয়েছে। তিনি জরিপের ফলাফল মূল্যায়ন করছেন। প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা এসব কাজে সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করছেন। এদিকে অবসরপ্রাপ্ত একজন সামরিক কর্মকর্তা ও গবেষকের নেতৃত্বেও পৃথক একটি টিম সারাদেশে জরিপ কার্যক্রম চালাচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ওই টিমকে এ কাজে সহযোগিতা করছে। খুব শিগগিরই অবসরপ্রাপ্ত ওই সামরিক কর্মকর্তার নেতৃত্বাধীন টিমের কাজ শেষ হবে বলে জানা গেছে। এ কর্মকর্তাও জানিয়েছেন, সরকারি দলের এমপিদের করুণ দশার কথা।
গত বছর ১৯ মে ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের এমপি ক্যাপ্টেন (অব.) গিয়াস উদ্দীনের গাড়ি ভাংচুর করে স্থানীয় নেতাকর্মীরা। এ সময় তিনি পিস্তল উঁচিয়ে জনতাকে ধাওয়া করেন। আগের বছর গফরগাঁওয়ে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে গিয়াস উদ্দীনের উদ্দেশ্যে জুতা ছুঁড়ে মারে কর্মীরা। যশোরের এমপি ও জাতীয় সংসদের হুইপ শেখ আবদুল ওহাবের ওপরও হামলার ঘটনা ঘটে। গত বছর কুমিল্লার এমপি সুবিদ আলী ভূঁইয়ার বাড়িতে হামলা হয়। এ সময় ওই এমপি তার বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। ছুঁড়ে মারা পাথরে তিনি সামান্য আহত হন। গত বছর ১ সেপ্টেম্বর নরসিংদীর শিবপুরে স্থানীয় এমপি জহিরুল হক ভুঁইয়া মোহনকে অনুষ্ঠানের অতিথি না করায় তার সমর্থকরা ওই অনুষ্ঠানে গিয়ে ফাঁকা গুলি ছোঁড়ে। পরে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীরা তাকে এলাকায় অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে। গত বছর গাইবান্ধার এমপি ফজলে রাব্বী মিয়াকে তার এলাকার দলের নেতাকর্মীরা সংবাদ সম্মেলন করে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন। সুনামগঞ্জের এমপি মোয়াজ্জেম হোসেন রতনকেও তার এলাকার নেতাকর্মীরা অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন।
জরিপ রিপোর্টগুলো থেকে জানা গেছে, জাতীয় সংসদের উপনেতা, ফরিদপুর-২ আসনে নির্বাচিত সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী, শেরপুর-২ আসনে নির্বাচিত মতিয়া চৌধুরী, দলের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, চাঁদপুর-১ আসনে নির্বাচিত ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর, চাঁদপুর-৩ আসনে নির্বাচিত পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মনি, দলের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য ও প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী, ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন (ফরিদপুর-২) আরেক উপদেষ্টা ও অর্থমন্ত্রী, আবুল মাল আবদুল মুহিত (সিলেট-১), আওয়ামী লীগের শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক ও শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ (সিলেট-৬), পানিসম্পদ মন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেন (ঠাকুরগাঁও-১), আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক এবং পরিবেশ ও বনমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ (চট্টগ্রাম-৬), স্বাস্থ্যমন্ত্রী সংসদ সদস্য আফম রুহুল হক (সাতক্ষীরা-৩), আবুল হাসান মাহমুদ আলী (দিনাজপুর-৪), তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তফা ফারুক মোহাম্মদ (যশোর-২), চরম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে রয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি, পানিসম্পদ মন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেন ও ত্রাণমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলীর। ডা. দীপু মনি এবার চরমভাবে দলীয় নেতাকর্মীদের প্রতিরোধের মুখে পড়বেন বলে আশংকা করা হচ্ছে। হয়রানিমূলক মামলা ও হামলার অভিযোগ রয়েছে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিরুদ্ধে। পানিসম্পদ মন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেন ও ত্রাণমন্ত্রী মাহমুদ আলী জনবিচ্ছিন্ন। রমেশ চন্দ্র সেন এলাকার উন্নয়নে যেমন কোনো ভূমিকা রাখেননি, তেমনি নেতাকর্মীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। ত্রাণমন্ত্রী মাহমুদ আলী সম্পূর্ণরূপে জনবিচ্ছিন্ন। কারণ তিনি এলাকায় যান না।
জরিপ রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী জেলার অবস্থা বেশি নাজুক। মানিকগঞ্জ-৩ (জাহিদ মালেক) ছাড়া অন্য দুই আসনের বর্তমান সংসদ সদস্যরা নির্বাচিত হতে পারবেন না। নারায়ণগঞ্জ-২ (নজরুল ইসলাম বাবু) ছাড়া অন্য চারজন এমপি’র মধ্যে তিন আওয়ামী লীগের এমপির অবস্থা শোচনীয়। কুমিল্লা-৫, ৭ ও ১০ ছাড়া অন্য আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্যদের অবস্থা খুবই খারাপ। চাঁদপুর-৫ এর সংসদ সদস্য মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম বীরউত্তম ছাড়া অন্যদের অবস্থা শোচনীয় বলে মন্তব্য করা হয়েছে। চট্টগ্রাম-৫, ৮ ও ১২ ছাড়া সবগুলোর অবস্থা নাজুক বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে।
চার সিটি কর্পোরেশনে পরাজয়ের পর প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাও তার দলের এমপিদের শোচনীয় অবস্থার কথা স্বীকার করেন। এ সময় তিনি জানান, এবার এক থেকে দেড়শ’ এমপিকে তিনি দলীয় মনোনয়ন দেবেন না। বিষয়টি স্বীকার করে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, আগামী নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নের ক্ষেত্রে ব্যাপক রদবদল আনা হবে। প্রাধান্য দেয়া হবে নিষ্কলুষ (ক্লিন) ইমেজের অধিকারী তরুণ ও নতুন মুখকে।
আরও যেসব এমপির অবস্থা নাজুক : দিনাজপুর-৩ (সদর) ইকবালুর রহিম, দিনাজপুর-৬ আজিজুল হক চৌধুরী, লালমনিরহাট-১ মোতাহার হোসেন (প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী), রংপুর-৫ এইচএন আশিকুর রহমান, কুড়িগ্রাম-৪ জাকির হোসেন, গাইবান্ধা-২ মাহাবুব আরা বেগম গিনি (প্রধানমন্ত্রীর আত্মীয়), গাইবান্ধা-৫ ফজলে রাব্বি মিয়া, বগুড়া-৫ হাবিবুর রহমান, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এনামুল হক (বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী), নওগাঁ-১ সাধন চন্দ্র মজুমদার, নওগাঁ-৩ আকরাম হোসেন চৌধুরী, রাজশাহী-১ ওমর ফারুক চৌধুরী (শিল্প প্রতিমন্ত্রী), রাজশাহী-৩ মেরাজ উদ্দিন মোল্লা, রাজশাহী-৪ এনামুল হক (এনা প্রপার্টিজের মালিক), রাজশাহী-৫ আবদুল ওয়াদুদ দারা, নাটোর-২ আহাদ আলী সরকার (ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী), সিরাজগঞ্জ-৩ ইসহাক হোসেন তালুকদার, সিরাজগঞ্জ-৪ শফিকুল ইসলাম, পাবনা-১ শামসুল হক টুকু (স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী), পাবনা-৩ মকবুল হোসেন, মেহেরপুর-১ জয়নাল আবেদীন, কুষ্টিয়া-১ আফাজ উদ্দিন আহমেদ, ৩ রশীদুজ্জামান ও ৪ বেগম সুলতানা তরুণ, চুয়াডাঙ্গা-১ সোলায়মান হক জোয়ার্দার সেলুন, যশোর-৩ খালেদুর রহমান টিটো, যশোর-৪ রণজিৎ কুমার রায়, যশোর-৬ শেখ আবদুল ওহাব (হুইপ), নড়াইল-২ এস কে বাকের, খুলনা-৩ প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান, খুলনা-৫ নারায়ণচন্দ্র চন্দ, বরগুনা-১ ধীরেন্দ্র চন্দ্র দেবনাথ, পটুয়াখালী-৩ গোলাম মাওলা রনি, বরিশাল-২ মনিরুল ইসলাম, ঝালকাঠি-১ বজলুল হক হারুন, পিরোজপুর-১ এ কে এম আউয়াল, ২ অধ্যক্ষ শাহ আলম, টাঙ্গাইল-৬ আবদুল বাতেন, শেরপুর-৩ এ কে এম ফজলুল হক, ময়মনসিংহ-৩ মজিবুর রহমান ফকির, ৬ মোসলেম উদ্দিন, ৭ রেজা আলী এবং ১০ গিয়াস উদ্দিন আহমেদ, ১১ মোহাম্মদ আমান উল্লাহ, নেত্রকোনা-২ আশরাফ আলী খান খসরু, নেত্রকোনা-৩ মঞ্জুর কাদের কোরাইশী, কিশোরগঞ্জ-৫ আফজাল হোসেন (আফজাল সু), গাজীপুর-৩ অ্যাডভোকেট রহমত আলী, ৫ মেহের আফরোজ চুমকি (মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী), নরসিংদী-৩ জহিরুল হক ভূঞা মোহন, শরীয়তপুর-১ বিএম মোজাম্মেল হক, সুনামগঞ্জ-১ মোয়াজ্জেম হোসেন রতন, সিলেট-২ শফিকুর রহমান চৌধুরী এবং সিলেট-৩ মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী। ঢাকার প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান খান ও অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, নসরুল হামিদ বীপু, অ্যাডভোকেট সানজিদা খানম, মিজানুর রহমান খান দীপু, রাশেদ খান মেনন (১৪ দল), জাহাঙ্গীর কবির নানক, কামাল আহমেদ মজুমদার, মুরাদ জং ও বেনজীর আহমদের অবস্থা শোচনীয় বলে ওই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে।