রাজধানীর খিলগাঁওয়ের রিয়াজবাগে বাসায় আগুনে পুড়ে বড় ছেলেসহ এক দম্পতির করুণ মৃত্যু হয়েছে। সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছেন ছোট ছেলে মাহমুদুল হাসান। তিনি আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ব্যবসায় প্রশাসনে (বিবিএ) পড়েন।
গতকাল বৃহস্পতিবার ভোর পাঁচটার দিকে এ মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। এ সময় বাসার সবাই ঘুমিয়ে ছিলেন।
মৃত ব্যক্তিরা হলেন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সাবেক উপপরিচালক সিরাজউল্লাহ (৫৮) ও তাঁর স্ত্রী কানিজ ফাতেমা (৪৫) এবং তাঁদের সন্তান রাশিদুল হাসান ওরফে শিফাত (২৬)।
সিরাজউল্লাহ অবসরের পর জাপানের সাহায্য সংস্থা জাইকার কনসালট্যান্ট ছিলেন। তাঁর গ্রামের বাড়ি ফেনীর ছাগলনাইয়ায়। টেলিযোগাযোগ প্রকৌশলী রাশিদুল একটি বেসরকারি কোম্পানিতে কাজ করতেন। পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস ধারণা করছে, সিরাজ-ফাতেমা দম্পতির ঘরে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে আগুন লাগে।
১৩৯৮/৩/বি রিয়াজবাগে সিরাজউল্লাহর দোতলার ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখা যায়, তিনটি শোয়ার ঘরের দুটির আংশিক মালপত্র পুড়ে গেছে। বাসার পূর্ব-উত্তরের সিরাজউল্লাহর শোয়ার ঘরের সিলিং ফ্যান পুড়ে বাঁকা হয়ে গেছে। এই ঘরের খাট, তোশক, জাজিম, কাপড়চোপড় ও দরজা পুড়ে গেছে। জানালার কাচ পুড়ে টুকরা টুকরা হয়ে পাশের টিনের ঘরের ওপর পড়েছে।
সিরাজউল্লাহর ঘর থেকে বেরিয়ে ডাইনিং পেরিয়ে যেতে হয় রাশিদুলের ঘরে। রাশিদুলের ঘরে গিটার-কম্পিউটার পুড়ে কুঁচকে গেছে। পুড়ে গেছে বসার কক্ষের বৈদ্যুতিক সুইচ বোর্ড, একটি টেবিল ও সোফার অংশবিশেষ।
রাশিদুলের শয়নকক্ষের সঙ্গে বসার কক্ষ। বসার কক্ষ পেরিয়ে পশ্চিম-উত্তরের কক্ষটিতে থাকতেন ছোট ছেলে মাহমুদুল। তাঁর কক্ষ, ডাইনিং ও রান্নাঘর ছিল অক্ষত।
সিরাজউল্লাহর গাড়িচালক জসিমউদ্দিন তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে ওই ভবনটির পাশে একটি টিনের ঘরে ভাড়া থাকেন। জসিমের স্ত্রী চম্পা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ভোর পাঁচটার দিকে বিকট শব্দে তাঁর ঘুম ভেঙে যায়। মনে হচ্ছিল, টিনের চালায় বোমা ফেটেছে।
শব্দে তাঁর আশপাশের বাসিন্দারাও জেগে যান। তিনি বলেন, ‘বাসা থেকে বাইরে এসে দেখি স্যারের (সিরাজউল্লাহ) ফ্ল্যাট থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। এরপর সবাই মিলে বাড়ির দারোয়ানকে জাগিয়ে তুলে গেইট খুলে দোতলায় উঠি।’
চম্পা জানান, তাঁরা বাসায় ঢুকে দেখেন সিরাজ-ফাতেমা দম্পতি তাঁদের ঘরের দরজার কাছে ও রাশিদুল ডাইনিংয়ের মেঝেতে দগ্ধ হয়ে পড়ে আছেন। সিরাজ-ফাতেমা দম্পতির ঘরের ফ্যান, খাট ও টিভিতে আগুন জ্বলছিল। সবাই মিলে দ্রুত দগ্ধদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, সকাল সাড়ে সাতটার দিকে কানিজ ফাতেমাকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান সিরাজউল্লাহ। রাত সাড়ে আটটার দিকে ওই হাসপাতালে মারা যান রাশিদুল।
সিরাজউল্লাহর ভায়রা এলাহাম কনক কান্নাজড়িত কণ্ঠে প্রথম আলোকে জানান, হাসপাতালে নেওয়ার সময় দগ্ধ রাশিদুল তাঁকে বলেছেন, পোড়া গন্ধে তাঁর ঘুম ভেঙে যায়। তাঁর দম আটকে আসছিল। কোনোমতে তিনি উঠে মা-বাবার ঘরের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু কোনো একটা কিছুর সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যান। এরপর চেষ্টা করেও আর উঠে দাঁড়াতে পারেননি।
এলাহাম জানান, সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া তাঁর আরেক ভাগনে মাহমুদুল তাঁকে বলেছেন, তাপ ও ধোঁয়ার ঝাঁজে তাঁর দম বন্ধ হয়ে আসছিল। তিনি কোনোমতে দরজা খুলে বাইরে বেরোতে সক্ষম হন। কিন্তু পরে ঘরে ঢোকার চেষ্টা করলে ধোঁয়ার ঝাঁজে ঢুকতে পারেননি। মা, বাবা ও ভাইকে হারিয়ে মাহমুদুল শোকে পাথর হয়ে গেছেন। তিনি কোনো কথা বলছেন না।
ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণকক্ষের কর্তব্যরত কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী বলেন, বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে। ফায়ার সার্ভিসের দুটি গাড়ি আধা ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। তিনি জানান, শর্টসার্কিট হলে বৈদ্যুতিক তারগুলো পুড়ে আগুন ছড়িয়ে পড়ে।
রাতে যোগাযোগ করা হলে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (অভিযান) মেজর মোহাম্মদ মাহবুব প্রথম আলোকে বলেন, টেলিভিশন বিস্ফোরিত হলে সিরাজ-ফাতেমা দম্পতির ঘরে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। একই সময় আরেক কক্ষে কম্পিউটার বিস্ফোরিত হলে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। বৈদ্যুতিক গোলযোগে এ ধরনের বিস্ফোরণ ঘটে। অনুসন্ধানের পর এ বিষয়ে আরও নিশ্চিত করে বলা যাবে।
পুলিশের মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার মোহা. আশরাফুজ্জামান বলেন, এ মৃত্যু নিয়ে পরিবার কোনো অভিযোগ করেনি। এ ব্যাপারে রামপুরা থানায় অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে। এর পরও পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো অভিযোগ করা হলে সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।