সোহানের স্বপ্ন ভেঙ্গে গেল এক প্রলয়ঙ্করী ধাক্কায়। জীবনে তার পিছন ফিরে তাকাতে হবে ভাবেনি। ছোট বোন স্বপ্ন, মা-বাবার সাথে জীবনের স্বপ্নগুলোর একেকটি রঙিন ইটের গাঁথুনি দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। তার বাবা আরমান মিয়া ক্রিকেট পাগল ছিলেন বলে জন্মের পূর্বেই ছেলের নাম রেখেছিলেন সোয়েব আক্তার। কিন্তু মায়ের কাছে নামটি ততো ভাল লাগেনি। তাই নামটি বাদ না দিয়ে শেষের অংশে সোহান যোগ করে দিল। আরমান মিয়া স্বপ্ন দেখতো বড় হয়ে সোহান একদিন বড় ক্রিকেটার হবে। তাই জন্মের পর যখন সুযোগ পেত খেলনার নামে বাসায় ক্রিকেট সামগ্রী নিয়ে আসতো। ক্রিকেটের সরঞ্জামাদি দেখেই মা সালেহা বেগম তেলে বেগুনে জ্বলে উঠতো। তবুও তার কিছুই করার ছিলনা। যত রাগ ক্ষোভ আরমান মিয়ার উপর দেখালেও ছেলের আনন্দের জন্য খেলনাগুলো নষ্ট করতেন না। সব কিছুর পরও তিনি গার্মেন্টেস্রে সুই-সুতা দিয়ে জামা-কাপড় বুনতে বুনতে ছেলের স্বপ্নও বুনতেন। দেখতেন ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হবে। ইঞ্জিনিয়ার হতে হলে কি করতে হবে তা তিনি জানতেন না। কিন্তু এতটুকু জানতেন স্কুল-কলেজে ছেলেকে ভাল ভাবে পাশ দিতে হবে। এটিও জানতেন তাকে অনেক বেশি বিষয় জানতে হবে। মুখস্থ রাখতে হবে অনেক বিষয়।
সোহান যখন কথা বলতে শুরু করলো তখন থেকেই অ-আ—১-২ শিখতে শুরু করল। নানা রঙের বই, কাগজ দিয়ে ঘর বোঝাই করতেন সালেহা বেগম। যাতে একটি নষ্ট হলেই আরেকটি নিয়ে ছেলেকে খেলতে দিতে পারে এবং শিখাতেও পারে নানা বর্ণ-শব্দ আর রঙের নাম। সবচেয়ে বড় কথা তিনি বিশ্বাস করতেন সব বই বা রঙ-এ ছেলে মজা নাও পেতে পারে। তাই রুচি পরিবর্তনের মাধ্যমে হলেও ছেলেকে পড়ার মধ্যেই রাখতে হবে। আর মা-বাবার স্বপ্নকে পূরণ করার মতই ছেলেটি ছোট বেলাতেই মেধার পরিচয় দিতে থাকল। সোহান আচরণেও ভাল ছিল বলেই এটা সেটার জন্য খুব বেশি একটা বায়না ধরতো না।
সালেহা সব সময় এমনভাবে চলতো মনে হয় তার সাথে অভাব অনটনের কোন মোলাকাত হয় না। নিজের জীবনের কষ্টটি কাউকে বলতে পারতেন না। ছোটবেলায় অজপাড়া গাঁয়ে তার বড় হয়ে উঠা। তার বাবা মানুষের গাছ পরিস্কার করে সংসার চালাতো। একদিন হঠাৎ গাছের মগঢাল ভেঙ্গে পড়ে হারিয়ে গেল একটি পা। সালেহার এপাড়া ওপাড়া আনন্দে ঘুরে বেড়ানো বন্ধ গয়ে গেল। স্কুলও প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। কখনো খাবারের অভাবে মা তাকে পাঠিয়ে দিত পাশের ডোবা থেকে শালুক তুলে আনতে বা রাস্তার ধারের কচু তুলে আনতে। আর সালেহাও জানতো স্কুলে গেলে সবাইকে সেদিন না খেয়েই থাকতে হবে। বয়স দশ এগারো পার হয়নি, কিন্তু বাবার দায়িত্ব তার ঘাড়ে। সংসার কোনভাবেই চলতে চায় না এত অভাবে। প্রায়ই মায়ের বকুনি, গ্রামের মানুষের নানান কথা, দিনদিন তার কচি মনকে ক্ষতবিক্ষত করে তুলছিল। আবার কখনো কখনো খেয়াল করে দেখে বাবা একাকী কাঁদছে, অথচ পাশে কেউ নেই। জীবনের দৃষ্টিসীমা একেবারেই শূন্যের কোঠায়। দিগন্তহীন হতাশা সালেহার বাবাকে গ্রাস করে ফেলেছে। হয়তো চলে যেতে চাইছে না ফেরার দেশে। কিন্তু বিধাতার খেলা, নিয়তির বন্ধনে যন্ত্রণা সহ্য করা ছাড়া আর কিছুই নেই। মেয়েকে নিয়ে তার কত স্বপ্ন ছিল এখন সে হিসাব তিনি মেলাতে পারছেন না। যে সালেহাকে ছাড়া তার এক বেলাও চলতে চাইতো না, সে সালেহাকে কাছে ডেকে আনতে তার সাহস হয়না। কী অধিকারে মেয়েকে কাছে ডাকবে? মেয়ের উপর নির্ভরশীল তিনি ! বুকফাটা কান্নায় ভাসিয়ে দিতে চায় মন, কিন্তু নিজের লজ্জা অক্ষমতা তাকে তা করতে দেয়নি কখনো।
সেই একানব্বই কী বিরানব্বই সালের কোন এক বিকেলে পাশের বাড়ির আরমান মিয়ার বাবা-মা ছেলেসহ সালেহাদের বািড় আসলো। আরমানের বয়স তখন পনের কী ষোল। আরমানের মা-বাবা দুজনেই সত্যিকার অর্থে ভাল মানুষ। কখনো অন্যের প্রতি অকৃতজ্ঞ হতে বা অন্যের ক্ষতিতে অভ্যস্ত ছিল না। কিছুদিন আগেও এই আরমানের বাবার ছোট একটা ব্যবসা ছিল। কিন্তু স্থানীয় মাস্তানদের যন্ত্রণায় একদিন সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে। আরমানের বাবার টাকায় একসময় অনেকের সংসার চলতো। সে মানূষটি সব হারিয়ে মাঝে মাঝে না খেয়েও দিন পার করতেন, কেউ এসে একটু জিজ্ঞাস করার প্রয়োজনও মনে করতেন না। সে মানুষটির দুর্দিনে সামর্থ না থাকলেও সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল এই সালেহার মা-বাবা। তাই আজ আবার ছেলের কল্যাণে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হওয়ায় সালেহাদের দুর্দিনে পাশে থাকার ইচ্ছা নিয়েই তারা এসেছেন। সবকিছু ছাপিয়ে সালেহাদের ঘরে আজ আনন্দের শেষ নেই। তাদের ঘরে কেউ কখনো ভুলেও উঁকি মারেনি, কিন্তু আজ একজন সফল মানের পুরো পরিবার তাদের ঘরে। তাদের চেহারা দেখে বুঝার উপায় নেই দুঃখই তাদের সাথী।
দৈন্য দশায় আপ্যায়ন করতে না পারায় কিছুক্ষণ পর সালেহার মায়ের সবই যেন বিবর্ণ হয়ে গেল। সবকিছু আরমানের মা সহজে বুঝতে পারায় সালেহার মাকে পরম মমতায় বুবু বলে কাছে ডেকে এনে জীবনের গল্প শুনাতে লাগল। গল্পের সাবলীলতার জন্য বোঝার উপায় নাই আরমানের মায়ের কোন হতাশা বা কষ্টবোধ আছে কিনা। তার কথায় বরাবরের মতই দৃঢ়তা প্রকাশ পেয়েছে। তিনি বললেন জানেন বুবু আরমানের বাবা যখন সব হারালো আমরাতো ধরেই নিয়েছি আমাদের সব স্বপ্ন বুঝি শেষ হয়ে গেল। ভেবেছিলাম আরমানের পড়াশোনা আর কোনদিনও হবে না। হয়েছেও তাই। কিন্তু ছেলে আমার মানিক, বুকের ধন। কথাগুলো বড় আবেগ নিয়েই তিনি বললেন যেন কন্ঠ প্রায় আটকে যাচ্ছিল। তিনি তার পর বললেন, সে একদিন কইল, মা এমনে বাঁচনের থাইক্যা লড়াই কইরা বাঁচন অনেক ভাল। মা আমি ঢাকায় যামু। সেখানে যে কাপড় ফ্যাক্টরি আছে সেখানে কাজ করুম। সেখানে নাকি কাজ পাওয়ন সহজ। দেখি না মা কাম যদি পাওয়ন যায়। ছেলের কথা শুইনাতো বুবু আমি তাজ্জব। ছেলের কি মাথা খারাপ হইয়া গেল নাকি। কিন্তু ছেলে নাছোড়বান্দা। সে যাইবোই। সত্যি ছেলে একদিন চলে গেল বাড়ি ছেড়ে। তারপর কেমনে কেমনে কী কইরা কাম কাইজ জোগায়ে নিছে ভাল জানি না। তয় বুবু আরমান ভাল আছে বলেই আমরাও সুন্দর করে থাকতে খাইতে পারতেছি। এখন দেখ বুবু আমাগো খুঁইজা খাওয়ন লাগে না। কথাগুলো সালেহার মাকে মন্ত্রের মত টানছে। তবুও জিজ্ঞাস করতে ইচ্ছে হলো বুবু মাঝেতো তোমগো অভাবের কথা মাইনসের কাছে শুনি। কিন্তু কথাগুলো বলতে না পারলেও জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা বুবু তোমাগো সব ঝামেলা কি মিইট্যা গেছে। কথাগুলো শুনে আরমানের মা মোটেও ধাক্কা খায়নি, কারণ সেই পুরোনো দিনের কথা আর মাঝে সব হারিয়ে যাওয়ায় মানুষের কাছে হাতপাতার দিনগুলো তার জানা আছে। আর এখন আরমানের কল্যাণে অবস্থার অনেক পরিবর্তন তা সবার জানা নেই। তাই একেকজন নানা মন্তব্য করতে পারে তাতে কান দিলেই ঝামেলা। সালেহাদের সাম্প্রতিক দূর অবস্থার কারণে তাদের বাড়ির সাথে খুব একটা যোগাযোগ নেই বলে মানুষের কথায় বিশ্বাস করতে হয়েছে।
সব শুনে আরমানের মা কেবল এটুকুই বলল, দেখ বুবু তুমিতো সবই জান। আরমানের বাবা কোন কালেই অন্যের কাছে হাত পাততে ঠিক অভ্যস্থ না। আর যাই হোক একবেলা না খেলেও অন্যের কাছে হাত পাততে হয়না, দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে তিনি আরও বললেন, এটা ঠিক ছেলেডারে ঠিকমতো খাওয়া দিতে, কাপড়- চোপড় দিতে পারিনি। তার শখ মিটাতে কিছু করতে পারি নাই। তয় বুবু ছেলেডা আমার খুব ভালা, খুব ভালা। হে অন্যের মতো বিরক্ত করে না কাউরে। তবে দুঃখ বেশি আরমানের বাবার জন্য, হেতো জান বুবু কত শখ করতো। এখন হে কেবল সারাদিন ঘরে পইরা থাকে। কোথাও যায় না, কাম না থাকলে। তয় কি বুবু জান তানারে কখনো আমি দু:খ করতে দেখি নাই। সবসময় কয় দেখ আরমানের মা আর যাই হউক আমরাতো অনেক মানুষের চেয়ে ভাল আছি। দেখ ঐ পাড়ার মরণের বাপ চুরি কইরা কতবার ধরা পড়ছে আর মাইর খাইছে। হেতো স্বাদে চুরি করে না, অভাবে মাইয়া দুইডারে যহন খাওয়ন দিতে পারে না তহন হের মাথা খারপ হইয়া যায়। হাত পাতলেও কেউ কিছু দিতে চায় না। তহন হে এই কাম করে।
কথাগুলো কত মনোমুগ্ধকর অবস্থায় শুনতেছে সালেহার মা তা বুঝা গেল তার প্রতিক্রিয়া দেখেই। তিনি যে কথা শুনতে শুনতে নিজের মধ্যে স্বপ্নের বিশাল রাজ্য ও রাজপ্রাসাদ তৈরী করলো তার হিসাব নেই। একটি তুলনা করলেই মনে হবে এ যেন বাকিংহাম রাজপ্রাসাদ।
আরমানের মায়ের কিছু নীরবতা যেন সালেহার মায়ের স্বপ্ন যাত্রার ব্যঘাত ঘটালো। তার পরই জানতে চাইলো আচ্ছা বুবু তোমার আরমান যেখানে কাম করে হেইখানে আমাগো সালেহারে কাম দেওয়ন যায় না? হেতো এহন অনেক বড় হইয়া গেছে। আর কিছু না হোক মাইয়াডার কষ্টতো নিজে দেখুম না। হের কষ্ট আর সহ্য অয় না। দেখ বুবু (হঠাৎ আরমানের মায়ের একটি হাত দিয়ে ধরে আচমকা সালেহার মায়ের বুকে রাখলো) পুরো কইলজাডা পুইরা জ্বইলা গেছে। ভাইঙ্গা চুইরা টুকরা টুকরা হইয়া গেছে সব। এমন পরিস্থিতিতে আরমানের মা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেছে। অনেকটা করুণ সুরে বললো দেখ বুবু তোমাগো দু:খ আমি বুঝি। কিন্তু আমার কি করনের আছে কও তো? আর সালেহার কামের বিষয়ে আমিতো ভালো কইতে পারুম না। আরমানের বাবারে জিগাইয়া লই, হেই ভাল কইরা কইতে পারবো। তাছাড়া আরমানইতো আছে।
সালেহার মা কথাগুলো শুনে অনেকটা অপ্রস্তুত অবস্থায় বলল, দেহেন বুবু আপনিতো জানেন আমি কখনো আরমানের বাপ তানার সামনে গিয়া কথা কই নাই। তাছাড়া সালেহার বাবারে একবার কইয়া লইলে ভালা অইতো না? আরমানের মা সালেহার মাকে বুঝতে পেরেছিল। তাই বললেন, ভাল অইতো, কিন্তু আরমানতো আবার বেশি সময় থাকতে পারবো না। হে চইলা যাইবো। তাছাড়া সালেহার বাবাওতো উনার সামনে আছেন। মনে সাহস পেলেও কেমন যেন লজ্জা পেয়ে বসলো। আরমানের মা হাত ধরে টেনে নেয়ার সময় সালেহার মা লম্বা করে ঘোমটা টেনে মাথা নিচু করে পাশের রুমে নিয়ে গেল দু’জনকে এমন অবস্থায় দেখে, আরমান ও সালেহার বাবার ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো, আর নিজেদের মধ্যে চলতে থাকা আলোচনা বন্ধ করে দিল।
কয়েক মুহূর্ত এভাবেই পার হতেই আরমানের বাবা বলে উঠল, কী ভাবী সাহেবান আপনাদের ঘরে এসে বসে আছি সেই কখন থেকে কিন্তু আপনার দেখাই পেলাম না। সালেহার বাপ না থাকলেতো এতক্ষণ থাকতেই পারতাম না। যাক্গে ভাবী, কেমন আছেন? কেমন যাচ্ছে দিনক্ষণ? এইতো যাচ্ছে ভাই, প্রতিউত্তরে সালেহার মা বললো, যাচ্ছে কোন রকম। তাছাড়া ভাই আপনিতো সবই জানেন। তা ভাই, আপনে কেমন আছেন? আছি এই তো। আল্লাহ ভালই রাখছে। ভাই সত্যি কখনো ভাবি নাই আপনার মতো মানুষ আমাগো বাড়িতে আসতে পারেন। কেন ভাবী, আমি কী আর আপনাদের পর? এছাড়া আপনাদের কীভাবে ভুলে থাকি? না, তা হয়তো পারেন না। এহন ভাই আপনারে কী খাইতে দিবো? ও সালেহার বাপ দেহেন না ভাইজানের জন্য কিছু করন যায় কিনা। আচ্ছা ভাবী এতো উতালা হবার কোন কারণ নাই। বসেন তো ভাবী। এরপর নিজেই লজ্জা পেলেন। কারণ ঐ রুমে কোন চেয়ার বা টুল কিছুই নাই যে আরমানের মাকে দিবে বসতে। সার্বিক অবস্থা আরমানের মা পরিস্থিতি সামাল দিয়ে বলল শোনেন আরমানের বাপ, আমরা এখানে একটা বিশেষ কামে আইছি। আপনেই পারেন কামডা সমাধা করতে।
আরমানের বাপও বুঝতে পেরে নিজেকে একটু প্রস্তুত করে নিল। এর পরই বলল, কী কাম করন লাগবো, বল? দেখি যদি আমারে দিয়া করা সম্ভব হয় তয় তানাদের জন্য করুম। না, কামডা তেমন কিছু না। এই আমাগো সালেহাতো মাশাল্লা বড় হইয়া গেছে————-, । তয় তোমরা কি তাকে এক্ষণি বিয়া দিতে চাইছ! সোজা কইয়া দিলাম মাইয়াডার বয়স খুব একটা হয় নাই। হের বয়স আর কতো হইবো- বার কী তেরো! না আমি ঠিক হেই রকম কিছু ভাবি নাই। তয় কী ভাবছ সোজা বলে ফেল। আচ্ছা শোনেন আমাগো আরমান যেখানে কাম করে সেখানেতো হুনলাম মাইয়ারাই বেশি কাম করে। তয় সেখানে কী আমাগো সালেহারে দেওন যায় না? ওহ্! এ…..ই কথা! কিন্তু মাইয়ার বয়সতো কম, অত ছোড মাইয়ারে কি পাডানো ঠিক অইবো? কেন বয়স কমতো কি অইছে? আমাগো আরমান আছে না? সেই সবকিছু কইরা দিবো। তাছাড়া এই বাড়ী ঐ বাড়ী যাওনের চেয়ে এডা কী অনেক বেশি ভালো না? আর যাই হউক ভাবীরতো মাইয়াডার কষ্ট দেখতে অইব না। আপনেতো জানেন এই গ্রামে কিছু পশুতো আছেই, হেরা এডা হেডা কইয়া বেড়ায় মাইয়াডারে লইয়া। থাক্ আরমানের মা এগুলান এখন আর কওন লাগবো না। কথাগুলো আরমানের বাবার ভাল লাগলো। তিনি তখন বললেন, ঠিক আছে তোমরা ভিতরে গিয়া বহ, আমি সালেহার বাপ আরমানের লগে কথা কইয়া কি করণ লাগবো দেখছি। খুশিতে আরমানও সালেহার মা ঘর থেকে বেড়িয়ে পড়লো।
টানা কথাবার্তার পর সিদ্ধান্ত হলো- আরমান এবার শহরে গিয়া খোঁজ খবর নিবে, যদি কোন সুযোগ পায় তবে সালেহাকে সে নিয়ে যাবে। সেদিনের মত সবাই এ সিদ্ধান্ত নিয়ে যার যার কাজে ফিরে গেল।
কিছুদিন পর আরমান আবার বাড়ি এলো। এসেই বাবাকে জানালো সালেহার জন্য একটা কাজ ঠিক করে এসেছে। মাসে সাতশত টাকা পাবে। তার কাজ হলো কেবল কাপড়ের বোতাম লাগানো। আরমানের বাবা খুশি হলেও আশঙ্কা কাজ করছিল তার মাঝে, যদি গ্রামের মানুষ অন্যভাবে দেখে। তবে তার সারা জীবনের সম্মান ধূলায় মিশে যাবে। সেদিন রাতে খাবার শেষে আরমানের মা-ই কথা উঠালো সালেহার যাবার বিষয়ে। কথাবার্তার এক পর্যায়ে আরমানের বাবা বললেন, দেখোতো বিষয়টা আরেকবার চিন্তা করা যায় কিনা? মাথে সাথেই আরমানের মা প্রতিবাদের সুরে বলল, কিসের চিন্তা আরেকবার? আপনে আসলে কী ভাবছেন, কইবেনতো? কোন সমস্যা কী নতুন কইরা অইছে? না, তেমন কোন সমস্যা নয়। তবে কেমন জানি মনে হয় আমাদের ছেলে আর সালেহা দু’জনেই বড় হইতেছে। এমন সময় কি দু’জনকে একসাথে ঢাকায় পাঠানো বা যাইতে দেয়া ঠিক অইবো? কেন ঠিক অইবো না? তারা তো আর এক সাথে থাকবো না? তা ঠিক আছে, কিন্তু গ্রামের মানুষতো তা বুঝবে না। তারা সব সময়ই এটা সেটা বলে বেড়াবে। তাছাড়া আমাদের দোষ দিবো বেশি। তাচ্ছিল্যের সাথেই আরমানের মা জবাব দিলো, বলুকগে। তাদের কথায় কি আসে যায়? তোমারে তো এরাই পথে বসাইছে। তারাতো কখনো তোমার বিপদে আগাইয়া আসে নাই। আর সালেহারা যে না খাইয়া দিন পার করতাছে, কোথায় কেউতো আগাইয়া আসে নাই, কেন? তাইলে তাগো কথা ক্যান-আমাগো কান দিতে অইবো? তারাতো কেবল অন্যের দোষ গাইতেই ব্যাস্ত। কারো উন্নতি দেখলেই কেবল এডা হেডা বইলা বেড়ায়। আমি অত কথা বুঝি না। ছেলেডা মাইয়ার একটা কাম ঠিক কইরা আইছে, এবার যাওনের সময় তারে লইয়া যাইবো- এডাই আমার শেষ কথা। এখন আপনার কাম সব ঠিক করন। আর মাইনসে যদি কিছু কয় তাহলে দরকার হইলে মাইয়াডারে পোলার লগে বিয়া দিয়া ঘরে আনুম। কিন্তু ঐসব মাইনসের কথা শুইন্ন্যা লাভ নাই। হেরা কখনো আমাগো পাশে ছিল না । একমাত্র আপনে যখন টাকা কামাইতেন তখন সাহায্যের জন্য আপনার পা চাটতো। এখন মধু শেষ সবাই পুরুত করছে।
আরমানের বাবা বুঝতে পারলো আরমানের মা সালেহার যাওয়ার বিষয়ে অনঢ়। অবশেষে সিদ্ধান্ত নিল রাতেই সালেহাদের বাড়ি গিয়ে সালেহাকে তৈরী হতে বলবে। কিন্তু কেন জানি সে রাতে যাওয়া হয়নি। পরদিন সকালেই আরমানের বাবা গিয়ে সব খুলে বললো এবং সালেহাকে পরদিন ঢাকায় যাবার প্রস্তুতি নিতে বলল। অজানা শঙ্কার মধ্যেই সালেহা পরদিন বাড়ি ছাড়লো। পরনে ভাঁজ করা নোংরা কাপড়, এক পায়ে জোড়া লাগানো হলুদ ফিতার একটি সেন্ডেল, এবং অন্য পায়ে লাল ফিতা লাগানো সেন্ডেল পরে বাড়ি থেকে বের হলো। সাথে বুক ভরা স্বপ্ন নিয়ে সে আরমানের সাথে সবার দৃষ্টিসীমা অতিক্রম করলো।
দেখতে দেখতে বেশ কিছু মাস চলে গেল। আরমানের বাবার মন মেজাজ খুব বেশি একটা ভাল যায় না বর্তমানে। বলা যায় তিনি আবার একঘরে হয়ে পড়েছেন। এমনও শোনা যায় তার সাথে চলাফেরা করলে ঈমানটাই যাবে- এমন কথাও কেউ কেউ গ্রামে বলে বেড়ায়। আর এসব কথা তিনি সহ্য করতে পারতেন না। তবুও ধর্মের বিষয় বলে একটা কথা আছে। তিনি একদিন পাশের রাইসুদ্দির ছেলে বড় মাওলানার কাছে গিয়ে জেনে আসলেন এসব কথায় কান না দেয়াই ভাল। তবে তিনি এও বলেছেন যদি দু’পরিবার একমত হন তবে আরমান আর সালেহার বিয়া দেয়াই ভাল। কারণ ছেলে মেয়ের বয়স বাড়ছে খুব করে।
বিষয়টি তিনি অনুধাবন করলেন। সিদ্ধান্ত নিলেন সালেহার মা-বাবার মুখে একটু হাসি আসলেই তাদের বিয়ে দিবেন। কয়েক মাস পর করলেনও তাই।
আরমান আর সালেহার বিয়ের দেড় বছর পর সালেহার কোল জুড়ে এলো সোহান। অনেক স্বপ্ন তাদের। ছেলের মঙ্গলের জন্য খুব একটা গ্রামেও যাননা তারা। সোহান মা-বাবার পরম যতেœ পড়াশোনায় চমৎকার রেজাল্টও করল পঞ্চম শ্রেণিতে। বৃত্তি পাওয়ায় তাদের মনে আনন্দের সীমা পরিসীমা থাকলো না। আর সে সময়েই সোহানের একটি বোন হলো। আরমানই তার নাম দিলো স্বপ্ন। কিন্তু স্বপ্ন জন্মের সময় সালেহা একটু অসুস্থ থাকায় চাকুরিটা হারাতে হলো। রাগ করে আরমানও সে ফ্যাক্টরিতে কাজ ছেড়ে দিল। কর্মঠ বলে সহজেই তিনি সাভারের একটি গামের্ন্টে চাকুরি পেয়ে গেলেন। সালেহা সুস্থ হবার পর সেও একই ভবনে অবস্থিত অন্য একটি কোম্পানীতে কাজ নিল। ইতিমধ্যে আরমানের বাবা এবং সালেহার মা সব ছেড়ে নাজানার দেশে চলে গেলেন।
স্বপ্ন সত্যি স্বপ্ন দেখাতে শুরু করলো। সোহানও তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে লাগলো। এসএসসি, এইচএসসি পরীক্ষায় ভাল ফলাফল করেছে সে। কিন্তু বাবার ইচ্ছা ইঞ্জিনিয়ার হবে সে। তবে রাজনীতি পছন্দ না। কষ্ট করে হলেও ছেলেকে একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করালেন।
বয়সের ভার নোয়তে পারেনি আরমান মিয়া ও সালেহা বেগমকে। ছেলে ও মেয়ের খরচ জোগাতে দু’জনে অতিরিক্ত সময় বাড়িয়ে দিল কাজে। কেবল বুক ভরা আশা তাদের কাজের উৎস। ভাগ্যান্বেষায় যে সংগ্রাম যুগ যুগ ধরে করে আসছে তার অবসান চায় তারা। চায় সমাজে একটু জায়গা করে নিতে। দৃঢ় প্রত্যয় তাদের কাজে। সততা ও কর্মই পুঁজিই তাদের। দেখতে দেখতে স্বপ্নও ইতিমধ্যে অনেক বড় হয়ে গেল। সামনেই এসএসি পরীক্ষা দিবে। সংসারে বলা যায় কোন ঝামেলা নেই। তেমন ভাল পরতে-খেতে না পারলেও সুখ ও শান্তি দু’ই পরিবারে ছিল।
সব কিছু ছাড়িয়ে সেদিন ছিল বুধবার। ঘুম থেকে উঠেই সোহান বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। শুরুতে স্বপ্ন সোহানকে বলল, ভাইয়া দেখ আজ আমার কেমন জানি লাগছে। স্কুলে যেতে ইচ্ছে হয় না। সোহানও তার কথায় সায় দিয়ে বলল আজ আমার পরীক্ষা না হলে আমিও যেতাম না। কি আর করা- যাই বেড়িয়ে পড়ি। তবে মা-বাবাকে বলিস আজ ওভার টাইম করার দরকার নেই। আজ বিকেলে আগে ফিরলে কোথাও সবাই একটু ঘুরে আসবো। স্বপ্ন মনে হয় স্বপ্নই দেখছে। অবশেষে সেও স্কুলে গেল। তার পিছন পিছন সোহানও রওনা হলো। আরমান ও সালেহাও আজ সকালে অনেকটা নিস্প্রভ। কেউ ঠিকমতো ছেলেমেয়ের খোঁজ খবর নেয়নি সকালে। হরতাল থাকার পরও দু’জন কাজে গেলেন। না গেলে চাকুরিটাই চলে যেতে পারে। ভবন মালিক আর কারখানার মালিকেরা কেন এমন খারাপ হয় তা তাদের জানা নেই।
কারখানায় ঢোকার সময় আরমান ও সালেহা কখনো হাত ধরে নি । কিন্তু আজ অজান্তেই দু’জন হাত ধরেই ঢুকলো। এমন দৃশ্য দেখে আশে পাশের সহকর্মীরা একটু আধটুকু বাঁকা হাসি দিল তাদের উদ্দেশ্যে। তাদের ভ্রুক্ষেপ করার কোন সুযোগ নেই। নিজেদের মতো করেই যে যার ফ্লোরে কাজে চলে গেল। কিছুক্ষণ পরই বিদ্যুত চলে গেল। কিছুক্ষণ পরেই মহাঝাকুনি দিয়ে জেনারেটর চালু হলো। প্রলঙ্করী ঝড় সবার উপরে। নয়তলা ভবনের ছাদ একটি অন্যটির উপর ধসে পড়লো। আর্তচিৎকার, গোঙানি, আর মৃত্যুর শব্দ ও বাচাঁর বৃথা আকুতি চারদিকে।
নিমিষেই সবকিছু শেষ হয়ে গেল। কত প্রাণ ধ্বংস হলো কেউ জানে না। নিরীহ মানুষেরা ছুটে এলো উদ্ধার কাজে। চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো মৃত্যুকুপের ধ্বংসলীলার কথা। সোহান-স্বপ্নও জানতে পারলো ভয়াবহতার কথা। কিন্তু তারা জানে না তাদের মা-বাবা কেমন আছে। সোহান পরীক্ষা ফেলে ছুটে এলো সাভারে, হাত লাগালো উদ্ধার কাজে মা-বাবাকে খুঁজে পাবার আশায়। কত মা-বাবাকে খুঁজে পাওয়া গেল জীবিত ও মৃত অবস্থায়। তিনদিন ধরে তাদের মা-বাবাকে খুঁজে পাওয়া গেল না। এক সময় সোহান একটি নুপুর পড়া নিথর আটকে থাকা পা দেখলো। দেখেই তার চোখে পানি চলে এলো, আর নিজের মধ্যে প্রশ্ন জেগেছে এই পা কি তবে পুরো জাতিকে লাথি মেরে ধিক্কার জানিয়ে দিল। নুপুর দেখেই সোহান চিনতে পারলো এটি তার মা-সালেহা বেগম। কিন্তু বাবাকে খঁজে পাওয়া গেল না। আজরাঈল সেদিন থাবা দিয়ে কত মানুষের জীবন একসাথে নিয়ে গেল তার হিসাব নেই। হয়তো তার বাবাও সে দলের একজন।
খোলা মাঠে স্বপ্নকে জড়িয়ে ধরে কেবল আর্তচিৎকার করে বলল কী অপরাধ ছিল আমার বাবা- মায়ের? কেন তাদের আজরাঈলের হাতে তুলে দেয়া হলো? তার মায়ের লাথিতে কি সব শয়তানের মাথা চুর্ণ হবে? কীইবা হবে স্বপ্ন আর তাদের জীবনের? কোথায় যাবে তারা? কেউ কী ফিরে তাকাবে তাদের জীবনে?