গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন পরিণত হয়েছে প্রধান দুই জোট প্রার্থীর রাজনৈতিক মাঠে টিকে থাকার অস্তিত্বের লড়াইয়ে। তাই আটঘাট বেঁধে রাতদিন মরিয়া হয়ে ছুটছেন দুই প্রার্থী। গাজীপুর ও টঙ্গী আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগামীতে গাজীপুর ও কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক মাঠে টিকে থাকতে হলে এ নির্বাচনে জয়লাভ করতেই হবে দলীয় প্রার্থীকে। এটা তাদের জন্য হয়ে দাঁড়িয়েছে চ্যালেঞ্জ। ১৪ দল সমর্থিত প্রার্থী অ্যাডভোকেট আজমত উল্লাহ। সিটি নির্বাচনে জিততে না পারলে এখানেই তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার হতে পারে শেষ। হারাতে পারেন জেলা আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক পদও। অন্যদিকে, বিএনপি নেতৃত্বধধীন ১৮ দলীয় জোট সর্মথিত প্রার্থী, সাবেক প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নানের অবস্থাও একই। গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক পদমর্যাদার একজন বাংলানিউজকে বলেন, “গাজীপুর জেলায় আজমত উল্লাহ একজন পরীক্ষিত নেতা। জেলা আ’লীগের এই সাধারণ সম্পাদক দীর্ঘদিন টঙ্গীর পৌর মেয়র ছিলেন। তার একটি আলাদা ইমেজ রয়েছে।” তিনি জানান, গাজীপুর সদর ও টঙ্গী নিয়ে গাজীপুর-২ সংসদীয় এলাকা। ২০০৪ সালে ৭ মে এই আসনে সংসদ সদস্য আহসান উল্লাহ মাস্টার খুন হওয়ার পর অনুষ্ঠিত উপ-নির্বাচনে আজমত উল্লা খান মনোনয়ন পাননি। আহসান উল্লাহ মাস্টারের ছেলে জাহিদ আহসান রাসেন দলীয় মনোনয়ন পেয়ে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন। এরপর ২০০৮ সালে জাতীয় নির্বাচনে আজমত উল্লা খান ফের মনোনয়নে নেওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। এ নির্বাচনে জাহিদ আহাসান রাসেল দ্বিতীয়বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে মেয়র পদে থেকে পদত্যাগ করে গাজীপুর-১ (কালিয়কৈর) থেকে নৌকা প্রতীক নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন জেলা আ’লীগের সভাপতি আ ক ম মোজ্জাম্মেল হক। ফলে আজমত উল্লা খানের এমপি হওয়ার স্বপ্ন স্বপ্নই যায়। গাজীপুর-১ ও গাজীপুর-২ থেকে দলীয় মনোনয়ন না পাওয়ায় কোণঠাসা হন আজমত উল্লাহ খান। টঙ্গী ও জয়দেবপুর মিলে গাজীপুর সিটি করপোরেশন হওয়ায় বিলুপ্ত হয় টঙ্গী পৌরসভা। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ পৌর মেয়র সমিতির সভাপতি। দলীয় সূত্রে জানা যায়, আগামীতে জেলা আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক পদ ও গাজীপুরের ৫ আসনের কোথাও থেকে তাকে মনোনয়ন দেওয়া হবে এমন আশ্বাস দেওয়া হয়েছে তাকে। তাই আজমত উল্লাহ নির্বাচনে জয় না আনতে পারলে জেলার পদ চলে যেতে পারে জাহাঙ্গীরের পকেটে। এছাড়া গাজীপুর-২ (টঙ্গী) আসনে তার মনোনয়ন পাওয়া প্রায় অনিশ্চিত। কারণ এখানে জাহিদ আহসান অনেক জনপ্রিয়। এছাড়া অন্য যেকোনো একটি আসন থেকে মনোনয়ন চাইবে জাহাঙ্গীর। জিসিসি নির্বাচনে মেয়র পদে দলীয় সমর্থন পাওয়া নিয়ে আজমত উল্লাহ বিতর্ক বর্তমান। গাজীপুর সদর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচনে বাংলাদেশে সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে নির্বাচিত জাহাঙ্গীর আলম (২ লাখ ১১ হাজার)। এই অবস্থায় আজমত উল্লাহ খান জিসিসি মেয়র নির্বাচিত না হতে পারলে জেলার সাধারণ সম্পাদক পদ হারাতে পারেন এমনও শোনা যাচ্ছে। ফলে জিসিসি নির্বাচন আজমত উল্লাহ খানের জন্য রাজনৈতিক মাঠে থাকার অস্তিত্বের লড়াই। এ বিষয়ে জেলা আ’লীগের সভাপতি আ ক ম মোজাম্মেল হক বাংলানিউজকে বলেন, “এই হিসাব এখন করার সময় নয়। এখন দলীয় প্রার্থীকে কীভাবে জেতানো যায় সেটি নিয়ে আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করছি। তবে নির্বাচনে জয়লাভ করতেই হবে। কারণ এটা তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের জন্য চ্যালেঞ্জ।” অন্যদিকে, বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী অধ্যাপক এমএ মান্নান ১৯৯১ সালে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে গাজীপুর সদর আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী করা হয় তাকে। এই সরকারের শেষ সময়ে এসে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। ১৯৯৬ সালে জাতীয় নির্বাচনে আহসান উল্লাহ মাস্টারে কাছে হেরে যান তিনি। ২০০১ সালে দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে বিএনপি জোট প্রার্থীর হাসান উদ্দিন সরকারের বিপরীতে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন। হাসান উদ্দিন নির্বাচনে পর তৎকালীন যুগ্ম মহাসচিব পদ থেকে বহিষ্কার হন। ২০০৪ সালে গাজীপুর-২ সদর উপ-নির্বাচনে বহিষ্কার আদেশ প্রত্যাহারের মাধ্যমে নির্বাচন করে জাহিদ আহসান রাসেলের কাছে বিপুল ভোটে হেরে যান। এই নির্বাচনে হাসান উদ্দিন সরকার গোপনে মান্নানের বিরুদ্ধে কাজ করেন। ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গাজীপুর-৩ (শ্রীপুর) আসনে আ’লীগের প্রার্থী অ্যাডভোকেট রহমত আলীর কাছে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে হেরে যান। অপর দিকে গাজীপুর-২ আসনে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে মহোজোট প্রার্থী হাসান সরকার জাহিদ হাসান রাসেলের কাছে হেরে যান। বিএনপি দলীয় সূত্রে জানা যায়, খালেদা জিয়া অধ্যাপক মান্নানকে গাজীপুর-৩ থেকে সরিয়ে গাজীপুর সিটির মেয়র পদে নির্বাচন করার জন্য মনোনীত করেন। সেখানে নতুন প্রার্থীর খোঁজ করেছেন তিনি। আর হাসান উদ্দিন সরকারকে গাজীপুর-২ (সদর ও টঙ্গী) মনোনীত করেন। মান্নান সিটির মেয়র নির্বাচিত না হতে পারলে জাতীয় নির্বাচন থেকেও বঞ্চিত হতে পারেন। জানতে চাইলে হাসান উদ্দিন সরকার বাংলানিউজকে বলেন, ‘‘মান্নান দলীয় চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা। একটি স্থানীয় নির্বাচনে হার বা জয়ের জন্য তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে কিছু যায় আসে না। তবে এই নির্বাচনে তার গাজীপুরের রাজনীতিতে টিকে থাকার জন্য একটা চ্যালেঞ্জ।” এ অবস্থায় মহাজোট প্রার্থী অ্যাভোকেট আজমত উল্লাহ খান ও ১৮ দলীয় জোট প্রার্থী এমএ মান্নান যেই মেয়র নির্বাচনে পরাজিত হবেন, তারই রাজনৈতিক অস্তিত্ব হারানোর আশঙ্কা করছেন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা।