গোয়ালা আব্দুল হান্নান। ধামাইচ বাজার সংলগ্ন নদীর ঐপার নওখাদা গ্রামে বাড়ি। প্রতিদিন সন্ধ্যায় নদী সাতরে খবর শুনতে আসে ধামাইচ বাজারের এক চায়ের দোকানে। গত ৫ জুন বুধবার প্রতিদিনের মত কাজ শেষ করে সন্ধ্যার আগেই চায়ের দোকানে টেলিভিশনের সামনে বসে আছে। নতুন অর্থবছরের বাজেট অধিবেশন দেখবে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত সংসদ পার্লামেন্টে তার বাজেট পেশ করছে। ষাটের উর্ধ্বে ওই গোয়ালা মনোযোগ সহকারে তা শুনছে। তিনি কার কাছ থেকে শুনছে এ বছরের মধ্যেই তাদের জন্য সেতুর বরাদ্দ হয়েছে। তাও নাকি এ অর্থবছরের বাজেটে সঙ্গেই। এ কারনে অধিরআগ্রহে টেলিভিশনের সামনে বসে আছে তাদের সেতু বরাদ্দের খবর নিতে। কিন্তু সময় চলে যায় তার সেতু বরাদ্দের খবর না পেয়ে তার মুখখানি যেন হতাশায় কালো হয়ে গেছে। তখন ক্ষোভেই টেলিভিশনে সামনে বলে উঠলো ‘কত বাজেটি করছেন, আমাগোরে ব্রীজের জন্য একটা বাজেট দেন না মন্ত্রীসাব’।
তার হতাশার কারন,- তার নিজের কোন গাভী নেই। প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকা ঘুরে সস্তা দরে দুধ কিনেন। তা ধামাইচ বাজারে এনে একটু বেশী মূল্যে বিক্রি করেন। এ থেকেই তার সংসার চলে। তাকে ধামাইচ বাজারে আসতে গুমানি নামে একটি নদী পার হতে হয়। ¯্রােতের টানে দুধের কৌটা ভাসিয়ে ধামাইচ বাজারের ঘাটে উঠে। কাত হলেই গুমানীর পানি ঢুকে পড়ে দুধের কৌটায়। ফলে পরিমানে বেশী হয়ে যায় তার কৌটার দুধ। তখন গোয়ালা বুঝতে পারে তার কৌটার ভেতরে পানি ঢুকেছে। বিড়¤^নায় পড়ে যান তিনি। তখন সততা দেখাবে না দুধ বিক্রি করবে। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে যায় গোয়ালা আব্দুল হান্নান। একদিকে সততা রাখতে গেলে না খেয়ে থাকতে হবে গোয়ালার পরিবারকে। আরেকদিকে দুধ বিক্রি না করলে ঋনের টাকা শোধ হবে না। এভাবেই দিশেহারা হয়ে পড়েন তিনি। নদীটির কারনে আরও বিভিন্ন সমস্যায় পড়তে হয় তাকে। শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রী, কৃষক, ব্যবসায়ী সহ বিভিন্ন শ্রেনী পেশার মানুষকে থমকে দেয় ¯্রােতধারা এ গুমানী নদী।
সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার সগুনা ইউনিয়নের ধামাইচ হাট পয়েন্টে গুমানী নদী। সেখানে একটি ব্রিজের দাবি দীর্ঘ দিনের। বর্ষায় সেখানে খেয়া নৌকা থাকায় কষ্ট সয়ে পারা-পার হয় মানুষ। যখন পানি শুকিয়ে তখন খেয়া নৌকাটিও চলে না। তাই হেঁটে পারাপার করা গেলেও মালামাল নেওয়ার ¶েত্রে দুর্ভোগ আরো বেড়ে যায়। স্থানীয়রা একটি ব্রিজের দাবি জানিয়ে স্থানীয় সাংসদ সহ বিভিন্ন দপ্তরে বেশ কয়েকবার আবেদন করেছে। কিন্তু তাতে কোন কাজই হয়নি।
সেতু, সাদিয়া আর শাহিন। ওরা একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে। প্রতিদিন সকালে স্কুলের ব্যাগে বই খাতার সাথে বাড়তি একটি পোষাক নিয়ে আসতে হয় তাদের। কারন,- স্কুলে যেতে গুমানী নামে একটি নদী পার হতে হয়-তাদের। সেখানে ব্রিজ নেই। খেয়া নৌকা থাকলেও বন্ধ। বাঁশের সাকোর ওপর দিয়ে যাতায়াত করতে হয়। আবার অনেক সময় তাও না থাকলে বিকল্প পথ বেছে নিতে হয়। তাই স্কুল ব্যাগে বাড়তি পোষাক আনতে হয় এসব শি¶ার্থীদের। বাড়তি পোষাক পড়ে ¯্রােতধারা নদীতে গা ভাসিয়ে সাতরে এ পারে আসে। আবার অনেক সময় প্রবল ¯্রােতে নিজেকে ধরে রাখতে না পারলে অনত্রে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। ফলে তীরে উঠতে সময় লেগে যায় অনেক। এ ¯্রােতের কারনে প্রাণহানি ঘটনাও ঘটেছে অনেকে। এরকম দুর্ভোগ শুধু ওই ছাত্র-ছাত্রীদের নয়। নদী পাড়ের সাতটি গ্রামের প্রায় ৩০ হাজার মানুষের।
গত ১০ জুনে গিয়ে দেখাযায়,- একদল ছাত্র-ছাত্রী ভিজে নদীর তীরে উঠেছে। স্কুল ছাত্রী সেতু, সাদিয়া আর শাহিন জানায়,- এভাবে প্রতিদিন ভিজে স্কুলে গিয়ে পোষাক বদলে ক্লাস করি। আবার বাড়ি ফিরে একই অবস্থা। অনেক সময় পা পিছলে বই-খাতা ভিজে যায়। নওখাদা গ্রামের জলিল জানান,- তাদের নিজ¯^ মটর সাইকেল রয়েছে। কিন্তু বাড়িতে নিতে পারেন না। ধামাইচ হাটের কোন দোকানে রেখে যেতে হয়। তাদের দাবি সরকার এখানে একটি ব্রিজ করে দেন।
চাষী আব্দুস সালাম বলেন,- নদীর কারনে আপাতত কয়েক বিঘা জমিতে লিচুর চারা লাগানো হয়েছে। যাতায়াত ব্যবস্থা না থাকায় বেশী করে চাষ করতে সাহস পাচ্ছি না। কারন এবছর লিচুর তার বাগানে উল্লেখযোগ্য লিচু চাষ হয়েছে। আশা করছি সামনের বছরে লিচুর গাছ সংখ্যা আরও বাড়াবো। কিন্তু নদীটিতে সেতু না থাকায় লিচু সরবরাহ নিয়ে বিপাকে পড়তে হবে তাকে। এভেবেই সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না।
স্কুল শি¶ক জানান,- নদীটির উত্তর পাড়ে গুরুদাসপুরের বাহাদুরপাড়াসহ তাড়াশের হেমনগর, নওখাদা, বিন্নাবাড়ি, কাটাবাড়ি, সবুজপাড়া আর দ¶িণ পাশে রয়েছে ধামাইচ হাট-বাজারসহ ধামাইচ উচ্চ বিদ্যালয় ও সরকারী প্রাথমিক স্কুল। ছাত্র-ছাত্রীরা প্রতিনিয়ত ঝুঁকি নিয়ে স্কুলে আসে। ওই গ্রামগুলোর হাজার হাজার মানুষ দুর্ভোগ পোহাচ্ছে-একটি ব্রিজের অভাবে। তাছাড়া বিকল্প ব্যব স্থা না থাকায় ওই গ্রামের মানুষকে গুরুদাসপুর ও তাড়াশ উপজেলাসহ দেশের অভ্যান্তরিন জেলাগুলোর সাথে যোগাযোগ করতে হচ্ছে। নদীটি দুই পাড়ের হাজার হাজার মানুষকে বিভক্ত করে রেখেছে। তাছাড়া ওই গ্রামের মানুষের উৎপাদিত ফসল বিক্রি করতেও বিড়¤^না পোহাতে হয়। কষ্টে নদী পার করা গেলেও দাম পায়না কৃষক।
স্থানীয় বোরহান উদ্দিন মন্ডল জানান,- নদীটির ধামাইচ পয়েন্টে ব্রিজ নির্মানের জন্য গ্রামের হাজার হাজার মানুষের গন¯^া¶র নিয়ে স্থানীয় সংসদ, উপজেলা চেয়ারম্যানসহ বিভিন্ন দপ্তরে জমা দেওয়া হয়েছে। মাঝে ইঞ্জিনিয়ার এসে মাপজোখও নিয়ে যান। কিন্তু ব্রিজ আর হয় না। ব্রিজটি নির্মাণ করা হলে নদী দুই পারের হাজার হাজার মানুষ প্রাণ ফিরে পাবে ব্যবসায়িক থেকে শুরু করে বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে। এ কারনে এখানে একটি ব্রীজের প্রয়োজন দীর্ঘদিনের।
সগুনা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবু সাইদ জানান,-তিনি নির্বাচিত হওয়ার আগে থেকেই এখানে ব্রিজ নির্মানের দাবি উঠেছে। ব্রিজটি নির্মিত হলে হাজার হাজার মানুষের দুর্ভোগ কমে। তবে তিনি বিরোধী দলের সমর্থিত চেয়ারম্যান হওয়ায় সরকারী দলের সাংসদ তার কথা শুনছেন না।
এ ব্যাপারে (তাড়াশ-রায়গঞ্জ) সাংসদ মো. ইসাহক আলী মোবাইল বন্ধ থাকায় কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে তাড়াশ উপজেলা চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন জানান,- এলাকাবাসীর দাবির প্রে¶িতে বিষয়টি সাংসদকে জানানো হয়েছে। তিনি প্রতিশ্রæতিও দিয়েছেন।