নিজের পক্ষে সাফাই সাক্ষ্য অব্যাহত রেখেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। বলেছেন, তার রাজনীতিতে আসা সংবিধান বর্ণিত সীমানার ওপর আস্থা স্থাপন করে- ১৯৭২ সালের ১৬ই ডিসেম্বর যে সংবিধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিকে উপহার দিয়েছিলেন। দ্বিজাতি তত্ত্ব্বের সমালোচকদের কঠোর সমালোচনা করে তিনি বলেছেন, দ্বিজাতি তত্ত্বের সমর্থক হওয়ার কারণেই আমাকে টার্গেট করা হয়েছে। জবানবন্দির বাইরেও কথা বলেছেন আলোচিত এ পার্লামেন্টেরিয়ান। কখনও কখনও তীর্যক ভাষায় জবাব দিয়েছেন প্রসিকিউটরদের আপত্তির।
রাজনীতিবিদদের সমালোচনা হবে চিরায়ত সে উক্তি স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেছেন, আপনারা আমার সমালোচনা করেন তাতে তো আমি আপত্তি করি না। এটা হচ্ছে হাঁসের গায়ে পানি ছিটানোর মতো। ঝাঁকি দিলে এ পানি পড়ে যাবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে এখন বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের ভিত্তিতে বিভক্ত। সোমবার সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর দেয়া জবানবন্দি বিভিন্ন পত্রিকায় বিভিন্নভাবে প্রকাশ সম্পর্কে ট্রাইব্যুনাল বলেন- কেউ আপনার পক্ষে লিখেছে, কেউ বিপক্ষে লিখেছে। কখনও কখনও আমাদের বিপক্ষেও লেখা হয়। গতকাল দ্বিতীয় দিনের মত জবানবন্দি দেন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেন এবং বিচারপতি আনোয়ারুল হকের সমন্বয়ে গঠিত ট্রাইব্যুনাল ১-এ তিনি এ সাক্ষ্য দেন। এর আগে সকালে ট্রাইব্যুনালের হাজতখানায় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করেন তার আইনজীবী ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলাম। তারা এক ঘণ্টা কথা বলেন। ১১টা ৩৫ মিনিটের দিকে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে এজলাসে আনা হয়। সাক্ষীর কাঠগড়ায় আনার পর তিনি বলেন, আপনার যে তিনটি মাপকাঠি দিয়েছেন আমি তার মধ্যে থেকেই আমার বক্তব্য উপস্থাপন করবো। কখনও এর বাইরে গেলে আপনারা আমাকে থামিয়ে দেবেন। এসময় ট্রাইব্যুনাল বলেন, আমরা আপনাকে থামাতে চাই না। আপনি একজন পার্লামেন্টেরিয়ান। ৩৩ বছর ধরে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হচ্ছেন। সালাউদ্দিন কাদের বলেন, ৪২ বছর পর আমাকে কেন এখানে নিয়ে আসা হলো? তা তো আমাকে বলতে হবে। তিনি বলেন, এ মামলার ফর্মাল চার্জে পলাশী আর সিরাজউদ্দৌলার কথা কেন বলা হলো তা বলতে পারবো না। পলাশীর সঙ্গে আমার কি সম্পর্ক তা তো বুঝলাম না। সাক্ষ্যের শুরুতে সালাউদ্দিন কাদের বলেন, ১৯৭৮ সালের শেষ দিকে আমি রাজনীতিতে এসেছি। সংবিধান ২ অনুচ্ছেদের ওপর পূর্ণাঙ্গ আস্থা স্থাপন করেই আমি রাজনীতিতে প্রবেশ করি। (যে অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রীয় সীমানার অন্তর্ভুক্ত হইবে- ক) ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণার অব্যবহিত পূর্বে যে সকল এলাকা লইয়া পূর্ব পাকিস্তান গঠিত ছিল এবং সংবিধান (তৃতীয় সংশোধন) আইন ১৯৭৪-এ অন্তর্ভুক্ত এলাকা বলিয়া উল্লিখিত এলাকা, কিন্তু উক্ত আইনে বহির্ভূত এলাকা বলিয়া উল্লিখিত এলাকা তৎবহির্ভূত।) সালাউদ্দিন কাদের বলেন, এ অনুচ্ছেদে ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ পর্যন্ত সামপ্রদায়িকতার ভিত্তিতে নির্ধারিত তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের সীমানাকে স্বীকৃতি দিয়ে দ্বিজাতি তত্ত্বের প্রতি সুনিশ্চিতভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অঙ্গীকার প্রকাশ পায়। প্রসিকিউশন দ্বিজাতি তত্ত্বের বিরোধিতা করে যে প্রস্তাব দিয়েছে তা দ্বিজাতি তত্ত্বের প্রতি এক ধরনের বিদ্রুপ। এ তত্ত্বের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ত্যাগ স্বীকার করেছেন। এ প্রস্তাব বাংলাদেশকে বলকান ও সিকিম বানানোর প্রস্তাব। এ প্রস্তাবের মাধ্যমে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর এ বক্তব্যে প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানানো হয়। চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু, প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম, সুলতান মাহমুদ সিমনসহ প্রসিকিউটররা বলতে থাকেন, এটা যাবে না। জবাবে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, এটা আমার বক্তব্য। আপনারা আপনাদের যুক্তির সময় জবাব দেবেন। এ সময় প্রসিকিউটরদের সঙ্গে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আইনজীবী ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলাম তর্কে জড়ান। ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলাম বলেন, সালাউদ্দিন কাদের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে কিছু বলছেন না। তিনি সার্বভৌমত্ব রক্ষার পক্ষে বলছেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বলছেন। সালাউদ্দিন কাদের বলেন, সিকিমাইজেশন বললে এত গা জ্বলে কেন? এ সময় ট্রাইব্যুনালের আদেশে বলকান ও সিকিম বানানোর প্রস্তাব কথাগুলো জবানবন্দি থেকে বাদ দেয়া হয়। পরে সালাউদ্দিন কাদের তার জবানবন্দিতে বলেন, এ প্রস্তাব বলকান ও সিকিম বানানোর প্রস্তাব তা আমি বলতে চাই কিন্তু কিছু লোক তাতে আহত (বিরক্ত) হবেন তাই আমি তা বলছি না। দ্বিজাতি তত্ত্বের সুবিধাভোগী কিছু বিখ্যাত ব্যক্তির নাম রেকর্ডে থাকা প্রয়োজন। এ সম্পর্কে বিখ্যাত আইনজ্ঞ যাদের নাম আমি স্মরণ করতে পারি তাদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামাল, সাবেক প্রধান বিচারপতি কামাল উদ্দিন, সাবেক প্রধান বিচারপতি আবদুস সাত্তার, ব্যারিস্টার রফিক-উল হকসহ আরও অনেকের কথা। যারা প্রত্যেকে আমাদের জাতির জন্য গর্ব। এ বক্তব্যের ব্যাপারে প্রসিকিউশনের আপত্তির জবাবে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, দ্বিজাতি তত্ত্ব আমাদের জন্য কিভাবে সুফল বয়ে এনেছে তা বোঝানোর জন্যই এটা বলা প্রয়োজন। আমাদের চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপুকে নিয়েও আমি গর্বিত। তিনিও দ্বিজাতি তত্ত্বের ফসল। সালাউদ্দিন কাদের বলেন, একজন বিখ্যাত রাজনৈতিক দার্শনিক তার নিজের সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন এভাবে- সংস্কৃতিগতভাবে মুসলিম, শিক্ষাগত দিক থেকে ইংরেজ এবং দুর্ভাগ্যজনিত জন্মগত কারণে হিন্দু। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, আমি জন্মসূত্রে চট্টগ্রামী। এটা কোন দুর্ঘটনা নয়। চট্টগ্রাম কখনওই নবাব সিরাজউদ্দোলার শাসিত অঞ্চলের অংশ ছিল না। আমি সিরাজউদ্দৌলাকে স্বীকার করি না। আমরা চট্টগ্রামের মানুষ। আমাদের নিজস্ব ভাষা এবং নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে। মধ্যাহ্ন বিরতির শেষ হওয়ার আগে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী তার পরিবারের সদস্যরা যেন তার সঙ্গে দেখা করতে পারেন এ ব্যাপারে ট্রাইব্যুনালের অনুমতি চান। ট্রাইব্যুনাল বলেন, সোমবারই তো পরিবারের সদস্যরা আপনার সঙ্গে দেখা করেছেন। তখন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, আমি তো তা অস্বীকার করছি না। এজন্য আমি ট্রাইব্যুনালের কাছে কৃতজ্ঞ। ফাঁসির আসামির সঙ্গেও পরিবারের সদস্যরা মাসে একবার দেখা করতে পারে। এ সময় ট্রাইব্যুনাল সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সঙ্গে পরিবারের সদস্যদের দেখা করার অনুমতি দেন। বিরতির পর দেয়া সাক্ষ্যে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এ অঞ্চলের মুসলিমদের ওপর পরিচালিত নির্যাতনের বর্ণনা দেন। তিনি বলেন, সারা দুনিয়াতেই এখন মুসলিমদের ওপর নির্যাতন চলছে। সোমালিয়া, বসনিয়া, গুজরাট, ফিলিস্তিন সারা দুনিয়ায় এখন মুসলমানরা নির্যাতনের শিকার। তিনি বলেন, মুসলিমদের প্রতি আমার কমিটমেন্টের কোন রাজনৈতিক সীমানা নেই। পরে আজ পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করা হয়।