সরকারের শেষ পর্যায়ে এসে চারটি সিটি করপোরেশনের ভোটাররা সরকারকে একটি বার্তা দিয়েছেন। নির্বাচন পর্যবেক্ষক, ভোটার ও নাগরিক সংগঠনগুলো মনে করছে, জনবিচ্ছিন্নতা, দলের অন্তর্দ্বন্দ্ব, সদ্যবিদায়ী মেয়রদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতির অভিযোগের সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের মতো বিষয়ও এবারের নির্বাচনের ফলাফলে প্রভাব ফেলেছে। এ নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে বলেও তাঁরা মনে করছেন।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, ফলাফলের গতিপ্রকৃতি প্রমাণ করেছে সরকার জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে। চারটি সিটি করপোরেশনের অন্তত দুটিতে মেয়ররা উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন। শুধু সরকারের বিরোধিতা করতে গিয়ে জনগণ তাঁদের প্রত্যাখ্যান করেছেন। ব্যক্তি হিসেবে এলাকার জনগণ তাঁদের অপছন্দ করেন না। তিনি আরও বলেছেন, অন্যান্য সিটি করপোরেশন নির্বাচন ও জাতীয় সংসদের উপনির্বাচনেও একই রকম ফলাফল হতে দেখা গেছে।
বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের সময় আরও তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম ও কুমিল্লায় বিএনপি-সমর্থিত এবং নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী জয়ী হন। রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিজয়ী হন নির্দলীয় প্রার্থী শারফুদ্দীন আহমেদ ঝন্টু।
জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ পরিষদের চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ এ প্রসঙ্গে বলেন, ২০০৮ সালেও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিপুল অংশগ্রহণ ছিল। তবে এবারকার নির্বাচন ও ২০০৮ সালের নির্বাচনের প্রেক্ষাপট ছিল আলাদা। গত নির্বাচন জরুরি অবস্থার মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। জরুরি অবস্থার জাঁতাকলে সাধারণের হাঁসফাঁস অবস্থা ছিল। হুট করে মানুষ সুযোগ পেয়ে একটি বার্তা দিতে চেয়েছিল। আর এবারের নির্বাচন হয়েছে রাজনৈতিক সরকারের অধীনে। এবার মানুষ শাসকদলকে একটি বার্তা দিতে চেয়েছেন। অধিকাংশ বাংলা ভাষাভাষী মানুষের মাঝে ‘অ্যান্টিএস্টাবলিশমেন্ট’ চেতনা দেখা যায়। গোপন অধিকার প্রয়োগের সুযোগ পেলে তাঁরা তা কাজে লাগান।
জনগণ তাঁদের রায় দিয়েছেন: ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জিতেছিল বিপুল ব্যবধানে। খুলনায় তালুকদার আবদুল খালেক ২৫ হাজার ৮৩৬ ভোটে মো. মনিরুজ্জামানকে হারিয়েছিলেন। বদরউদ্দিন আহমদ কামরান পেয়েছিলেন এক লাখ ১৫ হাজার ৪৩৬ ভোট। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আ ফ ম কামাল পেয়েছিলেন ৩২ হাজার ৯৭ ভোট। বরিশালে মো. শওকত হোসেন ২০ হাজার ৩৮০ ভোটে এগিয়ে ছিলেন বিএনপি প্রার্থী আহসান হাবীব কামালের চেয়ে। রাজশাহীতে খায়রুজ্জামান লিটন পেয়েছিলেন ৯৮ হাজার ৩৬০ ভোট। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী মোসাদ্দেক হোসেন পেয়েছিলেন ৭৪ হাজার ৫৫০ ভোট। গতবারের সফলরা এবার ব্যর্থদের তালিকায়।
রাজশাহী ও বরিশালে আওয়ামী লীগের সদ্যবিদায়ী মেয়র পদপ্রার্থীরা উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন। এলাকার লোকজন বলছেন, ব্যক্তি হিসেবে তাঁরা পরাজিত হননি, দল হিসেবে আওয়ামী লীগ পরাজিত হয়েছে। বরিশালে সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেন বলেছেন, ‘স্থানীয় নির্বাচনে জাতীয় ইস্যুর প্রভাব থাকার কথা না। কিন্তু দেখা গেছে, পদ্মা সেতু, হলমার্ক-ডেসটিনি, শেয়ারবাজার ইত্যাদি নির্বাচনের ফলাফলে প্রভাব রেখেছে। এ ছাড়া বরিশালবাসী মনে করে হেফাজতের ব্যাপারে সরকারের অবস্থান পরিষ্কার ছিল না। মানুষ ব্যক্তি শওকত হোসেনের দক্ষতার ওপর গুরুত্ব দেননি। নির্বাচন হয়েছে জাতীয় নির্বাচনের মতো। এখানে আসলে শওকত হোসেন পরাজিত হননি, আওয়ামী লীগ পরাজিত হয়েছে।’ রাজশাহীতেও খায়রুজ্জামান লিটনের পরাজয়ের পেছনে জাতীয় ইস্যু কাজ করেছে বলে মনে করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মলয় কুমার ভৌমিক। তাঁর মতে, সরকারের সাড়ে চার বছরের ব্যর্থতা এই নির্বাচনে প্রতিফলিত হয়েছে।
এদিকে খুলনায় সদ্যবিদায়ী মেয়র তালুকদার আবদুল খালেকের পরাজয়ের পেছনে সাধারণ মানুষের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, বিপুল সম্পত্তির মালিক হওয়া ও দলীয় অন্তর্দ্বন্দ্ব কাজ করেছে বলে ধারণা করছেন এলাকার মানুষ। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীরা বিষয়টিকে ভালোভাবে কাজে লাগিয়েছেন। নির্বাচন কমিশনে প্রার্থীরা যে হলফনামা জমা দিয়েছেন তাতে দেখা গেছে, ২০০৮ সালে খুলনা সিটি করপোরেশনের মেয়র হওয়ার পর তালুকদার আবদুল খালেক ও তাঁর ওপর নির্ভরশীলদের আয় বেড়েছে ৫ কোটি টাকারও বেশি। খুলনার সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের কমিটির সভাপতি হওয়ার কারণে সবকিছু খালেক এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ, বিভিন্ন এলাকায় বরাদ্দ দেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি কারও কোনো পরামর্শ, অনুরোধ রক্ষা করেননি। আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী দুই নেতা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম মোস্তফা রশিদি সুজা ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান খালেকের পক্ষে কাজ করেননি। অন্তর্দ্বন্দ্বও এ পরাজয়ের পেছনে কাজ করেছে।
তবে সিলেটে বদরউদ্দিন আহমদ কামরান স্থানীয় কোনো সমস্যা সমাধানে সফল হননি বলে অভিযোগ রয়েছে। জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এমাদউল্লাহ শহীদুল ইসলাম বলেছেন, নগরের জলাবদ্ধতা নিরসন, অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ, কোনো কাজেই সফল হননি কামরান। জনগণ তাই তাঁদের রায় দিয়েছেন।