বিএনপির নেতা ও সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীমের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গতকাল বৃহস্পতিবার জবানবন্দি দিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের ২৪তম সাক্ষী ভগীরথ চন্দ্র বর্মণ। জবানবন্দিতে তিনি বলেন, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে আলীমের আদেশে জয়পুরহাটের কাদিপুর গ্রামে ৩৫০ থেকে ৩৭০ জন হিন্দুকে গুলি করে হত্যা করা হয়। নিহতদের মধ্যে তাঁর অনেক আত্মীয়ও ছিলেন।
বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ ভগীরথ চন্দ্রের জবানবন্দি নেন রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি রানা দাশগুপ্ত।
জবানবন্দিতে ভগীরথ চন্দ্র বলেন, তাঁর বাড়ি জয়পুরহাটের সদর উপজেলার কড়ই কাদিপুর গ্রামে। একাত্তরে তাঁর বয়স ছিল ১৭-১৮ বছর। মুক্তিযুদ্ধকালে বৈশাখ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে তিনি ও তাঁর কাকা পুকুরে গোসল করছিলেন। এ সময় কাদিপুর গ্রামে পাকিস্তানি সেনা ও শান্তি কমিটির লোকেরা ঢুকলে তাঁরা পুকুর থেকে উঠে বাড়িতে গিয়ে সবাই মিলে বাড়ির উত্তরে থাকা মাঠে যান। পাকিস্তানি সেনা ও শান্তি কমিটির লোকেরা তাঁদের ঘিরে ফেলে। বাড়ির ৫০-৫৫ জনকে তারা বাড়ির পূর্বে ডোম পুকুরপাড়ে একত্রিত করে পুরুষ ও নারীদের আলাদা করে। পুরুষদের ডোম পুকুরের ঢালে নামানোর সময় তিনি (সাক্ষী) নারীদের সঙ্গে মিশে পালাতে থাকেন। এ সময় তিনি ওই পুকুরপাড়ের দিকে তাকিয়ে দেখেন, একেকজনকে ধরে পুকুরের ঢালে নামিয়ে গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে। সেখান থেকে তিনি কড়ই পালপাড়ায় গিয়ে দেখেন, তা জনশূন্য। সেখানকার হিন্দুরা উত্তর দিকে মাঠে চলে গেছে। পরে তিনি কড়ই আলিয়া মাদ্রাসায় ঢুকে উত্তর-পশ্চিম দিকের দরজা দিয়ে মাঠে তাকিয়ে দেখেন, হিন্দুরা পালানোর চেষ্টাকালে শান্তি কমিটির লোকেরা তাঁদের ধরে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে তুলে দিচ্ছে আর সেনারা হিন্দুদের গুলি করে হত্যা করছে। চারদিকে আগুন জ্বলছিল, লোকজন ছোটাছুটি করছিল এবং এর মধ্যেই লুটপাট হচ্ছিল।
রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী বলেন, সেদিন সন্ধ্যার আগে তিনি মাদ্রাসা থেকে বেরিয়ে ডোম পুকুরপাড়ে গিয়ে দেখেন, তাঁর বাড়ির সবাই লাশ হয়ে পড়ে আছে। এ কথা বলে সাক্ষী অঝোরে কাঁদতে থাকেন। পরে স্বাভাবিক হয়ে বলেন, তিনি সেখানে ৮০-৮৫ জনের লাশ দেখেন। তাঁদের মধ্যে তাঁর কাকা বাণী কান্ত, সন্তোষ, ব্যাঙ্গা, ঘোনা, তরমুজা, কুষ্ণসহ অনেকের লাশ ছিল। ঘটনার পর কাদিপাড়া গ্রামের মুসলমানরা বলাবলি করেন, যদি আলীম ও শান্তি কমিটির লোকেরা না আসত, তবে তাঁরাও বাঁচতেন না।
ভগীরথ চন্দ্র বর্মণ আরও বলেন, হত্যাযজ্ঞের পর তিনিসহ কাদিপুরের পালপাড়া ও বর্মণপাড়ার অন্তত ৩৫০ জন হিন্দু ভারতে গিয়ে তিওর শরণার্থীশিবিরে আশ্রয় নেন। স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে দেখেন, বাড়িতে ঘর নেই, শূন্য ভিটা। এক দিন খোলা আকাশের নিচে কাটানোর পর পাশের মুসলমানপাড়ায় গিয়ে আফসার (বর্তমানে মৃত) নামের একজনকে তিনি তাঁদের লুট হওয়া টিন ফেরত দিতে বলেন। এতে আফসার বলেন, তাঁরা টিন আনলেও শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আলীমের নির্দেশে টিনসহ অন্যান্য মালামাল তাঁর চাতালে জমা দিয়ে আসেন।
জবানবন্দির শেষ পর্যায়ে সাক্ষী বলেন, আলীম শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান এবং মুসলিম লীগের নেতা ছিলেন। তাঁরই আদেশে কড়ই কাদিপুর গ্রামে হত্যাকাণ্ড চলে। ঘটনার দিন ওই গ্রামের পাড়াগুলোতে ৩৫০ থেকে ৩৭০ জন হিন্দুকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সাক্ষী ট্রাইব্যুনালে থাকা আলীমকে শনাক্ত করেন।
জবানবন্দি শেষে সাক্ষীকে জেরা শুরু করেন আসামিপক্ষের আইনজীবী খলিলুর রহমান। জেরা অসমাপ্ত অবস্থায় এ মামলার কার্যক্রম রোববার পর্যন্ত মুলতবি করেন ট্রাইব্যুনাল।