বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম : বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা অবাধ, সুষুম, নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক উপায়ে রাষ্ট্র পরিচালনা। সবাই গণতন্ত্রের পূজারি। কিন্তু দেশে প্রকৃত গণতান্ত্রিক মানসিকতার কোনো দল নেই। সব দলেই কম-বেশি স্বৈরতন্ত্র কাজ করছে। এমনকি আমাদের যে ছোট্ট দল, সে দলেও প্রকৃত গণতন্ত্র নেই, গণতান্ত্রিক চর্চা নেই। আমি চেষ্টা করি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের মর্যাদা দিতে। কিন্তু এক হাতে যেমন তালি বাজে না, ঠিক তেমনি একজনে গণতন্ত্র হয় না। দলের অনেক সহকর্মীই বয়সে আমার থেকে অনেক ছোট না হলেও চিন্তা-চেতনায়, সামাজিক মর্যাদা ও রাজনৈতিক অবস্থানে অনেক পার্থক্য হওয়ার কারণে তেমন গণতন্ত্র হয় না। তবু চেষ্টা করি আমাকে নিয়ে না হোক, তারা যদি গণতান্ত্রিক হয়, তাহলে আমি যখন থাকব না তখন তারা অবশ্যই আরও ভালো গণতান্ত্রিক চর্চা করতে পারবে। বাংলাদেশে এক অভিনব নির্বাচনী ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সাধারণ নির্বাচন। বেশ কয়েকটা নির্বাচন হয়েছেও। একেবারে ধোয়া তুলসী পাতা না হলেও দলীয় সরকারের চেয়ে নির্বাচনগুলো ভালো হয়েছে। যখন দেশে নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে কারও কোনো কথা ছিল না, নির্বাচন নিয়ে কোনো বিতর্ক ছিল না, তখন শুধুই সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে বর্তমান সরকার পঞ্চদশ সংশোধনী এনে আল্লাহর ওপর গভীর আস্থা ও বিশ্বাস বাদ দিয়ে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের এক জটিল পদক্ষেপ নিয়েছে। অভিনব বলছি এ কারণে, পঞ্চদশ সংশোধনীতে সংসদের আয়ুষ্কাল তিন মাস থাকতেই নির্বাচন করার ব্যবস্থা হয়েছে। মানে একই সংসদে বিদায়ী ও নবনির্বাচিত সদস্য। এমন গাঁজাখুরি পদ্ধতি পৃথিবীর কোথাও নেই। যারা নির্বাচিত তারা আবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন কী করে? মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় কী লিখবেন? সংসদ সদস্য থাকতে সংসদ সদস্য পদে তারা কীভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন? মনোনয়নপত্রে যদি তাদের নামে সংসদ সদস্য লেখেন তাহলে তারা নির্বাচন করতে পারবেন না। আর সংসদ সদস্য থাকতে তারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে গিয়ে মনোনয়নপত্রে যদি সংসদ সদস্য উল্লেখ না করেন তাহলে সত্য গোপনের জন্য মনোনয়নপত্র বাতিল হবে। কী যে জটিলতা সৃষ্টি করেছেন জনাব সুরঞ্জিত সেন তা হয়তো নিজেও বুঝতে পারেননি। তিনি সারা জীবনই পণ্ডিতি করেছেন, নানা ধরনের কথাবার্তা বলেছেন। কিন্তু মনে হয় এখন বড় বেশি লাগামহীন বলছেন। সেদিন বলেছেন, ‘হেফাজতিরা সুবহান আল্লাহ বলতে বলতে শাপলা চত্বর থেকে পালিয়েছে।’ তার কথা শুনে ভীষণ খারাপ লেগেছে, একটা মানুষের কতটা পতন হলে মুসলমানের ধর্মের সবচেয়ে বড় নিয়ামক শব্দ ‘সুবহান আল্লাহ’ নিয়ে কথা বলতে পারেন। জনাব সেনগুপ্ত হয়তো জানেন না, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত একজন মুসলমানকে প্রতি মুহূর্তে সুবহান আল্লাহ বলতে হয়। সারা দুনিয়ার চেয়ে মহামূল্যবান একবার ‘সুবহান আল্লাহ’। হাদিসে আছে, হজরত সোলায়মান পয়গম্বর জায়নামাজে আসমান দিয়ে ভেসে যাচ্ছিলেন। এক অতি সাধারণ মানুষ মাটি থেকে তা দেখে বিস্মিত হয়ে বলেছিলেন, ‘সুবহান আল্লাহ’। সোলায়মান পয়গম্বর মাটিতে নেমে সেই লোককে বলেছিলেন, ‘আমি আমার সমস্ত ঐশ্বর্য তোমাকে দিয়ে দেব। আসমানে থাকতে তুমি অবাক হয়ে যে সুবহান আল্লাহ পাঠ করেছ তার সওয়াবটুকু আমাকে দাও।’ সেই হতদরিদ্র সাধারণ মানুষ সোলায়মান পয়গম্বরের সব নিয়েও তাকে সুবহান আল্লাহর সওয়াব বা নেকি দিতে রাজি হননি। মুসলমানের শুকরিয়া জানানোর শব্দই দুইটা_ এক. সুবহান আল্লাহ, দুই. আলহামদুলিল্লাহ। এসব নিয়ে সেনগুপ্তের ব্যঙ্গ করা ভালো না। গদির গরমে ওসব করছেন, ঠাণ্ডা হয়ে গেলে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
দেশের রাজনৈতিক অশান্তিতে সবাই ভীষণ শঙ্কিত। সবাই চায় শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। কিন্তু সরকারের সেদিকে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। এক সময় সংলাপ সংলাপ আর সংলাপের প্রত্যাশায় স্বদেশ-বিদেশ ছিল মাতোয়ারা। ৩ জুন সংসদ শুরু হয়েছে। সবই বিশ্বরেকর্ড। এবার সংসদে স্পিকার মহিলা, সংসদ নেতা, উপনেতা, বিরোধী দলের নেতা মহিলা। বলতে গেলে একেবারে পুরুষশূন্য সংসদ, পুরুষবিহীন দেশ। ৬ জুন বাজেট পেশ হয়েছে ২,২২,৪৯১ কোটি টাকা। বাংলাদেশের প্রথম বাজেট ছিল ৫০০ কোটি। পরে সেটা বেড়ে হয়েছিল ১১০০ কোটির মতো। এবার ২,২২,৪৯১ কোটি। বড় বাজেটের দিক থেকে রেকর্ড। ঘাটতি ৫৫ হাজার কয়েকশ কোটি। ঘাটতির দিক থেকেও বিশ্ব রেকর্ড। এ যেন রেকর্ডের ছড়াছড়ি। সংসদে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে এক সিদ্ধান্ত প্রস্তাব এনেছিলেন বিরোধী দলের এক সদস্য। অধিবেশনে একদিন সিদ্ধান্ত প্রস্তাব আনা হয়। সিদ্ধান্ত প্রস্তাব সাধারণত বিরোধী দলের সদস্যরাই আনে। ব্যাপক আলোচনা হয়। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। যে মন্ত্রণালয় সম্পর্কে প্রস্তাবটি আনা হয় এবং অন্যান্য সদস্য সম্পূরক দেন- সেসব নিয়ে কয়েক ঘণ্টা আলোচনা হয়, মন্ত্রী মহোদয়রা দাঁড়িয়ে শেষে মাননীয় সদস্যকে প্রস্তাবটি প্রত্যাহার করে নিতে বলেন। প্রত্যাহার না করলে রেওয়াজ অনুসারে সংসদ সদস্যদের ভোটে প্রস্তাবটি নাকচ হয়। সিদ্ধান্ত প্রস্তাবও হয় নানা ধরনের। কোন কলেজে কোন বিভাগ খোলা, হাসপাতালে দালান করা, চিনিকলে আখ মাড়াই, কাঁচারাস্তা পাকাকরণ- এসব আর কী। এবার সংসদে বিএনপির এক সদস্য ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একটি নোটিস দিয়েছিলেন। আবার কয়েক মিনিট পরেই সে নোটিসটি তুলে নিয়েছেন। নোটিস দেওয়ার যেমন অধিকার আছে ঠিক তেমনি তুলে নেওয়ারও অধিকার আছে। তবে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ব্যাপার কোনো সদস্য ইচ্ছা করলেই প্রস্তাব আনতে এবং তুলতে পারেন না। এখন সরকার অজুহাত খাড়া করেছে, বিরোধী দল প্রস্তাব এনে প্রস্তাব তুলে নিয়েছে। আসলেই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রস্তাব বিরোধী দলের আনার কোনো সুযোগই নেই। আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য প্রস্তাব আনতে হবে কেন। সরকার চাইলে একটি বিল আনবে। সেই বিলে বিরোধী দল অংশ নিয়ে কিছু সম্পূরক সংশোধনী দিতে পারে। কিন্তু সরকারি দল সিদ্ধান্ত প্রস্তাবের বাহানা নিয়ে সংসদ গরম করে চলেছে। মজার ব্যাপার, আওয়ামী লীগ এমন একটি দল_ সে মেরেও জিততে চায়, কেঁদেও জিততে চায়। অথচ এমন জেতা তার কপালে কখনো জোটেনি। নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ‘৭০ সালে জয়ী হয় আওয়ামী লীগ। ‘৭৩ সালে তারা ২৯১ আসন পেয়েছিল। কিন্তু সে সময় কারচুপির অভিযোগ রয়েছে। কারচুপি না করলে বঙ্গবন্ধু হেরে যেতেন এ কথা কেউ বলবেন না। কথাটা ছিল ২৯১ আসন আওয়ামী লীগ পেত না। আর ২৯১-এর জায়গায় ১৯১ হলে ‘৭৫-এ আওয়ামী লীগ ক্ষমতা হারাতো না, বঙ্গবন্ধু নিহত হতেন না। আসলে সে সময় কেউ এসব ভেবে দেখেনি। যেমন এখন কেউ কিছু ভেবে দেখতে চাচ্ছে না। সেদিন সংসদে যে অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে আমরা সবাই তাজ্জব বনে গেছি। একজন মাননীয় সদস্য সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী ও অন্যদের সমালোচনা করতে গিয়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি করতে গিয়ে এক সময় বলে বসলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার লই কোনো চুদুর বুদুর চলবে না।’
একজন মহিলা সদস্য কোথায় পেলেন এই ‘চুদুর বুদুর’? আমি নিজেও গত ৪০-৪৫ বছর এই ‘চুদুর বুদুর’ শব্দ শুনিনি। বলতে গেলে একেবারে ভুলেই গিয়েছিলাম। ক’দিন আগে পাকিস্তানফেরত কর্নেল কাজী শাহেদ আহমেদের ভৈরব উপন্যাসে কয়েক জায়গায় ওই শব্দটি পড়েছিলাম। ভদ্রলোকেরা ওসব সহজেই ব্যবহার করতে পারেন। প্রাসাদে থেকে অনেক কিছু করা যায়। আমরা রাস্তাঘাটে চলাফেরা করা মানুষ ওসব ভাবতে কেন যেন আমাদের বড় বেশি বাধে। মহান সংসদে একজন মহিলার কণ্ঠে ওই ধরনের শব্দ উচ্চারণে কতটা যে মর্মাহত হয়েছি কাউকে বলে বুঝাতে পারব না। কিন্তু সরকার নির্বিকার। তারা মনে করছে খুব ভালো আছে। সব প্রয়োজন যেন বিরোধী দলের। আসলে বাস্তব কিন্তু তা নয়। বিরোধী দলের চেয়ে সরকারের বিপদ অনেক বেশি। সুষ্ঠুু নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার সিংহভাগ দায়িত্ব সরকারের। বিরোধী দলের তেমন কোনো দায়িত্বই নেই। একটা ভালো নির্বাচন হলে তাতে প্রধান বিরোধী দল দয়া করে অংশগ্রহণ করলে করবে, না করলে না করবে। কিন্তু পৃথিবীর কাছে গ্রহণযোগ্য একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ প্রভাবমুক্ত নির্বাচন সরকারকেই করতে হবে।
ইদানীং যোগাযোগমন্ত্রী সম্পর্কে অনেক কথা শুনি। তিনি নিজেও যে শোনেন না তা নয়। হঠাৎই সেদিন তার সঙ্গে কথা হলো। এক পর্যায়ে তিনি বললেন, ‘আপনার লেখা পড়লাম, আমি হেলেদুলে চলি। শেষ সময়ে মন্ত্রিত্ব পেয়েছি, যতটা সম্ভব চেষ্টা করছি।’ আমি লিখেছিলাম, তিনি আমার বাসায় এসে গামছা নিয়ে মন্ত্রী হয়েছেন। হেলেদুলে চলেন। তিনি যেভাবে চলেন আমার জ্ঞানত ভালোবাসা নিয়ে সেভাবেই লেখার চেষ্টা করেছি। মনে হয় ভদ্রলোকের পছন্দ হয়নি। হবেইবা কেন? আমাদের দেশে কেউ সমালোচনা সহ্য করতে পারে না। গত লেখায় তার প্রসঙ্গটা এসেছিল সমকালের জন্মদিনের কারণে। তাদের দলের সিনিয়র নেতারা তার সম্পর্কে যেসব কথা বলেছেন, সেগুলো লিখলে হয়তো তিনি আত্দহত্যা করতেন। আমি শুনেও লিখিনি। কিন্তু যা লিখেছি তাতে তিনি সন্তুষ্ট হতে পারেননি। আমাদের নির্মাণ সংস্থা সোনার বাংলার কত বদনাম। আজ সাত বছর তার মন্ত্রণালয়ে টাকা পাওনা। পাওয়া যায় না। আমরা সব টাকা নিয়ে নিয়েছি- এ নিয়ে কত পত্রিকার পাতা ভর্তি হয়েছে। কিন্তু বিধিমতো বিচার-সালিশ করে আমরা যে টাকা পাই ভিক্ষুকের ভিক্ষার মতো ছিঁড়ে ছিঁড়ে দেওয়া হচ্ছে। মাননীয় মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তার ব্যস্ততা, সময় হয় না। কবে হবে তাও ভালো করে জানি না। কিন্তু কার কাছে বিচার পাব। বিএনপির সঙ্গে এত বিরোধ, বিএনপিদলীয় কারও কাজ এ সরকারের কাছে ঠেকে থাকে না। চিহ্নিত জামায়াতিদের কোনো কাজ আটকায় না- সবার আগে হয়ে যায়। শুধু মুক্তিযোদ্ধারা যারা একটু সম্মানের সঙ্গে থাকতে চায় তাদের প্রতি পদে পদে নাজেহাল হতে হয়।
আমাদের প্রধানমন্ত্রী সেদিন বলেছেন, ২৫ অক্টোবর সংসদ ভেঙে যাবে। সংবিধান অনুসারে কি তাহলে সংসদ সদস্যরা বহাল থাকবেন? তারা বহাল থাকলে পরবর্তী নির্বাচনে অংশ নেবেন কী করে? আর মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছাই কি রাষ্ট্র! তিনি যদি সব বদলে ফেলতে চান নিশ্চয়ই ফেলতে পারেন। কিন্তু ওই যে এত অশান্তি এত লোক ক্ষয়- এর জবাব কে দেবে? দিনের পর দিন হরতাল চলেছে। গতকালও হরতাল ছিল। অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে চুরমার। সামাজিক কোনো নিরাপত্তা নেই। সরকারি কর্মচারীরা নিজেদের দেশের মালিক ভাবতে শুরু করেছে। কোনো কিছুর হেফাজত তারা করে না। এভাবে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক কাঠামো ভেঙে পড়লে আবার তা জোড়া লাগানো কতটা দুঃসাধ্য হয়ে পড়বে- আমরা কি তা খুব একটা ভেবে দেখেছি। সমাজ একবার ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়লে তাকে আবার সবল পায়ে দাঁড় করানো খুব একটা সহজ কাজ নয়। এখন সময় এসেছে সবাইকে এক হয়ে সরকারের কানে পানি দেওয়ার। কোনো সরকারই মাটিতে বাস করে না। সব সরকারই মাটি থেকে একটু উপরে বাস করে, সেটা দুই ইঞ্চিই হোক আর দুই ফুটই হোক। এ দূরত্বটা কোনো সরকারই দূর করতে পারেনি। এই সরকার দূর করবে কী করে। সাড়ে চার বছর তো গেলই। আর বাকি কয়দিন? অবনতি ছাড়া উন্নতি দেখছি না।