নিউজপ্রিন্ট আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা উঠিয়ে দেওয়ায় এবং ছাপার জন্য ব্যবহূত প্লেটের শুল্ক বাড়ানোয় সংবাদপত্রশিল্প গভীর সংকটে পড়বে। এই দুই কারণে সংবাদপত্রের প্রকাশনা খরচ প্রায় ২৮ শতাংশ বাড়বে।
আগামী অর্থবছরে সংবাদপত্রের জন্য নিউজপ্রিন্ট আমদানিতে শুল্ক ৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। এর ফলে সংবাদপত্রশিল্পের জন্য নিউজপ্রিন্ট আমদানিতে ভ্যাট, শুল্ক, কর, ইনস্যুরেন্সসহ আনুষঙ্গিক খাত মিলিয়ে মোট করভার দাঁড়াবে ৫৭ থেকে ৫৮ শতাংশ। এ ছাড়া প্রিন্টিং প্লেট আমদানির ওপর ৩ শতাংশ আমদানি শুল্ক ১২ শতাংশে উন্নীত করার সুপারিশ করা হয়েছে।
সংবাদপত্রশিল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা মনে করছেন, এবারে বড় আকারে খরচ বাড়লে সংবাদপত্রগুলোকে দেশীয় নিম্নমানের কাগজ ব্যবহার করতে বাধ্য করা হবে। এতে ছাপার মান খুবই খারাপ হবে, ছাপার সময়ও বেশি লাগবে। একই সঙ্গে নিউজপ্রিন্টসহ অন্যান্য খাতে অপচয় বেড়ে যাবে।
২০১৩-১৪ অর্থবছরের বাজেটে সংবাদপত্র ও প্রকাশনাশিল্পে ব্যবহূত আমদানি করা নিউজপ্রিন্টের ওপর বিদ্যমান কর রেয়াতি সুবিধা প্রত্যাহার করার সুপারিশ করেছেন অর্থমন্ত্রী। এতে এ শ্রেণীর নিউজপ্রিন্টের আমদানি শুল্ক বাড়বে। সংবাদপত্রশিল্পকে বর্তমানে নিউজপ্রিন্ট আমদানিতে রেয়াতি হারে ৩ শতাংশ আমদানি শুল্ক দিতে হয়।
অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন, সংবাদপত্রশিল্প নিউজপ্রিন্ট আমদানিতে মোট ২৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ শুল্ক-করাদি পরিশোধ করে থাকে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে নিউজপ্রিন্ট আমদানি করতে গেলে প্রতি মেট্রিক টনের দাম দাঁড়ায় ৬৭ হাজার টাকা। নতুন নিয়মে প্রতি টনে আমদানি খরচ দাঁড়াবে ৮৫ হাজার টাকা। অর্থাৎ প্রতি টনে ১৮ হাজার টাকা খরচ বাড়বে। এতে শুধু নিউজপ্রিন্ট বাবদ খরচ ২৭ শতাংশ বাড়বে।
সংবাদপত্র ও মুদ্রণশিল্পের জন্য ব্যবহূত প্রতিটি প্লেটের বর্তমান আমদানি খরচ ৪৫০ টাকা। আমদানি শুল্ক ৯ শতাংশ বেড়ে গেলে এর সঙ্গে ভ্যাট ও ইনস্যুরেন্স বাবদ খরচ মিলিয়ে অতিরিক্ত ১২ শতাংশ খরচ হবে। এতে প্রতি প্লেটে খরচ দাঁড়াবে ৫৫৪ টাকা।
হিসাব করে দেখা গেছে, নিউজপ্রিন্ট ও প্লেটের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব কার্যকর হলে পত্রিকাগুলোর মোট খরচের সঙ্গে অতিরিক্ত ২৮ শতাংশ খরচ যোগ হবে, যা বেশির ভাগ পত্রিকার পক্ষে বহন করা সম্ভব হবে না।
এ ব্যাপারে সম্পাদক পরিষদের সভাপতি ও সমকাল পত্রিকার সম্পাদক গোলাম সারওয়ার প্রথম আলোকে বলেন, সংবাদপত্রের প্রকাশনা ব্যয় এমনিতেই অনেক বেড়ে গেছে। এতে অনেক পত্রিকারই নিয়মিত প্রকাশনা চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। এ পরিস্থিতিতে সংবাদপত্রশিল্পের পক্ষ থেকে নিউজপ্রিন্টের আমদানি শুল্ক উঠিয়ে দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছিল। সেই দাবির দিকে কর্ণপাত না করে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে অর্থমন্ত্রী আমদানি শুল্ক বাড়ানোর সুপারিশ করলেন। তাই সংবাদপত্রশিল্প বাঁচাতে হলে আমদানি শুল্ক বাড়ানোর সুপারিশ প্রত্যাহার করে শূন্য শুল্কের নিয়ম চালু করতে হবে।
উল্লেখ্য, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে নিউজপ্রিন্ট আমদানির ওপর শুল্ক শূন্য শতাংশ করা হয়। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর তা বাড়িয়ে ৩ শতাংশ করা হয়। চার বছর ধরে এই ৩ শতাংশ হারে কর আরোপ করা হয়েছিল। চলতি বাজেটে এই শুল্কের পরিমাণ বাড়ানোর কারণ হিসেবে সংবাদপত্রশিল্পের মালিক ও সম্পাদকেরা মনে করছেন, একটি বিশেষ প্রতিষ্ঠানকে সুবিধা দিতে সরকার আমদানি শুল্কের পরিমাণ বাড়িয়েছে। এতে বেশির ভাগ সংবাদপত্রের খরচ মিটিয়ে টিকে থাকা কঠিন হয়ে যাবে।
দেশীয় নিউজপ্রিন্টে পাঠকের ক্ষতি: অর্থমন্ত্রীর বাজেট প্রস্তাবে দেশীয় নিউজপ্রিন্ট-শিল্পের জন্য বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে দেশীয় নিউজপেপার কারখানাগুলো নানা ধরনের সুবিধা পেয়ে এলেও তারা এখনো সংবাদপত্রের জন্য মানসম্পন্ন কাগজ উৎপাদন করতে পারেনি।
অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন, দেশে বর্তমানে ৬৭টি কাগজ উৎপাদনকারী শিল্প রয়েছে। নিউজপ্রিন্টের চাহিদা বছরে ১ দশমিক ২ লাখ টন। এর বিপরীতে ৬৭টি কাগজ উৎপাদনকারী কারখানার সম্মিলিত উৎপাদনক্ষমতা প্রায় তিন লাখ টন। এই তথ্য সঠিক নয় বলে জানিয়েছেন সংবাদপত্রশিল্পের প্রকাশক ও সম্পাদকেরা। কেননা বেশির ভাগ কারখানাই তাদের ক্ষমতা অনুযায়ী উৎপাদন করতে পারছে না। সংবাদপত্রশিল্প বছরে প্রায় ৫০ হাজার টন নিউজপ্রিন্ট বিদেশ থেকে রেয়াতি সুবিধায় সরাসরি আমদানি করে থাকে।
অর্থমন্ত্রী বলেন, আমদানির ক্ষেত্রে আলোচ্য অসংগতির কারণে দেশীয় কাগজশিল্প আর্থিক সংকটের সম্মুখীন। এই অবস্থায় দেশীয় কাগজশিল্পের স্বার্থে সংবাদপত্র ও প্রকাশনাশিল্পের আমদানি করা নিউজপ্রিন্টের ক্ষেত্রে বিদ্যমান রেয়াতি সুবিধা প্রত্যাহারের সুপারিশ করা হচ্ছে।
তবে দেশীয় কাগজ কারখানাগুলো সূত্রে জানা গেছে, সংবাদপত্রে ব্যবহূত হওয়া রোল নিউজপ্রিন্ট মাত্র দু-তিনটি কারখানা উৎপাদন করতে পারে। তা-ও নিয়মিতভাবে উৎপাদিত হয় না। এই কারখানাগুলো পুরোদমে উৎপাদনে গেলেও তাদের পক্ষে সংবাদপত্রের জন্য প্রয়োজনীয় নিউজপ্রিন্ট সরবরাহ করা সম্ভব নয়। প্রত্যাশিত মান না থাকায় দেশের শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্রগুলো আমদানি করা নিউজপ্রিন্টেই ছাপতে বাধ্য হয়।
বর্তমানে প্রতি টন দেশীয় নিউজপ্রিন্টের দাম ৬০ থেকে ৬৪ হাজার টাকা। কিন্তু এর মান ভালো নয়, প্রচুর ধুলা থাকে। ফলে ছাপার সময় বারবার রোল ছিঁড়ে মেশিন বন্ধ হয়ে যায়। আর আমদানি করা নিউজপ্রিন্টের পুরুত্ব প্রতি বর্গমিটারে ৪৫ গ্রাম। একটি রোলে দেশীয় কাগজের পুরুত্ব কোথাও ৪৪ গ্রাম আবার কোথাও ৪৬ গ্রাম থাকে। এতে ছাপার মান বজায় রাখা যায় না। এক পাতার ছাপা অন্য পাতায় দেখা যায়। প্লেট পরিবর্তন করায় কাগজ অপচয়ের পরিমাণ ১০ শতাংশ বেড়ে যায়। কাগজের শক্তি কম থাকে। দেশি কাগজের পুরুত্ব ঠিক থাকে না বলে এতে রঙিন ছাপা খুবই নিম্নমানের হয়।
এক কেজি বিদেশি নিউজপ্রিন্ট থেকে ২৪ পৃষ্ঠার আট থেকে নয়টি পত্রিকা ছাপা যায়। আর দেশি কাগজে পত্রিকা ছাপা যায় ছয় থেকে সাতটি। তার পরও ছাপতে গিয়ে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ কাগজ নষ্ট হয়। ফলে প্রতি টন দেশি কাগজের প্রকৃত দাম পড়ে ৭০ হাজার টাকা।
সংবাদপত্রমালিকদের সংগঠন নোয়াব সূত্রে জানা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে জ্বালানি তেলের দাম কয়েক দফা বাড়ার ফলে পত্রিকার ছাপাখানা, পরিবহনসহ অন্যান্য খাতে খরচ বেড়ে গেছে। এ ছাড়া ছাপার কাজে ব্যবহূত কালি, খুচরা যন্ত্রাংশসহ বেশ কিছু খাতে খরচ নিয়মিতভাবে বাড়ছে। কিন্তু এখন বাজেট প্রস্তাবের কারণে সংবাদপত্রশিল্প গভীর সংকটে পড়বে।
সরকারের গঠিত অষ্টম ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়িত হলে সংবাদপত্রশিল্পে ব্যয়ের পরিমাণ আরও অনেক বেড়ে যাবে। নিউজপ্রিন্টে অতিরিক্ত কর দিতে হলে এবং ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়ন করতে গেলে বেশির ভাগ সংবাদপত্রের পক্ষে টিকে থাকা অসম্ভব বলে মনে করছেন অধিকাংশ সম্পাদক ও প্রকাশক।