বিএনপির সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান তারেক রহমান তার দলেরই সিনিয়র নেতাদের কাছে উপেক্ষিত থাকছেন। মিডিয়ায় নিজেদের জাহির করতে ব্যস্ত নেতাদের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে বিএনপির এই ভবিষ্যত কর্ণধারের উপেক্ষিত থাকার বিষয়টি বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
সর্বশেষ গত শুক্রবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে তারেক ইস্যুতে আয়োজিত এক আলোচনা সভার আগে অন্য স্থানে মিডিয়ায় কথা বলেন ওই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। আর ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়ার কথা থাকলেও একই সময়ে নিজের বাসায় সাংবাদিকদের ডেকে বসেন দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
দলের এ দুই শীর্ষ নেতার এমন তৎপরতা দলের মধ্যেই নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এ ঘটনায় তারেক রহমানকে উপেক্ষা করা হয়েছে বলেই মনে করছেন তৃণমূল নেতাকর্মীরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপি’র এক প্রভাবশালী নেতা বাংলানিউজকে বলেন, তারেক রহমানকে নিয়ে কেউই ভাবছেন না। তারা মিডিয়ায় নিজেদের হাইলাইট করা নিয়ে ব্যস্ত রয়েছেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের তারেক রহমানের অনুষ্ঠানে যোগদান করার কথা থাকলেও তিনি একই সময় বাসায় সাংবাদিকদের ডাকলে প্রেসক্লাবের অনুষ্ঠান সাংবাদিক সংকটে পড়ে। আর এ নিয়ে হইচই শুরু হয় দলের ভেতরই।
প্রেসক্লাবের অনুষ্ঠানে উপস্থিত তারেক অনুসারীরা মির্জা ফখরুলের এমন আচরণে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
শুক্রবার সকাল এগারোটায় জাতীয় প্রেসক্লাবের তৃতীয় তলার হল রুমে ন্যাশনালিস্ট রিসার্চ ফাউন্ডেশন (এনআরএফ) নামে একটি সংগঠন নাগরিক সমাবেশ আয়োজন করে। এই সংগঠনটির আহবায়ক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. এমাজ উদ্দীন আহমেদ। অনুষ্ঠান আয়োজনের আহবায়ক ছিলেন ফরিদ উদ্দিন আহমেদ। প্রধান অতিথি ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ।
একই অনুষ্ঠানে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবকে নিয়ে আসার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল দলটির সহ-দপ্তর সম্পাদক শামিমুর রহমান শামীমকে। যদিও তিনি বাংলানিউজের কাছে এমন দায়িত্বের কথা স্বীকার করেন নি।
প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠানের বিষয় ছিল ‘তারেক রহমানের বিরুদ্ধে হাসিনা সরকার ও দুদকের অব্যাহত ষড়যন্ত্র এবং প্রতিহিংসার প্রতিবাদ।’
অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শতাধিক শিক্ষক ও বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অনুষ্ঠান আয়োজক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, ২৭ মে’র সিদ্ধান্ত অনুযায়ী- ২৯ মে এ অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য প্রেসক্লাবের নীচতলার বড় মিলনায়তনটি বুকিং দেওয়া হয়েছিল। তখন মির্জা ফখরুল দেশের বাইরে থাকায় ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদকে প্রধান অতিথি হিসেবে ওই দিনই দাওয়াত দেওয়া হয়।
পরে ২৯ মে ১৮ দলীয় জোট দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা হরতাল আহবান করায় অনুষ্ঠানের তারিখ পরিবর্তন করে ৩১ মে (শুক্রবার) করা হয়। বিষয়টি মওদুদ আহমদকেও জানানো হয়। এরইমধ্যে ২৯ মে দেশে ফিরে আসেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
ফরিদ জানান, ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব দেশে আসার পর বিএনপির সহ-দফতর সম্পাদক শামীমুর রহমান শামীমকে দায়িত্ব দেওয়া হয় অনুষ্ঠানের বিষয়টি তাকে (মির্জা ফখরুল) অবহিত করার।
কিন্তু মির্জা ফখরুল এ ব্যাপারে বাংলানিউজকে জানান, তিনি প্রেসক্লাবের অনুষ্ঠান সম্পর্কে অবহিত নন। তাকে এ ব্যাপারে কিছুই জানানো হয়নি।
তারেক ভক্ত ও দলটির নেতা-কর্মীদের প্রশ্ন, মওদুদ আহমদ ও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অনুষ্ঠান নিয়ে কেন দ্বিমুখী আচরণ করছেন। এটা কি দলের মধ্যে পরস্পরের দ্বন্দ্ব, নাকি বিএনপিকে ধ্বংস করতে আভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রের অংশ- এমন প্রশ্নও অনেকের। অনুষ্ঠানটির পর থেকেই দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে।
তবে মাঠ পর্যায়ের নেতারা এটাকে তারেককে মাইনাস করারই ষড়যন্ত্র কি না তাও ভাবছে।
ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ প্রেসক্লাবে তারেক রহমান ইস্যূতে আয়োজিত অনুষ্ঠানে যোগদানের এক ঘণ্টা আগে বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব মওলানা জুনায়েদ বাবুনগরীকে দেখতে যান। সেখানে তিনি টেলিভিশন চ্যানেলের রিপোর্টারদের সঙ্গে কথাও বলেন।
প্রশ্ন উঠেছে, তারেক রহমান ইস্যুতে আয়োজিত অনুষ্ঠানে যাবেন মওদুদ, এ কথা জানার পরও যারা মওদুদ আহমদকে বাবু নগরীকে দেখতে নিয়ে গেছেন তারা কারা? সেখানে না হয় দেখতে গেলেন, কিন্তু মিডিয়ায় কথা বলে দ্বিতীয় অনুষ্ঠানটিকে গুরুত্বহীন করার কারণ কি?
ওদিকে একই সময় উত্তরায় নিজ বাসভবনে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বেশ কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেল ও অনলাইন পত্রিকার সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। ফলে তারেক রহমান ইস্যুতে ন্যাশনালিস্ট রিসার্চ ফাউন্ডেশন আয়োজিত প্রেসক্লাবের অনুষ্ঠানটি মিডিয়ার কাছে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে।
অনেকে মন্তব্য করেন- একই সময় প্রেসক্লাবে দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানের ইস্যুতে অনুষ্ঠান থাকার পরও মহাসচিব তার বাসায় সাংবাদিকদের কেন ডাকলেন? যদি তিনি নিজে না ডাকেন তাহলে কারা এই ষড়যন্ত্রকারী?
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ন্যাশনালিস্ট রিসার্চ ফাউন্ডেশনের এক কর্মকর্তা জানান, মহাসচিবের বাসায় সাংবাদিকদের ডেকেছেন চেয়ারপারসনের একজন কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, “ওই কর্মকর্তা সাংবাদিকদের উত্তরার বাসায় যেতে বলায় তাদের অনুষ্ঠানে উপস্থিত কয়েকজন সাংবাদিক উত্তরা চলে যান। অনেকে মাঝ পথ থেকে উত্তরা চলে যান। তাৎক্ষণিকভাবে অনুষ্ঠান স্থল থেকে গুলশান অফিসের কর্মকর্তা শায়রুলকে ফোন করেন একজন নেতা।
তিনি শায়রুলের কাছে জানতে চান- প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠান চলছে, এ অবস্থায় মির্জা আলমগীরের বাসায় সাংবাদিকদের কে ডেকেছে? জবাবে শায়রুল বলেন, আমি কিছুই জানি না।
ওই কর্মকর্তা আরো জানান, ঘটনা জানাজানি হয়ে যাওয়ায় শায়রুল নিজেকে বাঁচাতে প্রেসক্লাবের অনুষ্ঠানে এসে যোগ দেন।
জানতে চাইলে শায়রুল কবির বলেন, প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠান আছে তা আমি জানতাম না। আর মির্জা ফখরুলের বাসায় সাংবাদিকরা কেন গেছে তাও জানি না।
এ প্রসঙ্গে মির্জা ফখরুলের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমি বা আমার পক্ষ থেকে কেউ সাংবাদিকদের আমার বাসায় ডাকেন নি। সাংবাদিকরা নিজে থেকেই আমার বাসায় এসেছিলেন।”
তিনি বলেন, “কেউ আমার বাসায় এলে আমি তো তাকে বের করে দিতে পারি না।”
একই সময় তারেক রহমানকে নিয়ে প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠান ছিল, আবার আপনিও সাংবদিকদের বাসায় ডাকলেন, তাহলে প্রেসক্লাবের অনুষ্ঠানটি গুরুত্বহীন হয়ে গেল না?- এমন প্রশ্নের জবাবে মির্জা আলমগীর বলেন, “প্রেসক্লাবে কি অনুষ্ঠান ছিল তা আমি জানি না। কেউ আমাকে এ বিষয়ে কিছু বলেন নি।”
প্রেসক্লাবে উপস্থিত তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত বিএনপির এক সিনিয়র নেতা বাংলানিউজকে বলেন, “বিষয়টি খুবই দু:খজনক। দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানের অনুষ্ঠানটিকে সিনিয়র দুই নেতার গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল। তারা তা না করে বরং এই অনুষ্ঠানের ক্ষতি করেছেন।”
বিষয়টি তিনি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে জানাবেন বলেও জানান।
প্রেস ক্লাবের আর প্রধান অতিথি হয়েও এ অনুষ্ঠানের আগে বারডেম হাসপাতালে বাবুনগরীকে দেখতে গিয়ে ব্যারিস্টার মওদুদের মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলাকেও মেনে নিতে পারছেন না বলে জানান ওই নেতা।
তিনি বলেন, “একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার আগে অন্য জায়গায় মিডিয়ায় কথা বললে দ্বিতীয় অনুষ্ঠানটি এমনিতেই গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে, এটাই স্বাভাবিক।”
মির্জা ফখরুলের ওপর সাংবাদিকরা ক্ষুব্ধ
এদিকে পর পর কয়েকটি ঘটনায় মির্জা ফখরুলের ওপর বিএনপি বিটের বেশ কিছু সাংবাদিক ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন।
কিছুদিন আগে কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেলের কয়েকজন সাংবাদিকের সঙ্গে রাজধানীর এক হোটেলে ডিনার করেন মির্জা ফখরুল। বিষয়টিকে অন্য সাংবাদিকরা ভাল চোখে দেখেন নি।
বিএনপি বিটের অনেক সাংবাদিককে বলতে শোনা যায়, যেখানে বিটে শতাধিক সাংবাদিক রয়েছেন সেখানে ১০/১২ জন সাংবাদিককে নিয়ে মির্জা ফখরুলের ডিনার করা ঠিক হয়নি।
ওই বিতর্ক শেষ না হতেই গত ২৯ মে সিঙ্গাপুর থেকে দেশে ফেরার সময় আর এক বিতর্কের জন্ম দেন মির্জা ফখরুল।
তিনি আগে থেকে তার ঘনিষ্ঠজনদের বলেন, দেশে ফেরার সময় দলীয় নেতাকর্মী ও সাংবাদিকরা যেন বিমানবন্দরে না আসেন। সে অনুযায়ী, মির্জা ফখরুলের কাছের লোকেরা কোনো মিডিয়াকে জানায় নি তিনি কখন দেশে আসবেন। তবে এরই মধ্যে কেউ একজন দু’টি টেলিভিশন চ্যানেল ও একটি পত্রিকার রিপোর্টারকে মির্জা ফখরুলের দেশে আসার খবর জানিয়ে দেয়।
ওই দু’টি চ্যানেলের দু’জন সাংবাদিক ও পত্রিকার রিপোর্টার বিমানবন্দরে উপস্থিত হন মির্জা ফখরুল আসার সময়। তিনি বিমানবন্দরে তাদের সঙ্গে কথা বলেন এবং চ্যানেল দু’টি তা প্রচার করে। এতে অন্যান্য চ্যানেলের রিপোর্টারসহ বিএনপি বিটের সব সাংবাদিক ফখরুলের ওপর ক্ষুব্ধ হন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মির্জা ফখরুল বলেন, “আমরা যখন বিদেশ থেকে দেশে আসি তখন কোনো চ্যানেল বা সাংবাদিক কিছু জানতে চাইলে আমরা তাদের উত্তর দেই। এবারেও বিমানবন্দরে নামার পর দু’জন সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলেছি।”
তবে তিনি বলেন, “আমাদের পক্ষ থেকে কোনো সাংবাদিককে বিমানবন্দরে আসতে বলা হয়নি। তারা হয়তো বিমানের সিডিউল থেকে আমার আসার খবর জেনে থাকতে পারেন।”
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ঘনিষ্ট একজনের কাছে এসব বিষয় জানতে চাইলে তিনি খালেদা জিয়ার প্রেসউইং এর এক কর্মকর্তাকে সরাসরি দায়ী করে বলেন, “ওই ব্যক্তিই মির্জা ফখরুলকে ডোবাবেন।