বাসে করে বাসায় ফিরছিলাম। আমার পাশের সিটে বসে ৮-১০ বছরের একটি বাচ্চা ছেলে ভোঁস ভোঁস করে ঘুমাচ্ছে। ছেলেটি একটি স্বচ্ছ পলিথিনের ব্যাগ শক্ত করে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। ব্যাগের মধ্যে ময়লা পুরোনো কয়েকটি শার্ট-প্যান্ট। বাস চলতে শুরু করতেই ছেলেটি ঘুমের চোটে গড়িয়ে আমার গায়ের ওপর পড়ে গেল। আমি বিরক্ত হয়ে ধমক লাগালাম। ছেলেটির কোনো হুঁশ নেই। এমন কাহিল হয়ে আমি কাউকে ঘুমাতে দেখিনি। আমার হঠাৎ সন্দেহ হলো, নেশাটেশা করেনি তো! টোকাই ছেলেপিলে নাকি আজকাল বিভিন্ন রকমের জিনিস খেয়ে নেশা করে! এ ব্যাটাও ও রকম কিছু খেয়েছে কি না, কে জানে! বাসের হেলপার ভাড়া চাইতে এসে ছেলেটিকে ঠেলে জাগিয়ে দিল। হঠাৎ জেগে গিয়ে ছেলেটি বোকার মতো চারদিকে তাকাতে লাগল। আমার দিকে তাকাতেই মওকা পেয়ে আমি একটা ধমক দিলাম, ‘সারা রাত ঘুমাস নাই?’ ছেলেটা ঘাবড়ে গিয়ে বলল, ‘সকাল ছয়টায় উঠছি তো, এই জন্য ঘুম আসতাছে।’
আমি আবার ধমক দিই, ‘এত সকালে উঠে কী করিস?’ ছেলেটা ঘুমজড়ানো কণ্ঠে বলল, ‘পেপার বেচি।’ আমার সামান্য কৌতূহল জাগে, ‘পেপার বিক্রি করে কত টাকা পাস?’ ছেলেটা জবাব দেয়, ‘ডেইলি ৬০-৭০ ট্যাকা হয়।’
‘তারপর সেই টাকা দিয়ে কী করিস?’ ছেলেটি মৃদু হাসে, ‘পরের দিন আবার পেপার কিইন্যা বেচি, আর কিছু ট্যাকা জমাই।’
এই বাচ্চা ছেলের ব্যবসার কথা শুনে আমার ভালোই লাগে। আমি আনমনে প্রশ্ন করি, ‘দুপুরে ভাত খেয়েছিস?’ ছেলেটা মুখ কালো করে মাথা নিচু করে ফেলে, ‘খাই নাই।’ আমি অবাক হই, ‘খাস নাই কেন?’
‘কতক্ষণ পরে হোটেলগুলাতে গিয়া খাবার খুঁজমু। মাইনসের খাওন বাইচা গেলে সেগুলা আমাগো খাইতে দেয়।’ আমি কী বলব বুঝতে পারি না, ‘যদি না দেয়, তখন কী করবি? আর ওদের যদি খাবার না থাকে?’ ছেলেটার মুখ উজ্জ্বল হয়, ‘তাইলে রাইতে আবার যামু। কোনো না কোনো একসময় তো দিব!’
আমার বিস্ময় কাটে না, ‘তুই সকাল থেকে এখনো কিছু খাস নাই?’ ছেলেটা হাসে, ‘সকালে একটা শিঙাড়া খাইছি।’
এখন বাজে বিকেল চারটা। সকালে একটা শিঙাড়া খেয়ে ৮-১০ বছরের একটা বাচ্চা ছেলে সারা দিন কাটিয়ে দিল! আমি আইনজীবী, কোর্টে সারা দিন নানান কিসিমের মানুষ দেখে অভ্যস্ত।
মনে মনে বলি, পৃথিবী খুব কঠিন জায়গা। কাউকে কাউকে এভাবেই বেঁচে থাকতে হয়। এই ছেলের কথা শুনে একদম আবেগপ্রবণ হওয়া যাবে না। আমি ছেলেটির দিকে তাকাই না, জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকি। আমার চোখ হঠাৎ করে চকচক করতে থাকে। ছেলেটিকে বলি, ‘তুই আমার সঙ্গে ওয়াসার মোড়ে নামবি? তোকে হোটেলে ভাত খাওয়াব।’ ছেলেটা রাজি হয়।
প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত মানুষের খাওয়া দেখার মধ্যে আনন্দের কিছু নেই। আমি অন্যদিকে তাকিয়ে থাকি। ওকে জিজ্ঞেস করি, ‘তোর নাম কী?’ ছেলেটি মুখভর্তি ভাত নিয়ে কথা বলে, ‘আমার নাম রিয়াদ, আমার ছোড ভাইয়ের নাম লিটন। আমার বাড়ি কুমিল্লা।’ আমি তাকে ধমকে উঠি, ‘বাড়ি কুমিল্লা হলে তুই ব্যাটা বাচ্চা ছেলে একলা একলা চট্টগ্রাম শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছিস কেন? তোর বাবা কী করে?’
ছেলেটি হাসে, ‘বাবা নাই।’ আমি আবার তাকে ধমকে উঠি, ‘বাবা নাই তো কী হয়েছে, কত লোকের বাবা নাই। তো মা নাই? মা কী করে?’ ছেলেটি আবারও হাসে, ‘মা-ও নাই।’ আমি হঠাৎ করে থতমত খেয়ে যাই, ‘তাহলে তোর ছোট ভাই কার কাছে থাকে?’
‘নানির কাছে থাকে। মাঝে মাঝে আমি দেখতে যাই।’
আমি আর কোনো প্রশ্ন করার সাহস পাই না, বোকার মতো বসে থাকি। আমার বোকা বোকা চেহারা দেখে হোটেলের কর্মচারী আমার প্যান্টের ওপর তরকারির ঝোল ফেলে দেয়। তারপর আমি ধমক দেওয়ার আগেই পুঁচকে কর্মচারীরা ভয়ে ঘাবড়ে গেল। রিয়াদ ততক্ষণে তার খাওয়া শেষ করে ফেলেছে। সে একগাল হেসে আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘ছার, আপনে বিয়া করছেন?’
আমার ইচ্ছা হলো ব্যাটাকে কষে একটা চড় দিতে। আমি রেগে গিয়ে বলি, ‘আমারে দেইখা কি মনে হয় আমার বিয়ার বয়স হইছে?’ রিয়াদ হাসে, ‘বিয়া করলে বউরে বলতে পারতেন আপনের প্যান্টটা ধুইয়া দিতে।’
আমি হেসে ফেলি। আমার হঠাৎ করে মনে হয়, আজকে না হয় সে পেট ভরে ভাত খেয়েছে, কিন্তু কালকে কী হবে! জিইসি মোড়ের ফুটপাত যার ঠিকানা, তাকে দেখে মনে হলো না এত সব চিন্তা তার মাথায় আছে। সে তার পুঁটলিটা মাথার চারপাশে ঘোরাতে ঘোরাতে হাঁটতে শুরু করল। আমি প্যান্টের ওপর একগাদা ঝোল নিয়ে বেকুবের মতো ফুটপাতে দাঁড়িয়ে রইলাম।