প্রথম অগ্রাধিকারেই বড় ব্যর্থতা

0
180
Print Friendly, PDF & Email

এবার আওয়ামী লীগ সরকারের বড় সাফল্য প্রথমবারের মতো মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির গড় ৬ শতাংশের ওপরে নিয়ে যাওয়া। সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা নিয়ন্ত্রণহীন মূল্যস্ফীতি। গড় মূল্যস্ফীতি এ সময়ে সাড়ে ৮ শতাংশের নিচে আর নামানো যায়নি।
গত পাঁচ বছরে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে, গ্রামীণ অর্থনীতিতে কৃষিমজুরিও বেড়েছে। কিন্তু যাঁরা স্থির আয়ের মানুষ, তাঁরা প্রবৃদ্ধির সুফল তেমন অনুভব করেননি। কারণ, উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে একবারের জন্যও এসব মানুষ রেহাই পাননি। ফলে আয় যতটা বেড়েছে, ব্যয় বেড়েছে তার চেয়ে বেশি।
আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম অগ্রাধিকার ছিল দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ। এ প্রতিশ্রুতি পূরণে কোনো সাফল্যই নেই। নির্বাচনী ইশতেহারের এ অগ্রাধিকারের কথা অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত নিজেও প্রথম বাজেটে উল্লেখ করেছিলেন। ২০০৯-১০ অর্থবছরের ওই বাজেটে আরও তিন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি। যেমন, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, সরকারি ব্যয়ের প্রসার এবং বিনিয়োগের হার বৃদ্ধি। সাড়ে চার বছরে অর্থমন্ত্রী সরকারি ব্যয় ঠিকই বাড়িয়েছেন, কিন্তু কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগ বাড়াতে তেমন সফল হতে পারেননি।
তবে খরচ বাড়াতে পেরেছে সরকার। এর মধ্যে উন্নয়ন ব্যয়ের তুলনায় অনুন্নয়ন ব্যয় বেড়েছে বেশি। চলতি ব্যয়ের মধ্যে সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে ভর্তুকি ব্যয়, বিশেষ করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি তেল ও কৃষি খাতের ভর্তুকি অনেক বেশি বেড়েছে। মোট ভর্তুকির ৭২ শতাংশই ব্যয় হয়েছে এ তিন খাতে। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়লেও অর্থনীতির দায় বেড়েছে।
যোগাযোগ করা হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান এম এ তসলিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রবৃদ্ধির অর্জন ভালো। আর গত সাড়ে চার বছরে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ও অভ্যন্তরীণ যথেষ্ট অনুকূলে ছিল। বড় কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হয়নি। এ সময়টায় অর্থনীতিকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ ছিল, যা আমরা হারিয়েছি।’
এম এ তসলিম আরও বলেন, সাড়ে চার বছরে মূল্যস্ফীতি ৪৫ শতাংশ বেড়েছে। অর্থাৎ নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা অনেক কমেছে। কেননা, মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করে মজুরি ও আয় বাড়েনি। আবার বিপুল পরিমাণ সম্পদ বিতরণে বৈষম্য দেখা দিয়েছে। ধনীরা ধনী হচ্ছেন, গরিবেরা পিছিয়ে পড়ছেন। সুতরাং, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের সাফল্য সীমিত।
প্রবৃদ্ধির সাফল্য: বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। দেশে প্রথমবারের মতো গড় প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের বেশি হয়েছে। এর আগে বিএনপি সরকারের সময়ের পাঁচ বছরে গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ৫ দশমিক ৭ শতাংশ। স্বাধীনতার পর ১৯৯৫ সালের আগে কখনোই গড় প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশের বেশি হয়নি।
প্রবৃদ্ধি বাড়লেও বর্তমান সরকারের সময় মাত্র দুবার লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা গেছে। যেমন, ২০০৯-১০ অর্থবছরের প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ এবং পরের অর্থবছরে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ। কিন্তু এ ধারা আর ধরে রাখা যায়নি। পরপর দুই অর্থবছরেই প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিক পতন ঘটেছে। লক্ষ্য ছিল ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে যাওয়ার। অথচ যত লক্ষ্য বাড়ানো হয়েছে, অর্জন তত কমেছে।
২০১১-১২ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭ শতাংশ। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ২৩ শতাংশ। চলতি ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৭ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে তা ৬ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশের বেশি হবে না। যদিও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা মনে করে, এবারের প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের নিচেই থাকবে। গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের হিসাবে লক্ষ্যমাত্রা ছুঁতে না পারায় দেশে এখন পর্যন্ত এ সরকারের আমলে ১০ হাজার ৬৫৩ কোটি টাকার মোট দেশজ উৎপাদন কম হয়েছে।
প্রবৃদ্ধি বাড়ায় একধরনের ইতিবাচক প্রভাবও পড়েছে দারিদ্র্য বিমোচনে। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে গত এক দশকে দেশের দেড় কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমা থেকে বের হয়ে এসেছেন। তবে দারিদ্র্য বিমোচনের হারও লক্ষ্যমাত্রা ছুঁতে পারছে না।
নির্বাচনী ইশতেহারে বলা আছে, ‘২০১৩ সালের মধ্যে দারিদ্র্যসীমা ও চরম দারিদ্র্যের হার যথাক্রমে ২৫ ও ১৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে। বর্তমানের সাড়ে ছয় কোটি দরিদ্রের সংখ্যা ২০১৩ সালে কমে দাঁড়াবে সাড়ে চার কোটি।’
বর্তমানে দরিদ্রের সংখ্যা সাড়ে পাঁচ কোটির বেশি। পরপর দুই অর্থবছর প্রবৃদ্ধির হার কমায় দারিদ্র্য বিমোচন কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় হয়নি। ফলে দিনবদলের সনদ থেকে এখনো অনেক দূরে আছে আওয়ামী লীগ সরকার। ‘দারিদ্র্য ঘুচাও, বৈষম্য রুখো’ ছিল সরকারের চতুর্থ অগ্রাধিকার।
মূল্যস্ফীতি: অর্থনীতির সূচকের ক্ষেত্রে সরকারের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতার নাম মূল্যস্ফীতি। কম দামে চাল খাওয়ানোর মতো জনপ্রিয় প্রতিশ্রুতি ভোটারদের আকৃষ্ট করেছিল। দেশে মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়ার প্রবণতা শুরু হয়েছিল বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের সময় থেকেই। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় এ মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশ হয়ে গেলে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ প্রথম অগ্রাধিকার হিসেবে নির্বাচনী ইশতেহারে ঢুকে পড়ে।
মূল্যস্ফীতিকে বলা হয় অর্থনীতির নীরব ঘাতক। নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় সাধারণ মানুষকে যে বাড়তি অর্থ ব্যয় করতে হয়, সেই অর্থকে বলা হয় একধরনের বাধ্যতামূলক কর। দেশের মানুষকে এ কর দিয়ে আসতে হচ্ছে। এতে ক্রয়ক্ষমতা কমেছে সীমিত আয়ের মানুষের।
সরকার গঠন করার পর ২০০৯ সালের শুরুতে মূল্যস্ফীতির হার কমে আসছিল। কিন্তু তা ধরে রাখা যায়নি। বছরের শেষ দিক থেকেই আবার বাড়তে শুরু করে। এর পর থেকে মূল্যস্ফীতি কখনো পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে ছিল না। বর্তমান সরকারের সময় গড় মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৪৮ শতাংশ। বিগত সরকারের সময় তা ছিল ৫ দশমিক ৩৪ শতাংশ। আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছরে ছিল ৮ দশমিক ৫৫ শতাংশ।
আগে বলা হতো, আন্তর্জাতিক বাজারের পণ্যমূল্যের প্রভাবে মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়ে। কিন্তু এখন গবেষকেরা বলছেন, বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির বড় কারণ মুদ্রা সরবরাহ। মূলত প্রবৃদ্ধি বেশি রাখার জন্য মুদ্রা সরবরাহ বাড়ানোর ক্ষেত্রে সরকারের আগ্রহ থাকে। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ স্থবির বলে সরকার নিজেই নানাভাবে অর্থ সরবরাহ বাড়িয়ে দেয়। অর্থমন্ত্রী নিজেও বলেছেন, শিল্প খাতে বিনিয়োগ কম বলেই তিনি কৌশল বদলিয়ে কৃষি খাতে ও গ্রামীণ অর্থনীতিকে গুরুত্ব দিয়েছেন। এতে অর্থ সরবরাহ বেড়েছে। ফলে মূল্যস্ফীতিও বৃদ্ধি পেয়েছে।
অর্থনীতির তত্ত্ব অনুযায়ী, প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য কিছুটা মূল্যস্ফীতি থাকা ভালো। তবে কত শতাংশ পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি থাকা ভালো, তা নিয়ে মতভেদ আছে। ভারতে গবেষণা করে বলা হয়েছে, তাদের জন্য ৪ থেকে ৫ শতাংশ পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি থাকাটা ভালো। এর বেশি হলে দীর্ঘ মেয়াদে প্রবৃদ্ধির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। গবেষকেরা মনে করেন, বাংলাদেশেও এ হার ৪ থেকে ৫ শতাংশ। তবে চলতি বাজেটে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা সাড়ে ৭ শতাংশ নির্ধারণ করার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে এ হার হবে এখন ৭ থেকে ৮ শতাংশ। যদিও অর্থনীতিবিদেরা বাংলাদেশ ব্যাংকের এ গবেষণা মানছেন না। কারণ, ভারতে সহনীয় মাত্রার মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশ হলে বাংলাদেশে তা কোনোভাবেই এর বেশি হতে পারে না।
বাংলাদেশ একই সঙ্গে উচ্চ প্রবৃদ্ধি এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে রয়েছে। তবে উচ্চ মূল্যস্ফীতি অব্যাহত থাকলে উচ্চ হারে জিডিপিও অব্যাহত থাকবে না বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। অর্থাৎ প্রথম অগ্রাধিকারে পিছিয়ে পড়লে বাকিগুলোও পিছিয়ে যাবে। এর লক্ষণও দেখা যাচ্ছে।

শেয়ার করুন