ব্যাংকার, ব্যবস্থাপনা এবং নজরদারির দুর্বলতার কারণে ব্যাংকিং খাতে বাড়ছে আদায় অযোগ্য ঋণের পরিমাণ। এছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়ায় বেসরকারি খাতেও এর প্রভাব পড়ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
তাদের মতে, ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে না পারলে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী ফন্দিফিকির করে ব্যাংকের অর্থ হাতিয়ে নেবেন, যা আর ফেরত পাওয়া যাবে না। এর লাগাম টানতে হবে। তা না হলে সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতসহ দেশের গোটা অর্থনীতিই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ শ্রেণিকরণ ও প্রভিশনিং পরিস্থিতি প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, ব্যাংকিং খাতে তিন মাসে আদায় অযোগ্য মানের ঋণ বেড়েছে সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা, যা বিতরণ করা মোট ঋণের ৮ দশমিক ৪১ শতাংশ।
প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত মার্চ শেষে ব্যাংকগুলোতে আদায় অযোগ্য ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৬ হাজার ৩৪ কোটি ৬১ লাখ টাকা, যা গত ডিসেম্বর শেষে ছিল ২৮ হাজার ৫০৪ কোটি ৪ লাখ টাকা। সে হিসেবে তিন মাসের ব্যবধানে আদায় অযোগ্য মানের ঋণ বেড়েছে ৭ হাজার ৫৩০ কোটি ৫৭ লাখ টাকা।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, আদায় অযোগ্য মানের ঋণ সবচেয়ে বেশি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে। এসব ব্যাংকে ১৯ হাজার ২৬১ কোটি ১ লাখ টাকার আদায় অযোগ্য মানের ঋণ রয়েছে, যা মোট বিতরণ হওয়া ঋণের ২১ দশমিক ৩৫ শতাংশ। এর মধ্যে সোনালী ব্যাংকেরই রয়েছে ১০ হাজার ২৮ কোটি ৮১ লাখ টাকা।
আর বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোতে ১১ হাজার ১৩০ কোটি ৬৯ লাখ টাকার আদায় অযোগ্য মানের ঋণ রয়েছে, যা ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণের ৩ দশমিক ৮৮ শতাংশ। বিদেশি ব্যাংকগুলোর ৭৪২ কোটি ৮৪ লাখ টাকার আদায় অযোগ্য ঋণ রয়েছে, যা শতকরা ৩ দশমিক ২৩ শতাংশ।
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর আদায় অযোগ্য ঋণের পরিমাণ ৪ হাজার ৯০০ কোটি ৬ লাখ টাকা, যা বিতরণ হওয়া ঋণের ১৭ দশমিক ৩৪ শতাংশ। এরমধ্যে ২ হাজার ৮৯৫ কোটি ৬৭ লাখ টাকা হলো বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা এ বিষয়ে বলেন, মন্দ ঋণ যে একেবারেই আদায় অযোগ্য তা নয়। তবে আদায়ের সম্ভাবনা ক্ষীণ। ঋণের বিপরীতে ব্যাংককে শতভাগ সঞ্চিতি রাখতে হয়। মূলত না বুঝে ঋণ দেয়ার কারণেই এটা বাড়ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোকে সময়ে সময়ে তাগাদা দেয়া হচ্ছে এ ঋণ আদায়ে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, ব্যাংকের অশ্রেণিকৃত বা সাধারণ ঋণের বিপরীতে এক থেকে পাঁচ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। স্পেশাল মেনশন অ্যাকাউন্ট বা এসএমএ ঋণের বিপরীতে প্রভিশন রাখতে বলা হয়েছে ২০ শতাংশ। আর খেলাপি ঋণের সাব-স্ট্যান্ডার্ডের (এসএস) ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ, সন্দেহমূলক ঋণের বিপরীতে ৫০ শতাংশ এবং আদায় অযোগ্য বা ক্ষতিকর ঋণের বিপরীতে ১০০ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন সার্কুলার অনুযায়ী, নির্দিষ্ট মেয়াদি ঋণের ৬ মাস কিস্তি পরিশোধ না করলে সাব-স্ট্যান্ডার্ড, ৯ মাসে কিস্তি না দিলে ডাউটফুল বা সন্দেহজনক এবং ১২ মাসের কিস্তি বকেয়া থাকলে আদায় অযোগ্য ক্ষতিকর হিসেবে শ্রেণিকৃত ঋণ হিসেবে ধরতে হবে। আগের নিয়ম অনুযায়ী যে কোনো পরিমাণের ঋণের কিস্তি ৩ মাস বকেয়া থাকলে সাব-স্ট্যান্ডার্ড, ৬ মাসের হলে ডাউটফুল এবং ৯ মাসের বকেয়া থাকলে আদায় অযোগ্য বা ক্ষতিকর হিসেবে গণ্য করা হতো। নতুন সার্কুলারে নির্দিষ্ট মেয়াদি ঋণ শ্রেণিকরণে ৩ মাস করে সময় বাড়ানো হয়েছে।