রসাতলে গেছে মানবাধিকার। বাংলাদেশের নাগরিকদের মানবাধিকার বলতে এখন আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। সরকারই এখন সবচেয়ে বড় মানবাধিকার হরণকারী হিসেবে জনগণের বিপরীতে দাঁড়িয়েছে। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, আইন-কানুনের প্রতি ন্যূনতম সম্মান না দেখিয়েই দেশের বরেণ্য নাগরিকদের ওপরও রাষ্ট্র তার দানবীয় চেহারা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে।
মানবাধিকারের চরম অবমাননা ঘটিয়ে ক্রসফায়ারে মৃত্যু ঘটছে প্রতিনিয়ত। নিরাপত্তা বাহিনী জীবিত লোককে গুম করার পাশাপাশি এখন লাশও গুম করছে বলে জোরাল অভিযোগ উঠেছে। রিমান্ডের বিভীষিকা কল্পনাকেও হার মানাচ্ছে। দিনের পর দিন নয়, এখন রিমান্ডে নিয়ে সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে বর্বর নির্যাতন চালানো হচ্ছে। রিমান্ডের নামে বর্বরতার শিকার হচ্ছেন বিরোধী রাজনীতিকসহ দেশের বরেণ্য ব্যক্তিরাও। হাস্যকর মামলায় গ্রেফতার করে অপরাধীর মতো জাতীয় নেতাদের পায়েও ডাণ্ডাবেড়ি পরানো হচ্ছে। তাদের ওপর চলছে বর্বর নির্যাতন। শান্তিপূূর্ণ সভা-সমাবেশে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে নিরস্ত্র জনতাকে হত্যা করছে আওয়ামী লীগ সরকার। গত কয়েক মাসে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে যত লোক নিহত হয়েছে, শেখ মুজিবের শাসনকাল বাদ দিলে বাংলাদেশের প্রায় ৩৮ বছরের শাসনেও এত নিরস্ত্র লোক মারা যায়নি। রাষ্ট্রীয় মদতে লঙ্ঘিত হচ্ছে শ্রমিক, সংখ্যালঘু আর নারীর অধিকার।
আওয়ামী লীগ সরকারের ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে নীরব রয়েছে পশ্চিমা দুনিয়া। এতে সরকার আরও বেপরোয়া হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। অথচ পূর্ববর্তী চারদলীয় জোট সরকারের আমলে এরা বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে ছিল অতিমাত্রায় সক্রিয়।
আওয়ামী লীগ সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের সর্বশেষ নজির ইসলামী ছাত্রশিবির সভাপতি দেলাওয়ার হোসেনের ওপর রাষ্ট্রীয় বাহিনীর বর্বরতম নির্যাতন। ৫১ দিনের রিমান্ডে তার ওপর এমন পৈশাচিক নির্যাতন চালানো হয়েছে, যাতে তিনি এখন কার্যত মৃতপ্রায়। এতেও সরকারের প্রতিহিংসা চরিতার্থ হয়নি। তাকে আরও রিমান্ডে নিতে চায় সরকার। মতলব একটাই—রিমান্ডে নিয়ে আরও ভয়াবহ নির্যাতন। অথচ দেলাওয়ার হোসেন দেশের অন্যতম
ছাত্র সংগঠন শিবিরের সভাপতি। ৫১ দিনের রিমান্ডে নিয়েও তার কাছ থেকে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ কোনো তথ্য আদায় করতে পারেনি রাষ্ট্রীয় বাহিনী। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া দেশের নাগরিক
সমাজ, মানবাধিকার কর্মী ও দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংগঠনগুলোও সরকারের বেপরোয়া মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে কার্যত নীরব রয়েছে। ফলে পরিস্থিতির উন্নতি হওয়া তো দূরের কথা, দিন দিন আরও শোচনীয় হচ্ছে।
হাতে গোনা কয়েকটি সংগঠন, যেমন মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন, বাংলাদেশের খ্যাতনামা মানবাধিকার সংগঠন অধিকার, আইন ও সালিশ কেন্দ্র সরকারের বেপরোয়া মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা স্মরণ করিয়ে দিলেও সরকার তাকে আমলে নিচ্ছে না।
ক্রসফায়ারে হত্যা, নিরস্ত্র প্রতিবাদী জনতার ওপর নিরাপত্তা বাহিনীর বেপরোয়া গুলিবর্ষণে হত্যাযজ্ঞ, রাষ্ট্রীয় বাহিনী দ্বারা গুম, নিরাপত্তা হেফাজতে বর্বর নির্যাতন, বেআইনি আটক, সভা-সমাবেশে বাধা প্রদান, গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করার জন্য সাংবাদিক নির্যাতন, প্রতিবাদী শ্রমিকদের ওপর পুুলিশি বর্বরতা, মানবাধিকার কর্মীদের কাজের ক্ষেত্রকে সঙ্কুচিত করা এখন নিত্যকার ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
যেসব মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন সেগুলো বলছে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য সরকার নিরাপত্তা বাহিনীকে সর্বময় ক্ষমতা দিয়ে রেখেছে। এ কারণে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে একের পর এক ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটলেও কারও জবাবদিহিতা নেই। সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী এমইউ আহমেদ এক বছরেরও বেশি সময় আগে নিরাপত্তা হেফাজতে মারা গেলেও এখন পর্যন্ত কারও বিচার হয়নি।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, হত্যা-নির্যাতনসহ যে কোনো মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাই ঘটুক না কেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রতিটি ক্ষেত্রেই পরিপূর্ণ দায়মুক্তি পেয়ে থাকে। এ কারণে তারা কারও মানবাধিকারের ধার ধারে না।
সরকার মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে প্ররোচনা দেয় বলে দেশে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে একের পর এক ক্রসফায়ারে হত্যা ও গুমসহ নানা ঘটনা ঘটেই চলেছে। ক্রসফায়ার বন্ধসহ নাগরিকদের মানবাধিকার রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এলেও আওয়ামী লীগের সাড়ে চার বছরের শাসনে প্রতিদিনই অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে।
নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে অহরহ ক্রসফায়ার ও গুমের ঘটনার পাশাপাশি সম্প্রতি রিমান্ডের নামে ঘটছে বর্বর নির্যাতনের ঘটনা। রিমান্ডের নামে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি শীর্ষস্থানীয় বিরোধী রাজনীতিকসহ দেশের বরেণ্য নাগরিকদের ওপরও বর্বর শক্তি প্রয়োগ করা হচ্ছে।
আমার দেশ-এর বরেণ্য সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে সাজানো মামলায় রিমান্ডে নিয়ে তার ওপর বর্বর নির্যাতন চালানো হয়েছে। রিমান্ডের নির্যাতনে তার জীবন বিপন্ন হওয়ার উপক্রম হয়। বর্তমানে তিনি বন্দি অবস্থায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিত্সাধীন।
বরেণ্য আলেম ও হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরীকে গ্রেফতার করে সরকার নির্যাতনের মাধ্যমে তার কাছ থেকে মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায় করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
তবে সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে দেশি-বিদেশি খ্যাতনামা কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠন কথা বললেও উল্টো পথে হাঁটছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান। সরকারের সুরে সুর মিলিয়েই কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন তিনি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখে তিনি তার নিজস্ব সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করেন।
এ কারণে আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায়ের পর অসংখ্য নিরস্ত্র সাধারণ মানুষ নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে নিহত হলেও তাতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের কোনো উপাদান খুঁজে পাননি মিজানুর রহমান। একই ঘটনা ঘটেছে শাপলা চত্বরের গণহত্যার ক্ষেত্রেও। তিনি শুধু হেফাজতের নিরস্ত্র আন্দোলনের বিরুদ্ধেই বিষোদ্গার করে গেছেন।
অন্যদিকে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে ক্রমাগত মিথ্যাচার করে যাচ্ছে সরকার। সম্প্রতি জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কমিশন আয়োজিত ইউনিভার্সাল পিরিওডিক রিভিউ সেশনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে মিথ্যাচার করেছেন বলে জানিয়েছে এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন ও অধিকার।
বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে বৃহস্পতিবার অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কর নির্যাতন চালানোর অভিযোগ আনা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, নিরাপত্তা বাহিনী নির্যাতনের ক্ষেত্রে যেসব পদ্ধতি প্রয়োগ করে, সেগুলোর মধ্যে মারধর করা, লাথি মারা, ছাদ থেকে ঝুলিয়ে রাখা, খাবার ও ঘুম থেকে বঞ্চিত করা এবং বৈদ্যুতিক শক দেয়া অন্যতম। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যা, নির্যাতন, গুম, নারী ও সংখ্যালঘু এবং পাহাড়ি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলোর ওপর নির্যাতনের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
৫৩ দিন রিমান্ডে মুমূর্ষু শিবির সভাপতি : ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি দেলাওয়ার হোসেনকে ৫ দফায় মোট ৫৩ দিন রিমান্ডে নিয়ে ব্যাপক নির্যাতন করা হয়েছে। গত সপ্তাহে রিমান্ড থেকে মুমূর্ষু অবস্থাতেই ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে তাকে পাজাকোলা করে পুলিশ সদস্যরা আদালতে হাজির করে।
আদালতে হাজির করা হলে দেখা যায়, নির্যাতন চালিয়ে তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত অবশ করে দেয়ায় তিনি হাঁটা-চলা করতে পারছেন না। তিনি বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত। চোখ-মুখ আর সারা শরীরে ভয়ঙ্কর নির্যাতনের চিহ্ন। তিনি চলত্শক্তিহীন। তার হাত-পা ফোলা। ছোপ ছোপ রক্ত জমা সারা দেহে। উঠে দাঁড়ানো দূরের কথা, বসার মতো শক্তিও নেই তার। হাত-পায়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা। দুই চোখ মুদিত। বসতে পারছেন না। মুখে কোনো কথাও নেই। তাকে আদালতেই পেছনে ঠেক দিয়ে ধরে রেখেছে পুলিশ সদস্যরা।
এরপর নতুন করে আরও ১৭ দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়েছে। কিন্তু তার শারীরিক অবস্থা দেখে আদালত নতুন করে রিমান্ডে না দিলেও ২৮ মে চিকিত্সকের পরামর্শসহ রিপোর্ট আদালতে জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়।
রিমান্ডে অসুস্থ বাবুনগরী : রিমান্ডে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের বয়োবৃদ্ধ আলেম মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরী। ৫ মে ঢাকা অবরোধের রাতে হেফাজতের সমাবেশে ত্রাস সৃষ্টির অভিযোগে মতিঝিল থানায় দায়ের করা হত্যা ও বিস্ফোরক মামলায় জুনায়েদ বাবুনগরীকে ৯ দিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ। এরপর ১৬ মে রিমান্ড শেষে আদালতে হাজির করা হলে নতুন করে তার বিরুদ্ধে ৩ মামলায় ২২ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে আদালত।
১৩ দিনের রিমান্ড শেষে গত সপ্তাহে জুনায়েদ বাবুনগরীকে আদালতে হাজির করা হলে তাকে বেশ অসুস্থ মনে হচ্ছিল।
হেফাজতে ইসলামের একটি সূত্র জানায়, মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরীকে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন চালিয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করতে চাপ প্রয়োগ করে গোয়েন্দা পুলিশ। কিন্তু তিনি পুলিশের চাপেও স্বীকারোক্তি দিতে সম্মত হননি। পরবর্তীতে তার কাছ থেকে সাদা কাগজে স্বাক্ষর নেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। স্বাক্ষর নেয়া সাদা কাগজে পুলিশ মনগড়া জবানবন্দি লিখে আদালতে হাজির করে। মাওলানা বাবুনগরী স্বেচ্ছায় কোনো জবানবন্দি দেননি। তবে পুলিশের দাবি, বাবুনগরী স্বেচ্ছায় জবানবন্দি দিয়েছেন।
বাবুনগরীর আইনজীবীরা জানান, তিনি ডায়াবেটিস, রক্তশূন্যতা ও চোখের সমস্যাসহ বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত। তার পায়ে আঘাতজনিত ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। উন্নত চিকিত্সা না পেলে গ্যাংগ্রিনে আক্রান্ত হয়ে তার পা কাটার মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।
মাহমুদুর রহমানের ওপর পৈশাচিক নির্যাতন : আমার দেশ-এর মজলুম সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে রিমান্ডে নিয়ে নির্মম নির্যাতন চালানো হয়েছে।
মাহমুদুর রহমানের দুই পায়েই গুরুতর জখম হয়েছে। লোহার নখ তার শরীরের মাংস ও হাড়ের ভেতর ঢোকানো হয়েছে। তাকে একের পর এক ইলেকট্রিক শক দেয়া হয়েছে।
ডিবি পুলিশ ইলেকট্রিক শক দেয়াসহ নানা উপায়ে তার ওপর নির্মম নির্যাতন চালিয়েছে। যখন তাকে আদালতে হাজির করা হয়, তখন তিনি বসতে পারছিলেন না। তার উভয় পায়ের মাংস উঠে গেছে। তার পোশাকে ছিল রক্তের দাগ।
গত ১১ এপ্রিল আমার দেশ কার্যালয় থেকে মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। ওই দিনই তাকে ১৩ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়। রিমান্ডে বর্বর নির্যাতনে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে জেলহাজতে পাঠানো হয়। সেখানে অনশনরত মাহমুদুর রহমানের জীবন সঙ্কটাপন্ন হয়ে পড়লে তাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
জামিনে মুক্তির পর কারাফটক থেকে গ্রেফতার : মিথ্যা মামলা দিয়ে এবং অনেক সময় কোনো মামলা ছাড়াই বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করে নিরাপত্তা বাহিনী। গ্রেফতারের পর আগেই করা কোনো একটি মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। শুধু সাধারণ নেতকর্মীরা নন, বিএনপি-জামায়াতের সিনিয়র নেতারাও সরকারের এ রকম মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হন প্রায়ই।
জামিনে মুক্তির পর কারাফটক থেকে ৮ মে যুবদলের সভাপতি সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন ও ১৬ মে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমদকে গ্রেফতার করা হয়। এ ছাড়া জামিনে মুক্ত যুগ্ম মহাসচিব বরকত উল্লা ১৬ মে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেন। সেখান থেকে বের হওয়ার পরপরই তাকে আবার গ্রেফতার করে পুলিশ।
উচ্চ আদালত থেকে জামিন পাওয়ার পর গত গত ১৮ মে কারাফটক থেকে বিএনপির ৫৩ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। পরে আটকের প্রায় নয় ঘণ্টা পর তাদের মধ্য থেকে ৪৮ জনকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
শাপলা চত্বরের গণহত্যা : আওয়ামী লীগ সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত মতিঝিলের শাপলা চত্বরের গণহত্যা। ৬ মে ভোররাতে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে বলে দাবি করেছেন দেশের অনেক রাজনীতিক ও মানবাধিকারকর্মী। বিদেশের গণমাধ্যমও বলছে প্রায় একই কথা। হেফাজতে ইসলামের নেতারা বলেছেন, সমাবেশে ব্রাশফায়ার আর গ্রেনেডসহ ভয়ঙ্কর আগ্নেয়াস্ত্রের হামলা চালিয়ে মুহূর্তেই শত শত ঘুমন্ত ও ইবাদতরত ধর্মপ্রাণ মুসলমান শিশু, যুবক ও বৃদ্ধকে হত্যা করা হয়েছে।
সেদিন প্রকৃতপক্ষে কত লোক নিহত হয়েছে, তা এখনও জানা সম্ভব হয়নি। তবে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র ও প্রত্যক্ষদর্শীরা হত্যাকাণ্ডের যে বিবরণ দিয়েছেন, তাতে এ কথা স্পষ্ট যে ওই কালরাতে শত শত লোককে হত্যা করেছে সরকারের নিরাপত্তা বাহিনী। অভিযোগ রয়েছে, শুধু হত্যা করেই তারা থেমে থাকেনি, হতভাগ্য এসব মুসল্লির লাশও গুম করা হয়েছে।
বিভিন্ন সামাজিক গণমাধ্যমের বরাত দিয়ে ৭ মে এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন জানায়, নিহতের সংখ্যা দুই হাজার ৫০০-এরও বেশি হতে পারে। হেফাজতে ইসলামের হিসাবে নিহতের সংখ্যা তিন হাজারেরও বেশি হবে। বিরোধী দল বিএনপি বলছে, শাপলা চত্বরে নিরাপত্তা বাহিনী সহস্রাধিক লোককে হত্যা করেছে। এ গণহত্যা ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতের চেয়ে ভয়াবহ ও জঘণ্য।
রাশিয়ার রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত বহুভাষিক টিভি স্টেশন আরটির (রাশিয়া টুডে) এক প্রতিবেদনে বলা হয়, শাপলা চত্বরে চার শতাধিক লোককে হত্যা করে হয়ে থাকতে পারে।
মার্কিন টিভি স্টেশন সিএনএন বার্তা সংস্থা এপির বরাত দিয়ে জানায়, ৬ মে রাতের নিহতের প্রকৃত সংখ্যা হয়তো কখনোই জানা যাবে না। বামপন্থি রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও নিউ এজ পত্রিকার সম্পাদক নুরুল কবির ৬ মে বাংলাভিশনের টক শোয় বলেছেন, সাংবাদিকদের কাছে তিনি শুনেছেন শত শত লোককে হত্যা করা হয়েছে। তবে তার ব্যক্তিগত ধারণা, অন্তত শতাধিক লোককে হত্যা করা হয়েছে।
মানবাধিকারকর্মীদের ধারণা, নিহতের সংখ্যা এত বেশি যে সরকার কোনো দিনই তা প্রকাশ হওয়ার সুযোগ দেবে না। একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেছেন, শাপলা চত্বরে তিনি ৫১টি লাশ নিজে গুনে দেখেছেন।