পরাধীনতা, শোষণের কবল থেকে জাতিকে প্রথম স্বাধীন ও মুক্ত হওয়ার ডাক দিয়েছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি প্রত্যয়ী ও বলিষ্ঠ লেখনীর মাধ্যমে মানুষকে মুক্তিসংগ্রামে অনুপ্রাণিত করেছেন, জাগ্রত করেছেন জাতীয়তাবোধ। তার কলম শাসকের অস্ত্রের চেয়ে বেশি শক্তিমান ছিল। তিনি ছিলেন মানবতার কবি। তিনি বিদ্রোহী, তিনি সংগ্রামী, তিনি প্রেমিক, আবার তিনিই শান্তির বার্তাবাহক। আজ ১১ জ্যৈষ্ঠ বাংলাদেশের জাতীয় এ কবির ১১৪তম জন্মবার্ষিকী। ১৩০৬ বঙ্গাব্দের এ দিনে (১৮৯৯ সালের ২৪ মে) তিনি কলকাতার বর্ধমান জেলার আসানসোলের চুরুলিয়া গ্রামে পরাধীন জাতির মুক্তির বাণী নিয়ে ধূমকেতুর মতো জন্মগ্রহণ করেন। তাই এ জাতির নিজেকে নতুন করে সৃষ্টি করার দিনও ১১ জ্যৈষ্ঠ।
শোষিত মানুষের মুক্তির প্রথম বার্তাবাহক কবি নজরুলের লেখা কবিতা, গান আমাদের স্বাধীনতা-সংগ্রামে অনুপ্রেরণা জুুগিয়েছে। তার লেখা ‘চল চল চল’ আমাদের রণসঙ্গীত। গান ও কবিতার মতো তার লেখা গল্প, নাটক, উপন্যাসও এ জাতির অনন্ত প্রেরণার উত্স হয়ে আছে। ‘মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই’—কবির এ গানের কথা স্মরণে রেখে মৃত্যুর (মৃত্যু : ১৩৮৩ সালের ১২ ভাদ্র) পর তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে সমাহিত করা হয়। আজ তার সেই অন্তিম শয্যা ছেয়ে যাবে অগণিত অনুরাগীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার ফুলে ফুলে।
জাতীয় কবির জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া জাতির উদ্দেশে আলাদা বাণী দিয়েছেন।
বাংলায় সর্বোচ্চসংখ্যক তিন সহস্রাধিক গানের স্রষ্টা কাজী নজরুল ইসলাম। নিজস্ব ধারার সঙ্গীত রচনা করেছেন তিনি। প্রকৃত অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্ভাসিত কবি মানুষের সংকীর্ণতা, দীনতা, মূঢ়তা, নীচতাকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করেছেন। তিনি পশ্চিমবঙ্গের চুরুলিয়া গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার ডাকনাম ছিল ‘দুখু মিয়া’। আসলে ‘দুখু মিয়া’ ছিলেন বাংলার দামাল ছেলের প্রতীক। কবির বাবার নাম কাজী ফকির আহমেদ ও মায়ের নাম ছিল জাহেদা খাতুন।
বরাবরের মতো এবারও বর্ণাঢ্য আয়োজনে সারা দেশে উদযাপন করা হবে জাতীয় কবির জন্মবার্ষিকী। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে দেশজুড়ে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন হচ্ছে। আজ শনিবার সকাল ১০টায় রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কবির জন্মবার্ষিকীর দু’দিনের জাতীয় অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করবেন। জাতীয় পর্যায়ে কবির জন্মবার্ষিকী পালনের লক্ষ্যে ঢাকা ছাড়াও চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহের ত্রিশাল ও কুমিল্লার দৌলতপুরে বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। ত্রিশালে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে তিন দিনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। নজরুলজয়ন্তী উপলক্ষে আজ সকাল সাড়ে ৬টায় কবির মাজারে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ফুল দেয়া হবে। বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেসরকারি বিভিন্ন চ্যানেল কবির জন্মদিন উপলক্ষে আজ বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করবে। জাতীয় দৈনিকগুলোতেও আজ এ উপলক্ষে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করা হবে। পাশাপাশি দিবসটি উপলক্ষে সরকারি উদ্যোগে আজ একটি স্মরণিকা প্রকাশ করা হবে।
জাতীয় পর্যায়ে নেয়া কর্মসূচির বাইরে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠন কবির জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে। দেশের সব জেলায় স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে শিল্পকলা একাডেমীর সহযোগিতায় বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে যথাযোগ্য মর্যাদায় নজরুলের ১১৪তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন করা হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জাতীয় কবির জন্মবার্ষিকী পালন উপলক্ষে আজ শোভাযাত্রা, কবির সমাধিতে ফুল দেয়া ও স্মরণসভার আয়োজন করবে। স্মরণসভায় সভাপতিত্ব করবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক।
নজরুলের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ছায়ানট গতকাল ও আজ শনিবার দু’দিনের নজরুল-উত্সবের আয়োজন করেছে। গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় শুরু হয় উত্সবের অনুষ্ঠান। উত্সবের প্রথম দিন নজরুল স্মারক বক্তৃতা দেন অধ্যাপক সনত্কুমার সাহা। দু’দিনের এ আয়োজনে সম্মেলন ও একক গান ছাড়াও থাকবে নৃত্য, পাঠ ও আবৃত্তি। উত্সবে অংশ নেবেন ঢাকাসহ দেশের নানা অঞ্চলের প্রবীণ, নবীন এবং প্রতিশ্রুতিমান শিল্পীরা।
বিদ্রোহী কবি নজরুলের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে চ্যানেল আই আজ আয়োজন করছে নজরুল মেলার। রাজধানীর তেজগাঁওয়ের চ্যানেল আই ভবনের খোলা চত্বরে আজ সকাল ১১টা ৫ মিনিটে একঝাঁক পায়রা উড়িয়ে মেলার উদ্বোধন করা হবে। মেলায় নজরুলকে নিয়ে স্মৃতিগ্রন্থ, নজরুলের হারিয়ে যাওয়া গানের স্টল, ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পের স্টল ছাড়াও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ২০টি স্টল থাকবে। দিনভর স্টলগুলোতে প্রদর্শন করা হবে নজরুল চিত্রকলা, নজরুল সঙ্গীতের রেকর্ড কাভারের প্রদর্শনী, নজরুলবিষয়ক ভিডিও সিডি ইত্যাদি। মেলার খোলা মঞ্চে প্রবীণ-নবীন শিল্পীরা নজরুল সঙ্গীত, নৃত্যনাট্য, শিশুনৃত্য ইত্যাদিতে অংশ নেবেন। গান গেয়ে শোনাবেন দেশের বিশিষ্ট নজরুলসঙ্গীত শিল্পীরা। নজরুলের ভাবসম্পদ থেকে ছবি আঁকবেন দেশবরেণ্য চিত্রশিল্পী ও শিশুশিল্পীরা। মেলা চলবে একটানা বিকাল ৪টা পর্যন্ত। এ বছর নজরুল মেলা উত্সর্গ করা হয়েছে প্রখ্যাত নজরুল সঙ্গীতশিল্পী ফিরোজা বেগমকে।