কৃষিতে প্রযুক্তির ব্যবহার

0
181
Print Friendly, PDF & Email

বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। এ দেশের অর্থনীতি কৃষিনির্ভর। দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য কৃষি উত্পাদনের ওপর বিশেষ জোর দেয়া প্রয়োজন। কিন্তু এখনও আমাদের কৃষি উন্নয়নের ক্ষেত্রে অনেক সমস্যা আছে। যেমন—প্রাচীন পদ্ধতির চাষাবাদ, ভূমি ব্যবস্থাপনা, উর্বরতা শক্তি হ্রাস, উন্নত বীজের অভাব, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদি। এক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগ করে অধিক লাভবান হওয়া সম্ভব। সাধারণত যে যে ক্ষেত্রে প্রযুক্তি প্রয়োগ করা যায় তার মধ্যে—

কৃষি ক্ষেত্রে কম্পিউটার
লোহা, দস্তা, তামা, সোডিয়াম, ভ্যানাডিরাম, কোবাল্ট ইত্যাদি থাকে। সব মাটিতে আবার সব উপাদান সমানভাবে থাকে না। অঞ্চল ভেদে অনুপাতের তারতম্য দেখা যায়। আবার সব ফসলের জন্য সব উপাদান সমান গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাই অঞ্চল ভেদে ফসল কম-বেশি হয়। একটা জমিতে যদি দীর্ঘদিন একই ফসল চাষ করা হয় তাহলেও মাটির পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি হয়। তাই মাটির অবস্থা না বুঝে ফসল বুনলে কখনোই সর্বোচ্চ ফলন আশা করা যায় না। এজন্য বীজ বোনার আগেই মাটির গুণগত মান পরীক্ষা করতে হয়। বর্তমানে মাটির গুণগত মান পরীক্ষার সব যন্ত্রপাতিই কম্পিউটারাইজড। বাংলাদেশেও এ কম্পিউটারাইজড পদ্ধতি প্রয়োগ করা যেতে পারে।

কৃষি বিমানের ব্যবহার
কৃষি ও বনায়ন কাজের উপযোগী বিশেষ এক ধরনের কম্পিউটারাইজড বিমান; যা উন্নত বিশ্বের জন্য অপরিহার্য। এর মাধ্যমে সাধারণত জমিতে ভেজা ও শুকনা কীটনাশক ছড়ানো, বীজ বোনা, সার দেয়া, ফসল শুকানো, বন পত্রশূন্য করা ইত্যাদি কাজ করা হয়। এসব কাজে বিমান ব্যবহারের অন্যতম কারণ হলো জমির যে কোনো অবস্থায় খুব অল্প সময়ে এটা বৃহত্ জমিতে ব্যাপক কাজ করতে পারে।

মাটির গুণাগুণ পরীক্ষা
মাটিতে বিভিন্ন ধরনের উপাদান যেমন—খনিজ লবণ, কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, ম্যাগনেসিয়াম ইত্যাদির ব্যবহার ও গুণাগুণ পরীক্ষা হতে পারে প্রযুক্তি প্রয়োগ করে।

আবহাওয়া
কৃষি কাজে আবহাওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনুকূল আবহাওয়া যেমন কৃষকের মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলে, তেমনি অতি বা অনাবৃষ্টি, ঝড়, কুয়াশা, বন্যা ইত্যাদি ফসলের ক্ষতি করে দুর্ভিক্ষ পর্যন্ত আনতে পারে। প্রাচীনকালে মানুষ গান-বাজনা, প্রার্থনা করে আবহাওয়া পরিবর্তনের চেষ্টা করত। কিন্তু এখন যুগ পাল্টেছে। স্যাটেলাইট এবং ভূমিতে অবস্থিত বিভিন্ন যন্ত্রপাতি থেকে প্রাপ্ত তথ্য সংগ্রহ করার পর সেগুলোকে কম্পিউটারে হিসাব-নিকাশের পর একটা অঞ্চলের আবহাওয়া সম্পর্কে আগাম ধারণা পাওয়া সম্ভব। এখন চাইলে কৃত্রিমভাবে বৃষ্টিপাত ঘটানোও সম্ভব। আর এসবই কৃষি ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে।

রোগবালাই দমন
ভালো বীজ থেকে ভালো ফসল পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। পাশাপাশি রোগাক্রান্ত বীজ অথবা অন্য কোনো উপায় থেকে আগত ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস বা জীবাণু সহজেই মাঠের ফসল নষ্ট করে দিতে পারে। জমির জন্য রোগবালাই দমন ব্যবস্থা খুব জরুরি। এজন্য ফসল বোনার আগে বীজ এবং ফসল বোনার পর ফসলের উপাত্ত পরীক্ষা করে কীটনাশক বা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে ফসলের উত্পাদন বৃদ্ধি করা হয়।

জিন গবেষণা
প্রতিটি উন্নত জীব কোষের নিউক্লিয়াসে ক্রোমোজোম থাকে। ক্রোমোজোমের এক একটি অংশকে জিন বলে। জিনের মধ্যে জীবের বৈশিষ্ট্য লুকিয়ে থাকে। জিন গবেষণা কৃষি জগতে এক ধরনের বিপ্লব এনে দিয়েছে। বিজ্ঞানীরা পরিবেশ, পরিস্থিতি এবং প্রয়োজন বুঝে একই প্রজাতির উদ্ভিদের মধ্যে বৈশিষ্ট্যের আদান-প্রদান করছেন। এতে অল্প জায়গাতে অধিক ফসলের পাশাপাশি প্রতিকূল পরিবেশেও ফসল ফলানো সম্ভব হচ্ছে।

ফার্ম পরিচালনা
বড় ফার্ম পরিচালনায় ঝুঁকি এবং লক্ষ্যের ক্ষেত্রে কৌশলী হতে হয়। অস্থিতিশীল বাজারদর এবং বারবার একই ফসল চাষ ফার্মের জন্য ক্ষতিকর। অনেক ফার্ম ম্যানেজার বেশি ঝুঁকি নিয়ে বেশি লাভ করতে চান। আবার অনেকে এর বিপরীতটা। তাই ফার্মের ম্যানেজমেন্ট মডেল খুব গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক সিদ্ধান্তের জন্য খরচ, উত্পাদন, কর্মী নির্বাচন, বিপণন, আবহাওয়া, ফসল বাছাই এগুলোর গাণিতিক সূক্ষ্ম হিসাব জানা খুব জরুরি। এজন্য উন্নত বিশ্বে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফার্মের প্যারামিটারগুলো হিসাবের জন্য সফটওয়্যার ব্যবহার করা হয়। ফলে ফার্ম পরিচালনা অনেক সহজ হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে কম্পিউটারাইজড সফটওয়্যার বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে। তবে আশার কথা যে, বাংলাদেশে এ ধরনের বিভিন্ন সফটওয়্যার ডেভেলপ করতে বিভিন্ন কোম্পানি উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে।

প্রযুক্তি বিনিময়
উন্নত বিশ্বে কৃষকদের মাঝে কম্পিউটারনির্ভর নেটওয়ার্ক তৈরি করা হয়। ভারতীয় সরকারও তাদের আন্তঃসংযোগ গতিশীল করার জন্য অপটিক্যাল ফাইবার, স্যাটকম নেটওয়ার্ক এবং ওয়্যারলেস প্রযুক্তির উন্নয়ন করছে। তৈরি করছে লোকাল, ন্যাশনাল এবং গ্লোবাল ইনফরমেট্রিক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার। এই সবকিছুর একটাই উদ্দেশ্য—তা হলো কীভাবে গবেষণা কেন্দ্র, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, এনজিও, কৃষক, ব্যবসায়ী এবং কৃষি সম্পর্কিত অন্য সবার মাঝে একটা আন্তঃসংযোগ সৃষ্টি করা যায়। যাতে এক স্থানের আবিষ্কৃত তথ্য খুব সহজেই অন্য জায়গার কৃষিতে ব্যবহার করা যায়। এজন্য ইন্টারনেটের পাশাপাশি মোবাইল ফোন, ল্যান্ড ফোন, ফ্যাক্স, সিডি, পত্রিকা, বুলেটিন, জার্নাল ইত্যাদির ব্যাপক ব্যবহার দরকার।

তথ্য কেন্দ্র
জ্ঞানই শক্তি এবং তথ্য হলো জ্ঞানের প্রাথমিক ভিত্তি উপাদান। আবহাওয়া, বীজ ও শস্যের বাজারদর, নতুন প্রযুক্তি ইত্যাদি না জেনে ফসল বুনলে কৃষকের ভাগ্যের পরিবর্তন হবে না। কৃষক বিজ্ঞানীসহ কৃষিকাজে যারা জড়িত তাদের সবার জন্য কৃষি শিক্ষা, কৃষি পণ্য, বাজার সম্পর্কে আধুনিক তথ্য জরুরি বিধায় একটা অঞ্চলে কৃষি তথ্য কেন্দ্রের প্রভাব রয়েছে। তথ্য কেন্দ্র যত আধুনিক হবে সে অঞ্চলের কৃষিজ্ঞান তত বৃদ্ধি পাবে। একটি আধুনিক তথ্য কেন্দ্রে বিজ্ঞানের সর্বাধুনিক ব্যবহার থাকতে হবে। উন্নত বিশ্বের তথ্য কেন্দ্রগুলোতে যেসব সুবিধা থাকে সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সিডিরম, ডাটাবেজ সার্চ সুবিধা, ইনডেক্স আকারে বিভিন্ন কৃষি বই, পত্রিকা, জার্নাল, অডিও-ভিডিও প্রোডাকশন, উচ্চগতির ইন্টারনেট সুবিধা, ফটোকপি, স্যাটেলাইট টিভি, টেলিফোন, ফ্যাক্স ইত্যাদি।

প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ
বাংলাদেশের ৮০ ভাগ লোক গ্রামে বাস করে। কৃষিই তাদের প্রধান জীবিকা। কৃষকরা চাষাবাদের মাধ্যমেই তাদের সংসার চালান। কিন্তু দুঃখের কথা হলেও সত্য, এখনও এ দেশের কৃষক সম্প্রদায় সেই চিরাচরিত প্রাচীন পদ্ধতিতেই কৃষিকাজ করে চলছেন এবং তাদের জীবনযাত্রা এখনও খুব নিম্নমানের। যদিও বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, ধান, পাট, বন, আণবিক কৃষি, ইক্ষু, চা ও মাটি উন্নয়ন ইনস্টিটিউট—এই ৮টি ইনস্টিটিউটসহ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ একাডেমি ফর রুরাল ডেভেলপমেন্ট ও রুরাল ডেভেলপমেন্ট একাডেমি—এই ৬টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কৃষির ওপর অনেক গবেষণা হয়। এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে সাধারণের জন্য যেসব সার্ভিস দেয়া হয় সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : দেশি-বিদেশি সংস্থার বুলেটিন, সিডিরম, ডাটাবেজ সার্চ সুবিধা, অডিও-ভিসুয়াল মিডিয়া প্রোডাকশন ও রিপ্রোডাকশন, মাইক্রো ফিল্ম প্রোডাকশন, নিউজলেটার, বই, রিপোর্ট, সেমিনার, ওয়ার্কশপ ইত্যাদি।
কিন্তু এখনও এগুলোর প্রভাব আমাদের কৃষিতে ততটা ব্যাপক নয়।
যার অন্যতম কারণগুলো হলো : ১. কম্পিউটার ও প্রযুক্তি শিক্ষার অভাব, ২. পর্যাপ্ত প্রশিক্ষক, যন্ত্রপাতি এবং সংগঠনের অভাব, ৩. ইন্টারনেট ব্যবহারের সীমাবদ্ধতা, ৪. তথ্য কেন্দ্রের অভাব, ৫. ভাষাগত সমস্যা। কারণ অধিকাংশ তথ্যই থাকে ইংরেজিতে, যা সাধারণভাবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জটিল।
এজন্য আমাদের যেসব বিষয়ে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে সেগুলো হলো—
১. কৃষকদের কম্পিউটারের সাধারণ ব্যবহার বিষয়ে পর্যাপ্ত ও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
২. দেশীয় ও আন্তর্জাতিক কৃষকদের মধ্যে প্রযুক্তি বিনিময়ের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।
৩. গ্রামে গ্রামে কৃষি তথ্য কেন্দ্র স্থাপন করা।
৪. মাল্টিমিডিয়া ব্যবহার করে জটিল তথ্য সহজ করে কৃষকের মাঝে উপস্থাপন করা।
৫. কৃষকের ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্য স্থানীয়, এনজিও, এবং সরকারি পর্যায়ে উদ্যোগ নিতে হবে। যত তাড়াতাড়ি কৃষি ব্যবস্থায় কম্পিউটার ও প্রযুক্তিকে সম্পৃক্ত করা যাবে, তত তাড়াতাড়ি আমাদের কৃষি উন্নত হবে। এজন্য সবাইকেই সচেতন থাকাসহ প্রযুক্তিতে অগ্রগতিসম্পন্ন হতে হবে। তবেই আমরা উন্নত বিশ্বের দাবিদারই শুধু হওয়া নয়—কৃষি ক্ষেত্রে কম্পিউটারনির্ভর প্রযুক্তি প্রয়োগ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারব। এর মাধ্যমেই আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনসহ সার্বিক উন্নতি লাভ করতে পারব।

শেয়ার করুন