ড. বদিউল আলম মজুমদার :সম্পাদক সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন
কারও জ্বর হলে প্রাথমিকভাবে পার্যাসিটামল দেওয়া হয়৷ কখনও চিকিত্সক এ বিধান দেন, আবার রোগী নিজেও এ জাতীয় ওষুধ খেয়ে নেন৷ কিন্তু জ্বর যদি কয়েক দিন ধরে চলে তাহলে নানা ধরনের পরীক্ষা করে এর কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হয়৷ এভাবে জানা যায় যে, রোগীর ভেতরে টাইফয়েড কিংবা ম্যালেরিয়ার জীবাণু রয়েছে কিনা৷ কিংবা শরীরের উষ্ণতা অন্য কোনো রোগের প্রকাশও ঘটাতে পারে৷
বাংলাদেশে এখন আমরা অনেক উপসর্গ দেখি৷ এখন আর টোটকা দাওয়াই দিয়ে কাজ হবে না৷ সমস্যাগুলোর মধ্যে দুটি প্রধান৷ এক. একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্তদের বিচারকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট নানা ধরনের কর্মকা-৷ পক্ষে ও বিপক্ষে মিছিল-সমাবেশ, হরতাল, ভাংচুরথ সবই রয়েছে৷ দুই. পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন কীভাবে অনুষ্ঠিত হবে৷ এখন যা কিছু আমরা ঘটতে দেখছি, তার বেশিরভাগ এ দুটি ইসু্যর সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে সম্পৃক্ত৷
প্রথমটি অর্থাত্ একাত্তরে হত্যা-ধর্ষণ-লুটপাটের অভিযোগে বিচারের জন্য বর্তমান মহাজোট সরকার উদ্যোগী হয়েছে৷ এ জন্য গণরায়ও তাদের রয়েছে৷ ৫ ফেব্রুয়ারি একটি ট্রাইবু্যনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দ্বিতীয় রায় প্রদান করা হয়৷ এতে আবদুল কাদের মোলস্নার যাবজ্জীবন কারাদ- প্রদান করা হলে তরুণ সমাজের একটি অংশ (তাদের কেউ কেউ বস্নগার হিসেবে পরিচিত) মনে করে যে, সরকারের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর হয়তো অাঁতাত হয়েছে৷ যে কারণে সর্বোচ্চ সাজার পরিবর্তে অপেক্ষাকৃত লঘুদ- অর্থাত্ যাবজ্জীবন কারাদ- প্রদান করা হয়েছে৷ এভাবেই শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের সৃষ্টি৷
আবার এই গণজাগরণ মঞ্চের প্রতিক্রিয়াতেই আমরা দেখি হেফাজতে ইসলাম নামে একটি জোটের উত্থান৷ তারা এক সময়ে ১৩ দফা দাবি তুলে ধরে এবং আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজকে প্রচ- ধাক্কা দিতে সক্ষম হয়৷
এখন কেউ কেউ বলছেন, মহাজোট সরকার যদি সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল না করত, তাহলে যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে একটি মহল এভাবে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারত না৷ বিএনপির মতো একটি বড় দলের \’জামায়াতিকরণও\’ হতো না৷ নির্বাচনী সমীকরণ বিবেচনায় রেখে তারা একাত্তরের ভূমিকার কারণে বিভিন্ন মহলে সমালোচিত দলটির সঙ্গে হয়তো নামকা ওয়াস্তে সম্পর্ক রাখত, কিন্তু রাজপথের জন্য এভাবে নির্ভরশীলতা তৈরি হতো না৷
তবে অস্থির পরিস্থিতির কারণে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার কাজ যেন কোনোভাবেই বিঘি্নত না হয়, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে৷ আর যত দ্রম্নত এ কাজ শেষ হয়, ততই মঙ্গল৷ এ বিচার অনুষ্ঠান দেশবাসীর দীর্ঘ চার দশকের প্রত্যাশার যৌক্তিক পরিণতি৷
একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে যে, বর্তমানে অস্থিরতার প্রধান ইসু্য কিন্তু পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠান৷ এ নির্বাচন হতে হবে যথাসময়ে এবং সব দলের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে৷ এমন কোনো নির্বাচন হলে চলবে না, যা দেশ-বিদেশে গ্রহণযোগ্য হবে না৷ আমাদের দুর্ভাগ্য যে, নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদলের ব্যবস্থা এ দেশে দুই যুগ ধরে চালু থাকলেও পাঁচ বছর পরপরই আমাদের এক ধরনের অস্থির সময় অতিক্রম করতে হয়৷ তবে এর শুরুটা হয় নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সরকার গঠনের পরপরই৷ পরাজিত পক্ষ নতুন সরকারকে কেবল অসহযোগিতা করেই ক্ষান্ত থাকে না, অস্থির পরিস্থিতিরও চেষ্টা চালায় বলে ক্ষমতাসীনরা অভিযোগ করে৷ নির্বাচন যত এগিয়ে আসে, ততই রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত হতে তাকে৷ আগামীতেও যে এ অবস্থা হবে নাথ সে নিশ্চয়তা নেই৷ বরং কেউ কেউ পরবর্তী সরকারের জন্য দেশ পরিচালনা আরও কঠিন হবে বলে ধারণা করছেন৷
এ অবস্থায় করণীয়গুলো চিহ্নিত জরুরি, যাতে দেশে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং আর্থ-সামাজিক ইসু্যগুলো মোকাবেলায় সরকার মনোযাগী হতে পারে৷ এজন্য জরুরি হচ্ছে আলোচনা এবং তাতে অবশ্যই প্রধান দুটি দলকে থাকতে হবে৷ বৃহত্তর পরিসরেও আলোচনা হতে হবে৷ আমি এ ক্ষেত্রে ১৯৯০ সালে \’তিন জোটের রূপরেখা\’র মতো একটি সমঝোতা গড়ে তোলার ওপর জোর দিতে চাই৷ এ উদ্যোগে জামায়াতে ইসলামী বাদে প্রধান ও অপ্রধান সব দল এবং ব্যবসায়ী ও নাগরিক সমাজকে যুক্ত করতে হবে৷
তিন জোটের রূপরেখার মতো একটি যুক্ত ঘোষণায় যেসব বিষয় থাকবে, সেগুলো হচ্ছেথ ক. নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা ও নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা ও কর্মকা-; খ. নির্বাচনী আইনের সংস্কার এবং গ. নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দল ও প্রার্থীদের যেসব বিষয়ে তথ্য প্রদান করতে হবে তার বিস্তারিত বিবরণ৷
পরবর্তী প্রসঙ্গ হচ্ছে নির্বাচনের সময় করণীয়৷ এতে যেসব বিষয় থাকবে :ক. প্রার্থী ও দলের আচরণবিধি৷ ১৯৯১ সালের নির্বাচনের সময় এ ধরনের আচরণবিধি তৈরি হয়েছিল৷ তবে সর্বক্ষেত্রে তা যথাযথ অনুসরণ করা হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে; খ. টাকার খেলা ও সন্ত্রাস বন্ধ করা; গ. প্রশাসনকে প্রভাবিত না করা কিংবা প্রশাসনের তরফেও কোনো দল বা প্রার্থীর প্রতি পক্ষপাত না করা; ঘ. দুর্নীতিবাজ, কালো টাকার মালিক এবং সন্ত্রাসীদের কোনো দল প্রার্থী করবে নাথ এ ধরনের অঙ্গীকার প্রদান৷
রূপরেখায় তৃতীয় যে বিষয় থাকতে হবেথ নতুন সরকারের করণীয়৷ এর মধ্যে অপরিহার্য বিষয় হবে জাতীয় সংসদকে কার্যকর করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ৷ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের বিষয়েও সব দলকে অঙ্গীকার করতে হবে৷ রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে সংস্কারও জরুরি হয়ে পড়েছে৷ আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করা৷ নির্বাচিত এসব প্রতিষ্ঠানকে অবশ্যই স্থানীয় এমপির প্রভাব থেকে মুক্ত করতে হবে৷ রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভাগাভাগির বিষয়টিও আলোচনার দাবি রাখে৷ রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতিও বিবেচনা করার সময় হয়েছে৷ এজন্য সংবিধান সংশোধন করতে হবে৷ আর সেটা হতে হবে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে৷ প্রধানমন্ত্রী কত মেয়াদ পর্যন্ত দায়িত্বে থাকবেন, সে বিষয়েও প্রস্তাব সামনে আসছে এবং সেটা নিয়েও আলোচনা দরকার৷ দুর্নীতি দমন কমিশন এবং বিভিন্ন সাংবিধানিক কমিশন যাতে কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করতে পারে, সে জন্যও নির্বাচনের আগেই ঐকমত্য হওয়া দরকার৷ দুর্নীতি দমন কমিশনকে কার্যকর করার বিকল্প নেই৷ এ প্রতিষ্ঠানকে অবশ্যই সরকারের প্রভাবমুক্ত করতে হবে৷
আশা করব যে, আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দেবেন এবং অশেষ সম্ভানার দেশ হিসেবে বিশ্বসমাজের কাছে চিহ্নিত দেশটিতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য সাধ্যমতো সবকিছু করবেন৷