সম্প্রতি জনপ্রিয় একটি দৈনিককে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইনমুহম্মদ এরশাদ ও সাবেক সেনাপ্রধান মোহাম্মদ নুরুদ্দীন খান। `৯০-এরগণঅভ্যুত্থানের সময় নুরুদ্দীন ছিলেন সেনাপ্রধান। তাদের জবানিতে সেই সময়কারবিভিন্ন বিষয় উঠে এসেছে।
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ
“সেতারিখটা আমার সঠিক মনে নেই। আমার কারামুক্তির পরের ঘটনা। কারাগারে বসেইসংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলাম। তাই মুক্তিলাভের পর পরই সংসদে যাওয়া শুরুকরেছি। নিয়মিত যাচ্ছিলাম।
এর আগের মেয়াদে একবারও সংসদে যেতে পারিনি।যেতে দেওয়া হয়নি। সংসদীয় আচরণের ইতিহাসে যা ছিল একটি কালো অধ্যায়ের শামিল।মুক্তিলাভের পর এক বাজেট অধিবেশনে বাজেট আলোচনায় অংশ নেওয়ার জন্য লবিতেবসে বক্তব্যের পয়েন্টগুলো দেখছিলাম।
সেই দিনটার কথাই মনে পড়েছে। মনেপড়ল ২০১৩ সালের ৯ মে বাংলাদেশ প্রতিদিন-এ জেনারেল (অব.) নুরুদ্দীন খানেরকিছু বক্তব্য পাঠ করে। তিনি কী বলবেন বা বলেছেন তা জানা বা শোনার ইচ্ছাআমার একেবারেই নেই।
তবে সেনাবাহিনী প্রসঙ্গে কিছু বিষয় উল্লেখিত হয়েছে বলে সেখানে কিছু অসত্য ও বিকৃত বিবৃতি সন্নিবেশিত হওয়ায় পেছনের কথা মনে পড়ল।
আমিযখন লবির সোফায় বসে বক্তৃতার পয়েন্ট দেখছিলাম, তখন কানে এলো, কে যেন আমাকেসালাম জানালেন। আমি মুখ তুলে তাকাতেই দেখি আমার সামনে ক্রাচে ভর করেদাঁড়িয়ে আছেন জেনারেল নুরুদ্দীন।
সালামটা ছিল তারই। কালক্ষেপণ নাকরেই বললাম- `বেইমানের সালাম আমি গ্রহণ করি না`। একজন মুসলমান হিসেবেআরেকজন মুসলমানের সালাম গ্রহণ করা অবশ্যই কর্তব্য। কিন্তু মুসলমান মাত্রেইতার মধ্যে ইমান থাকবে।
যার মধ্যে ইমান থাকবে না তার সালাম গ্রহণ নাকরলে দোষের কিছু হবে না বলে মনে করেছি। জেনারেল নুরুদ্দীন আমারনিয়োগপ্রাপ্ত সেনাপ্রধান হিসেবে আমার সঙ্গে বেইমানি করেছিলেন।
বেইমানি করতে চেয়েছিলেন এ দেশের গণতন্ত্রের সঙ্গে, যা আমি তাকে করতে দেওয়ারসুযোগ দিইনি। আমার সঙ্গে তার বেইমানিতে আমি কী ফল ভোগ করেছি তা নিয়ে আমারকোনো কষ্টবোধ নেই। কিন্তু সেই কারণে ধারাবাহিকভাবে দেশের বুকে কী পরিণতিনেমে এসেছে, তার জন্য দুঃখ অনুভব করি।
সেই সময়ে অনাগত ভবিষ্যতেরদিকে তাকিয়েও অশনিসংকেতের আশঙ্কা করেছিলাম। তাই জেনারেল নুরুদ্দীনকেকোনোভাবেই ক্ষমার চোখে দেখতে পারছিলাম না।
কিন্তু যখন শুনেছিনুরুদ্দীন সড়ক দুর্ঘটনায় মারাত্মকভাবে আহত হয়েছেন, তার অবস্থা সংকটাপন্ন, তখন আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছিলাম- `আল্লাহ তুমি তাকে বাঁচিয়ে রাখ`।তাকে অন্তত একটা যন্ত্রণা নিয়ে বাঁচতে দাও, যাতে সে প্রতি মুহূর্তে অনুভবকরতে পারে যে এটাই এরশাদ সাহেবের সঙ্গে তার বেইমানির প্রায়শ্চিত্ত।
সেদিনক্রাচে ভর করা নুরুদ্দীনকে দেখে আমার সেই প্রার্থনার কথাই মনে পড়েছিল। পরেআবার এটাও বলেছি- আল্লাহ নুরুদ্দীনকে ক্ষমা করে দাও। তাকে অন্তত অনুশোচনাকরার সুযোগ দাও। কিন্তু বাংলাদেশ প্রতিদিন-কে দেওয়া তার অসত্য বয়ান আমাকেআবারও আহত করেছে।
প্রকাশিত বক্তব্য অনুসারে তিনি বলেছেন- `রক্তপাতচাইনি বলে নব্বইতে সেনাবাহিনী একটি বুলেটও খরচ করেনি`। এ বক্তব্যের মধ্যেতার `চাইনি` শব্দটি অসত্য। সেনাপ্রধান হিসেবে তিনি তার ইচ্ছামতসেনাবাহিনীকে ব্যবহার করতে পারেন না।
এটা রাষ্ট্রপ্রধানেরইচ্ছা-অনিচ্ছার বিষয়। সেদিন আমি কোনো রক্তপাত চাইনি বলেই সেনাবাহিনীকেব্যবহার করতে যাইনি। আমি সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করেছি শান্তি ও জনগণের সেবারকাজে। দুর্যোগ-দুর্বিপাকে সেনাবাহিনীকে আমি কাজে লাগিয়েছিলাম।
রক্তঝরানোর কাজে সেনাবাহিনী ব্যবহৃত হয়নি এবং সে কাজে ব্যবহার করার কোনো ধরনেরইচ্ছা আমার ছিল না। অথচ জেনারেল নুরুদ্দীন যে প্রস্তাব নিয়ে আমার কাছেএসেছিলেন তাতে দেশে শুধু রক্তই ঝরত না, গণতন্ত্রের যাত্রাপথও রুদ্ধ হয়েযেত।
কারণ জেনারেল নুরুদ্দীন আমার কাছে এসেছিলেন সামরিক আইন জারিরপ্রস্তাব নিয়ে। তিনি চেয়েছিলেন, সামরিক আইন জারি করে ক্ষমতা দখল করতে। আমিতার প্রস্তাবে সম্মত হলে, তখন যে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হতো তা দমনের জন্য দেশেরক্তের বন্যা বয়ে যেত।
গণতন্ত্রের যাত্রা আবার ব্যাহত হতো। তারমনোভাব বুঝতে পেরেই আমি সেদিন স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তনিয়েছিলাম। ওই সময়ে আমি ইচ্ছা করলে সেনাপ্রধানকে বরখাস্তও করতে পারতাম।কিন্তু আমি তা করতে চাইনি।
যেখানে ক্ষমতায় থাকার কোনো ইচ্ছাই আমারছিল না, সেখানে সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করে তাদের ভূমিকাকে আমি কোনোভাবেইবিতর্কিত করতে চাইনি। সুতরাং জেনারেল নুরুদ্দীনের চাওয়া-না চাওয়ায় কিছু যায়আসে না।
জেনারেল নুরুদ্দীনের আরেকটি মন্তব্যের প্রতিও আমার দৃষ্টিআকৃষ্ট হয়েছে। `৯১ সালে নাকি দেশে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য `৯০-এর ৬ ডিসেম্বরআমি ক্ষমতা ছেড়ে দিয়েছিলাম।
কিন্তু আমার সে আকাঙ্ক্ষা নিরাশারঅন্ধকারে হারিয়ে গেছে। ওই সময় দেশে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করা ছিলদুঃসাধ্য। তখন বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর দাবি ছিল আমাকে পদত্যাগ করতে হবে।কিন্তু কার কাছে, কীভাবে, কোন পদ্ধতিতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে; তার কোনোদিকনির্দেশনা ছিল না।
সে অবস্থায় তিন জোটের মনোনীত ব্যক্তি সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে আমি ভাইস প্রেসিডেন্ট নিয়োগকরেছিলাম। তার জন্য আমার দলের ভাইস প্রেসিডেন্ট ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদকেপ্রথমে পদত্যাগ করতে হয়েছে এবং সেখানে বিচারপতি সাহাবুদ্দীনকে নিয়োগ করেতার কাছে আমি পদত্যাগপত্র পেশ করি। পুরো প্রক্রিয়াটি ছিল সাংবিধানিক পন্থারমধ্যে।
অতঃপর বিচারপতি সাহাবুদ্দীন হলেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি। তিনিচেয়েছিলেন বলে তখন নির্বাচনের সময় সেনাবাহিনীকে কাজে লাগানো হয়েছে। সেখানেওসেনাপ্রধান হিসেবে জেনারেল নুরুদ্দীনের কোনো দায়দায়িত্ব ছিল না।
সেদিনওসেনাবাহিনী শুধু শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য দায়িত্ব পালন করেছিল। কিন্তুনির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব ছিল সেই সময়কার অস্থায়ী সরকারের হাতে। যাকে বলাহয় প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এ সরকারের অধীনে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছেতাকে আমি কোনোভাবেই অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হিসেবে অভিষিক্তকরতে পারব না।
কারণ ওই সরকার তিন জোটের জন্য নিরপেক্ষ থাকলেও থাকতেপারে, তবে সদ্য ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়া আমার জাতীয় পার্টির জন্য কোনোভাবেইনিরপেক্ষ ছিল না।
এমনকি নির্বাচনের পর তিন জোটের মধ্যে একটি জোটেরপক্ষ থেকেও বলা হয়েছে যে নির্বাচনে সূক্ষ্ম কারচুপি হয়েছে। তার আগেনির্বাচনের সময় জাতীয় পার্টির প্রতি ওই সরকার শুধু বৈরী আচরণই করেনি, জাতীয়পার্টি যাতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না পারে তার জন্য আমাকে কারারুদ্ধকরেছে।
আমার দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা আর হুলিয়া জারিকরেছে। আমার দলের অধিকাংশ প্রার্থী নির্বাচনী এলাকায় থেকে প্রচারেওঅংশগ্রহণ করতে পারেননি। আমি জেলে থেকে নির্বাচন করেছি, দলের সব নেতামামলা-হুলিয়া মাথায় নিয়ে পলাতক কিংবা আত্মগোপনে থেকে নির্বাচন করেছেন।
তিনজোটের রূপরেখায় এটা ছিল না যে জাতীয় পার্টিকে নির্বাচন করতে দেওয়া হবে না।তাদের চ্যালেঞ্জ ছিল আমি যেন ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে এসে নির্বাচনে অংশগ্রহণকরি। আমি সে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছিলাম। তৎকালীন অন্তর্বর্তী সরকারেরদায়িত্ব ছিল না আমাকে কারারুদ্ধ রেখে নির্বাচন করতে হবে।
ফলে ওইনির্বাচন কোনোভাবেই নিরপেক্ষ ছিল না। কিন্তু তার পরও ওই নির্বাচনে আমার দলশত প্রতিকূলতার মধ্যেও ৩৫টি আসনে বিজয়ী হয়েছিল। আমি কারাগারে থেকে কোনোধরনের প্রচার ছাড়াই পাঁচটি আসনে বিজয়ী হয়েছিলাম। নির্বাচনে ৩৫টি আসনে বিজয়ীহওয়া ছাড়াও আরও প্রায় ৪০টির মতো আসনে জাতীয় পার্টি বিজয়ের পথে ছিল।
কিন্তুসেই ফল পাল্টে দেওয়া হয়েছে। কারণ তা না হলে আবার সরকার গঠনে জাতীয় পার্টিরআর কোনো বিকল্প থাকবে না। ওই নির্বাচনের পর একটি দল বলেছে, সূক্ষ্মকারচুপি হয়েছে আর আমি বলব সূক্ষ্ম নয়, স্থূল কারচুপি হয়েছিল `৯১-এরনির্বাচনে।
ফলে যে পাপ দিয়ে `৯১-এর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল তারপ্রায়শ্চিত্ত এখনো করে যেতে হচ্ছে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের ইতিহাস যদিপর্যালোচনা করা হয় তাহলে একমাত্র আমিই উচ্চকণ্ঠে বলতে পারব- রক্তপাতহীনরাজনীতির ধারা জাতীয় পার্টির আমলেই প্রবর্তিত হয়েছিল।
আমার সময়েসরকারবিরোধী আন্দোলনে যে কটি প্রাণ আমরা হারিয়েছিলাম তার পেছনে ষড়যন্ত্রেরভূমিকাই ছিল মুখ্য। তবুও সে হারানো প্রাণের জন্য আমার মধ্যে ছিল বুকফাটাহাহাকার। যারা আমার সময়ে মারা গিয়েছিল, তাদের আত্মীয়স্বজনের কাছে যাওয়ারসৎসাহস আমার ছিল।
কিন্তু এখন কী ঘটছে, এর কি কোনো নজির খুঁজে পাওয়াযাবে! আমার সময়কার ঘটনার সঙ্গে অন্য যে কোনো সরকারের সময়ের তুলনা হবেঅসামঞ্জস্য তুলনা। সমুদ্রের সঙ্গে একটি কুয়ার তুলনার মতো। এক অনিবার্যপ্রয়োজনে আমাকে দেশের শাসনভার গ্রহণ করতে হয়েছিল।
দেশ ও জাতির জন্যপ্রয়োজন ছিল বলেই আমার ক্ষমতা গ্রহণ ছিল রক্তপাতহীন পন্থায় এবং ক্ষমতাহস্তান্তরও হয়েছে শান্তিপূর্ণ ও সাংবিধানিক ধারায়। অতঃপর `৯১ থেকে এই ২০১৩সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে দুটি দল চার মেয়াদে দেশ পরিচালনা করছে।
অবশ্যতারা নির্বাচনের মাধ্যমেই ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু প্রত্যেকবারই রক্তেরাঙানো পথে হেঁটে তাদের ক্ষমতায় আসতে হয়েছে আর রক্তের বিছানা পেতে রেখেইবিদায় নিতে হয়েছে। এটাই ভাগ্যের নির্মম পরিহাস।
যে প্রসঙ্গ নিয়ে এইস্বল্প আলোচনার অবতারণা করেছি সেখানে আমার কোনো কথা ছিল না। তবে আমার সময়েরকথা ছিল বলে এ বক্তব্যটুকু উপস্থাপন করলাম। সেখানে সেনাবাহিনীর কথা আছে।এখানে আছে আমার বিশেষ দুর্বলতা।
সেনাবাহিনী যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীনকরেছে। এই সেনাবাহিনী জীবন বাজি রেখে দেশের অখণ্ডতা রক্ষা করেছে।সেনাবাহিনী না থাকলে আমরা হয়তো পার্বত্য চট্টগ্রাম রক্ষা করতে পারতাম না।সেই সেনাবাহিনী নিয়ে কোনো বিতর্কিত কথা আমি মানতে পারি না।
সেনাবাহিনীদেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক কারণে বুলেট খরচ করবে কেন। কারও চাওয়া-না চাওয়ারওপর কোনো রক্তপাতের সঙ্গে সেনাবাহিনীর সংশ্লিষ্টতার প্রশ্নটাই তোঅবান্তর।”
সাবেক সেনাপ্রধারন মোহাম্মদ নুরুদ্দীন খান
বাংলাদেশসেনাবাহিনীর সাবেক প্রধান লে. জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ নুরুদ্দীন খানবলেছেন, রক্তপাত চাইনি বলে নব্বইয়ের সরকার পরিবর্তনের সময় সামরিক বাহিনীএকটি বুলেটও খরচ করেনি। ঢাকায় তখন ১০ হাজারের বেশি সেনাসদস্য মোতায়েন ছিল।কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষমতার স্বার্থে জনগণের প্রতিপক্ষ হিসেবে সেনাবাহিনীরঅস্ত্র ব্যবহৃত হয়নি। কারণ এদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও জনগণেরনিরাপত্তা রক্ষার স্বার্থেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনী গঠিত হয়েছে। সাবেক এইসেনাপ্রধান ও ছিয়ানব্বইয়ের আওয়ামী লীগ সরকারের জ্বালানিমন্ত্রী নুরুদ্দীনখান এসব কথা বলেন। অক্টোবর `৯০ থেকে সেপ্টেম্বর `৯৪ সাল পর্যন্তসেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী এ জেনারেল বলেন, সেনাবাহিনী এদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব তথা রাষ্ট্র ও জনগণের নিরাপত্তা বিধানেঅঙ্গীকারবদ্ধ। তাই `৯০ সালে রাজনৈতিক ক্ষমতার পটপরিবর্তনের সময় রাজনীতি বাক্ষমতার স্বার্থে জনগণের প্রতিপক্ষ হিসেবে সেনাবাহিনী দাঁড়ায়নি। জনগণেরবিরুদ্ধে তাদের অস্ত্র ব্যবহৃত হয়নি। ঢাকায় তখন ১০ হাজারের বেশি সেনাসদস্যমোতায়েন ছিল। কোনো রক্তপাত চাইনি বলে নব্বইয়ের সরকার পরিবর্তনের সময় সামরিকবাহিনীর সদস্যরা একটি বুলেটও খরচ করেনি। শুধু তাই নয়, ১৯৯০-৯১ সালেসেনাবাহিনীর নিরপেক্ষ ভূমিকার কারণে বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনেরএকটি দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তিনি বলেন, দেশে গণতন্ত্রায়নের ধারাফিরিয়ে আনতে সে দিন আমরা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছি। আমরা রাজনৈতিক ওপ্রশাসনিক প্রভাবমুক্ত থেকে শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন পরিচালনা ও জনগণেরভোটাধিকার প্রতিষ্ঠায় নির্বাচন কমিশনকে সর্বোতভাবে সহযোগিতা করেছিলাম। ফলেশান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে রাজনৈতিক ক্ষমতার পটপরিবর্তনসম্ভব হয়েছিল। সে দিন গণতন্ত্রায়নের ধারায় দেশকে ফিরিয়ে আনতে সামান্য যেভূমিকাটুকু রাখতে পেরেছিলাম সে জন্য আজও নিজেকে ধন্য মনে করি। সে দিনআমাদের নিরপেক্ষ ও দূরদর্শী ভূমিকার কারণে দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র চর্চারধারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে- এটা জাতি মনে রেখেছে কিনা জানি না। তবে এটাইঐতিহাসিক সত্য। সেটা অর্জন সম্ভব হয়েছিল রাজনীতিবিদ, সামরিক-বেসামরিক আমলা, আইনবিদ, সাংবাদিক, পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী ও বিচার বিভাগের দায়িত্বশীলভূমিকার জন্য। আজকের প্রেক্ষাপটেও সবার দায়িত্বশীল ভূমিকা প্রয়োজন।
দেশকেগণতন্ত্রায়নের পথে এগিয়ে নেওয়ার এ নেপথ্য নায়ক বলেন, নব্বইয়ের অভিজ্ঞতায়দেখেছি, অবাধ নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পূর্বশর্ত হচ্ছে, নির্বাচনকালীনসরকার ও নির্বাচন কমিশনের প্রতি সব রাজনৈতিক দলের আস্থা প্রতিষ্ঠা।নির্বাচন কমিশনের প্রতি যদি কারও কোনো অনাস্থা থাকে সেক্ষেত্রে যেভাবেআস্থা প্রতিষ্ঠা করা যায় তা করতে হবে। প্রশাসনকে দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে জনগণেরআর্থসামাজিক উন্নয়ন, রাষ্ট্র ও জনগণের নিরাপত্তার বিষয়টি প্রাধান্য দিয়েবিবেচনা করতে হবে। নব্বইয়ের প্রেক্ষাপটে এসব যেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল, আজওসমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সে দিনের মতো আজও আলোচনার মাধ্যমে যে কোনো সংকটসমাধান সম্ভব বলে আমি মনে করি। তাই রাজনীতিবিদদের ব্লেম গেম সম্পর্কে সচেতনথেকে জাতীয় স্বার্থে কাজ করতে হবে। সবার আগে দেশ ও জনগণের স্বার্থকেপ্রাধান্য দিয়ে কীভাবে রাষ্ট্র ও জনগণকে নিরাপদ রাখা যায় সবাইকে সে চিন্তাকরতে হবে।
স্বল্পকালের জন্য রাজনীতিতে এসে পরবর্তীতে স্বেচ্ছায়রাজনীতি থেকে অবসর নেওয়া নুরুদ্দীন খান বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতির প্রধানসমস্যা হলো এখনকার রাজনীতিতে রাজনীতিটাই নেই। আমরা যে রাজনীতি দেখে বড়হয়েছি, সেখানে অর্থবিত্তের জন্য রাজনীতিবিদরা রাজনীতি করতেন না। রাজনীতিহতো জনকল্যাণের জন্য। এ জন্য রাজনীতিবিদদের মধ্যে অদৃশ্য প্রতিযোগিতা থাকত।এমনকি রাজনীতিতে তখন প্রতিহিংসা প্রশ্রয় পেত না। সামাজিক বিচার-আচারেপ্রতিপক্ষের কেউ অভিযুক্ত হলে রাজনীতির স্বার্থেই সে সামাজিক ন্যায়বিচারপেত। প্রতিপক্ষ নির্মূলের জন্য বা কাউকে ঘায়েল করার চিন্তা কারও থাকলে তারাসেই বিচার নিয়ে রাজনীতিবিদদের কাছে আসত না, গ্রামের মোড়লদের কাছে যেত।সেখানে ন্যায়বিচার না পেলেই মানুষ রাজনীতিবিদদের কাছে ছুটে আসত। এখন সবকিছুহয়ে গেছে উল্টো।
নরসিংদী জেলার মনোহরদী উপজেলার কাটাবাড়ি গ্রামেরঐতিহ্যবাহী মুসলিম পরিবারের সন্তান সাবেক জ্বালানিমন্ত্রী জেনারেলনুরুদ্দীন খান বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সহিংসতা, গার্মেন্ট শিল্পেরদুর্ঘটনা ও জনগণের ভবিষ্যৎ প্রসঙ্গে বলেন, আমরা যদি আমাদের দেশটাকেআন্তরিকভাবে ভালোবাসি তাহলে অটোমেটিক্যালি আমাদের অনেক সমস্যার সমাধান হয়েযাওয়ার কথা স্বতঃপ্রণোদিতভাবে। কিন্তু আমরা অনেকেই দেশের চেয়ে নিজেকেভালোবাসি অনেকে বেশি। নিজেকে, নিজের স্বার্থকে, দলের স্বার্থকে প্রাধান্যদিতে গেয়ে অনেক ক্ষেত্রে দেশের স্বার্থটা পেছনে পড়ে যাচ্ছে। তাতেই সমস্যারসমাধান না হয়ে গভীর সংকটের সৃষ্টি করছে। এ বিষয়ে রাজনীতিবিদকেই দায়িত্বনিতে হবে। সাবেক এই সংসদ সদস্য বলেন, স্বল্পকালীন রাজনৈতিক জীবনেরঅভিজ্ঞতায় দেখেছি, এখন রাজনীতির নাম করে অনেকেই রাতারাতি অর্থবিত্তের মালিকহতে চান। তাদের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য-চাকরিসহ সবকিছুতেই এখন রাজনীতি টেনেআনার সংস্কৃতি চালু হয়েছে। এতে সব রাজনৈতিক দলের মধ্যেই একটি সুবিধাবাদীশ্রেণীর জন্ম হয়েছে। যারা রাজনীতি না করেও দলবাজি করে দল ও রাজনীতির ক্ষতিকরছে। হাটবাজার-জলমহাল থেকে গার্মেন্ট ঝুট সবকিছুতে এরা নিজেদের দখলদারিত্বপ্রতিষ্ঠা করার অসুস্থ প্রতিযোগিতা করছে। এতে অনেকের ব্যক্তিগত স্বার্থ হয়তো হাসিল হচ্ছে। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে রাজনীতি ও দেশ। অবস্থা এমনদাঁড়িয়েছে যে, সামাজিক দুর্বল প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতেও অনেক ক্ষেত্রেরাজনীতি ব্যবহৃত হচ্ছে। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক।
সাবেক এই এমপি আরওবলেন, রাজনীতিতে যে নীতি ও আদর্শবাদিতা থাকতে হয়, সেটা এখন অনেকাংশেইরাজনৈতিক দল বা রাজনীতিবিদদের চর্চা বা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নেই। এখন অনেকেরআচরণ দেখলে মনে হয়, রাজনৈতিক দলগুলো যেন রাজনীতির নামে তাদেরনেতা-কর্মী-সমর্থকদের এক ধরনের স্বজনপ্রীতি ও দলীয়করণের অলিখিত লাইসেন্সদিয়েছে। আর তারা এ লাইসেন্স নিয়ে পারস্পরিক যোগসাজশে দুর্বৃত্তায়নেরপ্রতিযোগিতা করছে। ফলে কোনো না কোনোভাবে বাংলাদেশের সব ঘটনা-দুর্ঘটনারসঙ্গে এ অসুস্থ রাজনীতির সম্পৃক্ততা খুঁজে পাওয়া যাবে। সাভার ট্র্যাজেডি বাবাংলাদেশের রাজনৈতিক সহিংসতা এ সবকিছুর নেপথ্যে এই রাজনীতিহীনতা বাদুর্বৃত্তায়নের প্রতিযোগিতা দায়ী। এ অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে দেশ ওরাজনীতির স্বার্থেই রাজনৈতিক দলগুলোকে মুক্ত হতে হবে। কীভাবে সেটা সম্ভবরাজনীতিবিদদেরই তা খুঁজে বের করতে হবে। রাজনীতির বিষয়ে এর বেশি আমি আর কোনোকথা বলেতে চাই না। কারণ এই রাজনীতি করতে হলে যা যা বিশেষণের প্রয়োজন হয়, আমার জন্য তা স্বাস্থ্যকর নয়। এ ছাড়া এ রাজনীতির জন্য আমি আমার ক্যারিয়ারেরসব অর্জন, নিজের চিন্তা-চেতনা ও আদর্শ এবং পারিবারিক ঐতিহ্য ও শান্তিবিসর্জন দিতে চাই না। তাই ২০০২ সালে আমি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামীলীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার কাছে লিখিত আবেদন করে আওয়ামী লীগের প্রাথমিকসদস্যপদসহ রাজনীতি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়েছি।
সাভার ট্র্যাজেডিপ্রসঙ্গে তিনি বলেন, গার্মেন্ট শিল্পের প্রতি বিদেশি বায়ার ও দেশেরশ্রমিকদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে রানা প্লাজা ধসের সঙ্গে জড়িত সবারদৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হতে হবে। এ ছাড়া অবিলম্বে নিহত ও আহত শ্রমিকদেরক্ষতিপূরণ প্রদান ও পুনর্বাসনের দায়িত্ব সরকার ও বিজিএমইএকে সমন্বিতভাবেইনিতে হবে।
বাংলাদেশ প্রতিদিনের সৌজন্যে।