আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সম্পন্ন করার ব্যাপারে দেশের মানুষ প্রায় একযোগে মত দিয়েছে।
প্রথম আলোর উদ্যোগে পেশাদার জরিপ পরিচালনাকারী সংস্থা ওআরজি-কোয়েস্ট রিসার্চ লিমিটেড পরিচালিত সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, আগের বছরগুলোর তুলনায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে জনমত এখন আরও জোরালো। বেশির ভাগ মানুষ মনে করছেন, দেশের পরিস্থিতি হতাশাব্যঞ্জক। দেশের সাম্প্রতিক অবস্থা নিয়ে মানুষের মতামত যাচাইয়ের জন্য গত ৯ থেকে ২০ এপ্রিলের মধ্যে এ জরিপ পরিচালনা করা হয়।
অধিকাংশ মানুষ এ কথা মনে করছেন যে, যুদ্ধাপরাধের বিচারের দ্বিতীয় ও তৃতীয় রায় ঘোষণার পর পর উদ্ভূত পরিস্থিতি সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি নিষিদ্ধ করার বিপক্ষেও সংখ্যাগরিষ্ঠ মত পাওয়া গেছে।
নির্বাচনকালীন সরকার, দেশের চলমান পরিস্থিতি ও এই প্রেক্ষাপটে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ, জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সেনা হস্তক্ষেপের শঙ্কা এবং বিতর্কিত বিভিন্ন দলের সঙ্গে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর জোটবদ্ধতা ইত্যাদি বিষয়ে এই জরিপে মানুষ তাদের মতামত জানিয়েছেন। এসব মতামতে দেশের এক সংশয়পূর্ণ ছবি ফুটে উঠেছে।
জরিপটি পরিচালিত হয় দেশের প্রতিটি প্রশাসনিক বিভাগের ৩০টি জেলা শহর ও গ্রামের তিন হাজার প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ওপর। বাংলাদেশের জনবিন্যাস অনুযায়ী উত্তরদাতাদের অনুপাত প্রতিনিধিত্বশীল রাখা হয়।
বিশ্বের বহু প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যম ও জরিপ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান এ পদ্ধতিতে জনমত যাচাই করে থাকে।ইউরোপিয়ান সোসাইটি ফর অপিনিয়ন অ্যান্ড মার্কেট রিসার্চের (ইসোমার) আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নৈতিক মানদণ্ড অক্ষুণ্ন রেখে জরিপটি করা হয়েছে।
জরিপে দেখা গেছে, দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ নির্দলীয় অথবা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় নির্বাচন চায়। এই দাবির পক্ষে মানুষের সংখ্যা এখন ৯০ শতাংশ। ২০১১ ও ২০১২ সালের জনমত জরিপেও মানুষের এ আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছিল।কিন্তু আগের জরিপের প্রায় অর্ধবছরের ব্যবধানে এর পক্ষে যথেষ্ট হারে জনমত বেড়েছে।
বেশির ভাগ মানুষ দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে অর্ধেক মানুষ বলেছে, দেশ অত্যন্ত খারাপ অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বাকি অর্ধেকের মধ্যেও ৩৫ শতাংশ মানুষের ধারণা, দেশ খারাপ অবস্থা পার করছে। এতে করে দেখা যায়, মোট ৮৫ শতাংশ মানুষ দেশের অবস্থা খারাপ বলে মনে করছে।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে যে সরকার কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি, এও তাদের হতাশার অন্যতম কারণ।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের প্রথম বর্ষপূর্তির সময় পরিচালিত জরিপে অধিকাংশ মানুষের মধ্যে এই প্রত্যাশা ছিল যে, ভবিষ্যতে হরতাল, অবরোধ ও সহিংসতায় ভরা নৈরাজ্যকর অবস্থা আর ফিরে আসবে না। পরবর্তী বছরগুলোতে তাদের এ আশাবাদে ক্রমাগত ভাঙন ধরেছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারে কাদের মোল্লা ও দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রায় ঘোষণার পর সারা দেশে যে তীব্র হিংসাত্মক ঘটনা ঘটে, ৭৯ শতাংশ মানুষ মনে করে, সরকার তা সামলাতে পারেনি। খুব কমসংখ্যক মানুষই বলেছে যে সরকার সুষ্ঠুভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে। প্রসঙ্গত, ২০০৯ সালের জরিপে বিপুল সংখ্যায় মানুষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি করে এবং মহাজোট সরকার এ বিচারের কাজ সম্পন্ন করতে পারবে বলে প্রত্যাশা জানায়।
এবারের জনমত জরিপে অর্ধেকেরও বেশি মানুষ জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার বিপক্ষে মত দিয়েছে।
শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের পক্ষে সমর্থন জানিয়েছে প্রায় এক-চতুর্থাংশ উত্তরদাতা।পক্ষান্তরে এর বিপক্ষে মত দিয়েছে অর্ধেকের সামান্য কিছু বেশি মানুষ। জরিপে দেখা গেছে, উল্লেখযোগ্য পরিমাণে প্রায় প্রতি পাঁচজনের একজন মানুষ গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন সম্পর্কে জানে না।
শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ ব্যাপক জনসমর্থন নিয়ে তাদের আন্দোলন শুরু করে। পরে প্রধান বিরোধী দলসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠী তাদের নিয়ে সমালোচনামুখর হয়ে উঠলে এবং তাদের সম্পর্কে নানা অপপ্রচার চললে মানুষের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়।
বেশির ভাগ মানুষ বিতর্কিত দলের সঙ্গে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্রব ও সম্পর্ক অপছন্দ করে। অর্ধেকেরও বেশি উত্তরদাতা আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাতীয় পার্টির এবং বিএনপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর জোটবদ্ধ থাকার বিপক্ষে।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সামরিক বাহিনী হস্তক্ষেপ করতে পারে কি না, এ প্রশ্নের জবাবে পক্ষে-বিপক্ষে মানুষের মতামত প্রায় কাছাকাছি। তবে এর মধ্যেও কিছু বেশি সংখ্যক মানুষ মনে করে তেমন কোন আশঙ্কা নেই। বেশ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে—প্রায় প্রতি চারজনের একজন—বলেছে যে, এ ব্যাপারে তারা কিছু বলতে চায় না বা কিছু জানে না।