কুকুরছানাটি পড়ে ছিল রাস্তার পাশে ড্রেনের ধার ঘেঁষে। শরীরের এক অংশ কাদায়মাখামাখি। ঘন কালো থকথকে আলকাতরার মতো কাদা বাঁ পাশের পুরোটাই জুড়ে। সেবারবার উঠে বসার চেষ্টা করেও পড়ে যাচ্ছিল, হয়তো পেছনের পায়ে আঘাতটা একটুবেশি লেগেছিল।
একদঙ্গল বালক তার পিছু লেগেছিল। হইহল্লা করে অনবরত ঢেলাছুড়ছিল। একজনের হাতে একটি বাঁশের কঞ্চি। কিছুক্ষণ পরপরই সে কঞ্চি দিয়ে আঘাতকরে চলছে। আর কুকুরছানাটি অনর্গল আর্তস্বরে ঘেউ ঘেউ করছে অথবা কেঁদে চলেছেঅবিরাম। ব্যথায় তার ছোট্ট দেহটি বারবার কেঁপে উঠছে।
দিনের কাজ শেষে এ পথে ফিরছিল হারু। তখনই সে তুলে এনেছিল ছানাটিকে।
নামও একটা শখ করে রেখেছিল, কালু।
হারুযখন কাজে যায়, পিছু নেয় কালু। গলির বাঁক পেরিয়ে টুকটুক করে একেবারে বড়পাকা রাস্তা পর্যন্ত চলে আসে। হারু অটোরিকশায় চেপে বসে। রিকশা তাকে নিয়েদূরে চলে যেতে থাকে। তখন একদৃষ্টে কালু সামনে তাকিয়ে থাকে উদাসভাবে।
ফ্যাক্টরিবলতে বাঁশের চাঁচড়ি দিয়ে ঘেরা মাঝারি মাপের লম্বা একটি চালাঘর। মাঝখানেপার্টিশন দিয়ে দুটো অংশে ভাগ করা। এক অংশে মেশিনে তামাক গুঁড়ো করে চালনিদিয়ে চালা হয়, অন্য অংশে চলে বিড়ি বাঁধার কাজ। এই দ্বিতীয় অংশেই ডজন তিনেকশিশু-কিশোর গোল হয়ে বসে বিড়ি বেঁধে চলে। হারু তাদের মধ্যেই একজন। রংপুরহারাগাছের এ অঞ্চলে ছোট্ট, বড় ও মাঝারি মাপের বেশ কিছু বিড়ি ফ্যাক্টরি গড়েউঠেছে—আদ্যিকাল থেকেই।
দিনের আলো ফুটতে না-ফুটতে কাজ শুরু হয় এবংআলোটুকু ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই ক্ষান্ত দেয়। এরই মধ্যে অনেকেরই কয়েক হাজারবাঁধা হয়ে যায়। ১২ বছরের হারু অতটা পেরে ওঠে না। মাত্র দুই হাজারেই তার হাতদুটো ধরে আসে, ব্যথায় টনটন করে। বিনিময়ে যা কিছু পায়, তাই দিয়ে চারচারটিপেটের মাত্র এক বেলার খোরাকি টেনেহিঁচড়েও কুলোতে চায় না। বাকি বেলারটা মামিস্ত্রির জোগালির কাজ করে কোনো রকমে চালিয়ে নেয়।
প্রথম প্রথম খুব কষ্ট হতো। তামাকের গন্ধে কাশতে কাশতে বমি হয়ে যেত। এখন সয়ে গেছে।
ভেতরে ঢুকেই হারু একবার চারদিকে চোখ বুলায়। আজও রঘু আসেনি। এ নিয়ে চার দিন হলো।
সূর্যমাথার ওপর গড়িয়ে গেলে শিশুশ্রমিকেরা বাড়ি থেকে আনা যার যার খাবার নিয়েবসে। ছগির তার ভাতে আমডাল ঢালতেই ক্ষুধার মাত্রা দ্বিগুণ বেড়ে যায় হারুর।তার আনা টিফিনবাটির শুকনো রুটি গলার কাছে আটকে থাকে, নামতে চায় না।
রঘু থাকলে নিশ্চয় একমুঠো দিত। ওই একমুঠো খেয়ে পানি খেলেই পেট ঠান্ডা। সেদিনের শিদল দিয়ে মাখা ভাতের সোয়াদ এখনো মুখে লেগে আছে।
ফিরতি পথে বৈশাখী ঝড়ে ধুলার তোলপাড়। গলির বাঁকে কালুর প্রতীক্ষায় পথ চেয়ে থাকার মিশ্র অনুভবে সন্ধ্যার মুখে মুখে ঘরে ফিরে আসে হারু।
স্নানসেরে বারান্দায় পিঁড়ি পেতে বসলে মা ভাত বেড়ে দেয়। প্রথম গ্রাসটা মুখেপুরতেই সামনে দৃষ্টি চলে যায়। উঠানে কালু বসে, এদিকেই সে তাকিয়ে, চোখেক্ষুধা-তৃষ্ণায় আকুল আকুতি। সারা দিনে ওর পেটে কী পড়েছে কে জানে, হয়তো বাকিছুই পড়েনি।
হারু দ্বিধাজড়িত স্বরে বলে,
—কালুক এত্তোনা ভাত দেইস তো, মাও।
—কী কলু? হাউস তো কম নয়। মানসি খাবার না পায়ছে আর তুই কুত্তাক খোয়াইস কোন হাউসে।
—ওর খিব ভোক নাগিছে।
—নাগুক, ভোক নাগিলে বাইরত উটকি উটকি খাউক। এইটে কী? মুই চাইর চাইরখানা প্যাটেরখোরাকির ধান্দায় বেহুঁশ হওছ, আর তুই কিনা আস্তা থেকি কুত্তা উদ্ধার করিআনলু। বেক্কল কোটেকার।
ওয়াসার লাইনে মা জল আনতে গেলে চট করে থালার অর্ধেক ভাত একটা পলিথিনে ঢেলে নেয়। ঘরের পেছনে লুকিয়ে কালুর মুখের সামনে মেলে ধরে।
পরদিনও রঘু এল না।
সাত দিনের দিন তাকে দেখা গেল। চৌরঙ্গির মোড়ের পানের দোকানে আরামে সিগারেট ফুঁকছে। পোশাক ও চেহারার চাকচিক্য বেড়েছে।
মহা উৎসাহে হারু এগিয়ে যায়।
—আরে অঘু, তুই এইটে। কামে যাইছিন না ক্যান?
—ধুসতোর কাম। বিড়ি বান্দি বান্দি হাতত ফোসকা পড়ি গেইল। হাজারে যে কটা পাইসাধরি দেয়, আঙুলের ফাঁক দি গলি পড়ে। না যাও মুই ওইটে। তার থেকি নয়া একটা…
মাঝপথেইথেমে যায় অথবা থমকে যায়। আর হারুর চোখ দুটো সরু হয়ে আসে। কিছু একটা গোপনকরছে কি অঘু? তার দৃষ্টিতে ধূমকেতুর ধূর্ততা, মুখের ভাবে হঠাৎ স্থবিরতা।
কিছুদূরেই মোটামুটি ভালো মানের একটি রেস্টুরেন্ট। হারুকে নিয়ে রঘু একেবারেকোনার দিকের টেবিলটায় বসে। অর্ডার দেয় মোগলাই পরোটা, শিককাবাব, রাজভোগ আরকফি। একসঙ্গে এতগুলো ভালো খাবার কখনো কি জুটেছে হারুর কপালে?
টেবিলে ঝুঁকে আসা হারুর অবনত মুখ। সেখান থেকে খুব নিচু স্বরে বাতাসে ফিসফিস তরঙ্গ ওঠে।
—একটে নয়া কাম পাছু, ওষুদ সাপ্লাইয়ের কাম।
রঘু আড়চোখে চারদিকটা দেখে নেয় একবার। বাতাসে নিরবচ্ছিন্ন শব্দস্রোত…
—বুঝলুনা, বিড়ি বান্দা কামটা কি ভালো? ভালো না। গতরের বাদে খিব খারাপ। হাউস করিযক্ষ্মা, ক্যানসার ডাকি আনা। আর মুই এলায় যেইখান কাম করোছ ওষুদ সাপ্লাইয়েরকাম। এককথায় মেডিকেল ইপেজেনটিভ। ঢেইল্যা কামাই। তুই করবু?
রাতে বিছনায় শুয়ে সে নির্ঘুম। মায়ের কাছে প্রশ্ন তোলে, বিড়ি বান্দা কি খারাপ কাম, মা?
সালেহারপক্ষে চট করে উত্তর দেওয়া কঠিন। ছেলে বিগড়ে কাম ছেড়ে দিলেই এতগুলো পেটেলাথি পড়বে। সে একেবারে নিশ্চুপ। অথচ বুকের ভেতর সমুদ্রের উথালি-পাথালি ঢেউআছড়ে পড়ে।
বাবা চোখ বোজার পরেই হারুর লেখাপড়ার পাট চুকে গেল। স্কুল ছেড়ে বিড়ির ফ্যাক্টরিতে ঢুকতে বাধ্য হলো। হাতে পেনসিল-কলম ছেড়ে বিড়ি উঠল।
ভালো-মন্দ বিচার করার ইচ্ছা বা ক্ষমতাই বা কতটুকু সালেহার।
হারুরবাপের নিজের জমি ছিল না। বর্গাচাষে যে ধান আবাদ হতো, নিজের বরাদ্দ ভাগেরটাদিয়েই সারা বছরের অন্নসংস্থান হয়ে যেত। কারও কাছে হাত পাততে লাগেনি।
এরপরজমির মালিকের হুকুমে যখন ধানের বদলে তামাক চাষ করা হয়, তখন ভাগের তামাকবেচার অর্থে সারা বছরের চাল একযোগে আর কেনা হয়ে ওঠে না। বছর শেষে ট্যাঁকেরকড়িও ফুরিয়ে আসে আর চালের দামও হয় ঊর্ধ্বমুখী।
হারুর বাপ আক্ষেপ করত…
—ধানউকড়ি দি তাংকু চাষ…! ব্রিটিশরা খাবার উকড়ি নীল চাষ করি দোষী হইল। আরএলায় কর্তা মানসিরা ধানের বদলে তাংকু চাষ কইরলে কোনো দোষ হয় না?
সালেহাশুধু ভাবে, ‘রাঘব-বোয়ালের শেকড়েই তো ঘুণ, মুখের অন্ন কাড়ি ধুমার কাঠি গুঁজিদেয়। আর মুই তো ছা-পোষা চুনাপুঁটি, মোর আর কী বা ক্ষ্যামতা।’
উদাস ভঙ্গিতে পাশ ফিরে শোয় সে এবং নির্বিকারভাবে উত্তর দেয়
—কানা আইতত বক বকাইস না তো হারু। এলায় নিন যা।
একসন্ধ্যায় হারুর কাছে কালোমতো একটা র্যাক্সিনের ব্যাগ পৌঁছে যায়। ভেতরেছোট ছোট পলিব্যাগে অসংখ্য বড়ি। রঘুর হাতে দুটো খোলা বড়ি ছিল। কী সুন্দরগোলাপি রং!
তিন দিন পর জায়গামতো পৌঁছে দিতেই মুঠোভরে নগদ টাকা। একসঙ্গেচারচারটি পাঁচ শ টাকার কড়কড়ে নোট হাতে ধরে দেখেছে কখনো হারু? সারা মাসেবিড়ি বান্দে কামাই করা ফান্দি না। বিড়ি বান্দার কামে লাথি মারি। অঘু ঠিকইবলছে। মাসে এই রকম দুই-তিনটা কাম যদি পাওয়া যায়, তাহলে তাকে আর পায় কে?
১০দিনেও হারু টিনের সেই দোচালার ঢোপটিতে পা মাড়ায় না। মায়ের চোখ টানটান, দুইভ্রুর মধ্যে দুঃস্বপ্নের প্রশ্নবোধক চিহ্ন। কিন্তু শীতের এক নিশুতি রাতেযখন পাঁচপাঁচটি নয়া বড় নোট হাতে গুঁজে দেয়, তখন সালেহার নিঃশ্বাসে স্বস্তি।সে কিছু একটা অনুমান করতে পারে, অথবা পারে না।
কিংবা সব বুঝেও না-বোঝার ভান করা বেশি যুক্তিযুক্ত মনে হয়।
এবারের চালানটা যেন একটু বড়ই। দু-দুটো ব্যাগ। একটায় ওষুধ। আরেকটা মনে হচ্ছে কার্টন, বেশ ভারী। ভেতরে ওষুধের বোতল থাকতে পারে।
প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে বটতলার মোড়ে মোটরসাইকেল নিয়ে অপেক্ষা করবে রঘু।
দু-দুটো ব্যাগের ভারে হারুর ছোট্ট শরীরটা সামনের দিকে অনেকটাই ঝুঁকে পড়েছে। কালু পেছন পেছন হেঁটে চলছে।
বটতলারমোড়ে রঘুর মোটরসাইকেলটা ঝাপসা ও অস্পষ্ট। এদিকে বিদ্যুৎ নেই। পেছনে আরওদু-দুটো বড় ব্যাগ। কাছে যেতেই মোটরসাইকেল থেকে ব্যাগ দুটোকে সে নামিয়ে নেয়।এখন চারটাকে জুতমতো বেঁধে নিতে হবে। বড় রশি বের করতেই কাছে কোথাও বাঁশিরশব্দ। আর রঘুর উৎকর্ণ কান মুহূর্তেই সজাগ।
রঘু আর এক মুহূর্ত সময় নষ্টকরে না। মোটরসাইকেলে চড়ে বাঁশির শব্দের বিপরীতে নিমেষেই হাওয়া। যাওয়ার সময়ব্যাগগুলো ফেলে দিতে ভুল করে না।
কালু অনবরত ঘেউ ঘেউ করছে। হারুর মনেবিস্ময়। এ ধরনের বাঁশি সাধারণত পুলিশরা বাজায়। ওরা এখানে কেন? হঠাৎ রঘুই বাপালাল কেন? তাহলে কি…? পলকের জন্য প্যাকেটগুলো একবার সে দেখে নেয়।
কালুউন্মত্তের মতো ছুটোছুটি করছে। বাতাস কাঁপিয়ে ঘেউ ঘেউ করে চলছে অনর্গল।পুলিশ তাড়া করছে। পোশাক কামড়ে ধরেছে। ও কি প্রভুর বিপদের আশঙ্কায় এমনিভাবেমাতাল, অনভ্যস্ত অদ্ভুত আচরণে উন্মত্ত?
বটতলার মোড়ে উত্তর দিকে একটা সরুখাল। ওপর দিয়ে মাঝারি মাপের একটা ব্রিজ। প্যাকেটগুলোকে সে বিস্ময় ওকৌতূহলভরা চোখে আরেকবার দেখে নেয়। তারপর ত্বরিতগতিতে লাফ দিয়ে ব্রিজের নিচেপড়ে।
আজ সকাল থেকেই বৃষ্টি ঝরছে অবিরাম। কালু আজ দুই দিন হলো ফিরে আসেনি।
এইবাদলায় সন্ধ্যার আগেই যেন সন্ধ্যা নেমে আসে, অনেকটা হুড়মুড় করে। পুবেররাস্তা ধরে আরও খানিকটা সে হেঁটে চলে। হঠাৎ থমকে যায় সে। হাত দশেক দূরেরাস্তায় নীরবে পড়ে আছে কী ওটা? থকথকে জলকাদায় মাখামাখি দেহ। দৃষ্টি ঘোলাটে, স্থির, পাণ্ডুর।
পাশেই হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে হারু। আলতোভাবে হাত রাখে। কীহিমশীতল, স্পন্দনহীন নিথর দেহ! গুলিটা পেটে লেগেছিল। এখনো খানিকটা কালচেজমাটবাঁধা রক্ত লেগে আছে। বৃষ্টির জল ধুয়ে নিতে পারেনি।
হঠাৎ ভীষণকান্না পেল হারুর। বৃষ্টির জল ধোয়া নিভৃত সন্ধ্যার আলো-আঁধারিতে খুবকাছাকাছি দুটি প্রাণী, অথচ মাঝের দূরত্বটুকু সীমাহীন, শোকতপ্ত এমুহূর্তটুকু যেন অনন্তকাল…।
মধ্যরাতে ঘরের দরজায় টোকা পড়ে। রঘু এসেছে। হাতে বড় বড় দুটো প্যাকেট। তার কণ্ঠে ভাঙা ভাঙা টুকরো শব্দ।
—পোটলাখান ধরিস। খাটি বিলাতি ওষুদ। খাসা মাল।
হারু ফোঁস করে ওঠে,
—হারে, ওইলা কিসের ওষুদ, কইস তো মোক? কিসের ওষুদের তুই চালান করিস যে ঠোল্লা পাছেনাগে? মুই না রাখো। না করো মুই চালানের ব্যবসা। ধরি যা সউগ।
কিন্তু রঘু কিছুই কানে তোলে না, পাত্তাও দেয় না। শুধু মৃদু হেসে দরজার চৌকাঠের এপারে ঘরের ভেতর নির্বিঘ্নে প্যাকেট দুটো রেখে দেয়।
এবার চিৎকার করে ওঠে হারু।
—অঘু, ভালো হইবে না কিন্তু। মুই তোর ওষুদের পিণ্ডি চটকাই, গুষ্টি মারি…।
নিগা সউগ নিগা…।
প্যাকেটগুলো তুলে সে ঘরের বাইরের নিকষ আঁধারে সজোরে ছুড়ে ছুড়ে ফেলে।