প্রাত্যহিক জীবনে মানুষ নানা কাজে ব্যস্ততা এবং বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের কারণে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। কর্মক্লান্ত মানুষের আত্মিক সজীবতার জন্য প্রয়োজন বিশ্রাম ও বিনোদন। মানুষের শরীরের জন্য যেমন বিভিন্ন ধরনের খাদ্য ও ভিটামিন জরুরি তেমনি তার আত্মার জন্যও বিনোদন, বিশ্রাম ও খাদ্য জরুরি। আনন্দ ও চিত্তবিনোদন মানুষের মধ্যে হতাশা ও ব্যর্থতার গ্লানিসহ অন্যান্য নেতিবাচক অনুভূতিকে মন থেকে মুছে দেয় । আনন্দের অনুভূতি মানুষকে প্রশান্তি দেয় এবং মনকে সুস্থ ও সতেজ রাখে । বিশ্বনবী (সা.)’র পবিত্র আহলে বাইতের সদস্য হযরত ইমাম রেজা (আ.) বলেছেন, আনন্দ ও চিত্তবিনোদন মানুষকে জীবন-যাপনের ক্ষেত্রে সহায়তা করে এবং এ সবের সহায়তায় দুনিয়ার বা পার্থিব বিষয়ে বেশি সাফল্য পাওয়া যায়। আজকাল মনোবিজ্ঞানীরা মানুষের সুস্থতার জন্য আনন্দ ও চিত্তবিনোদনকে খুব গুরুত্ব দিচ্ছেন। বিভিন্ন রোগের চিকিত্সার ক্ষেত্রেও আনন্দ ও চিত্তবিনোদনকে ব্যাপক গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। অনেক মনোবিজ্ঞানী বলছেন, চিত্তবিনোদন, হাসি-খুশি ও প্রফুল্লতা বিভিন্ন ধরনের রোগ প্রতিরোধ করে এবং শরীরে নানা ধরনের ক্যান্সারের দ্রুত ছড়িয়ে পড়াকেও ঠেকিয়ে রাখে। চিকিত্সা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে হাসি ও প্রফুল্লতা এমন এক অনৈচ্ছিক প্রতিক্রিয়া যার ফলে মুখের ১৫টি মাংসপেশি একই সময়ে সংকুচিত হয় এবং দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস ঘটে। এছাড়াও হাসি ও প্রফুল্লতার সময় শরীরের রক্ত-প্রবাহ দ্রুত সঞ্চালিত হওয়ায় রক্তে এড্রেনালিন বেড়ে যায়। ফলে মানুষ আরও সজীবতা ও আনন্দ অনুভব করে। মানুষের জীবনে যদি আনন্দ ও প্রফুল্লতা না থাকত তাহলে মানুষ মানসিক চাপের তীব্রতায় প্রাণ ত্যাগ করত। তাই জনগণের মধ্যে হতাশা দূর করা ও তাদের চিত্তবিনোদনের জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা নেয়া সরকারের দায়িত্ব। সরকার জনগণের জন্য সুস্থ বিনোদন ও নিষ্কলুষ আনন্দের ব্যবস্থা করতে পারলে তা দেশের উন্নতি-অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
একইভাবে পরিবার ও সমাজের উন্নতির জন্যও দুঃখ ও হতাশা দূর করা এবং আনন্দ ও চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা করা জরুরি। আনন্দিত বা দুঃখিত হওয়া কেবল একজন মানুষের নিজের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয় নয়। কারণ, একজন মানুষের হাসি-খুশি মুখ এবং দুঃখ-ভারাক্রান্ত বা ক্রুদ্ধ চেহারা অন্যদেরও প্রভাবিত করে। ব্রিটিশ জীববিজ্ঞানী রুপার্ট শেল্ডারকে বলেছেন, মানুষের স্মৃতি এবং অনুভূতি কেবল মগজের মধ্যেই সঞ্চিত থাকে না, মানুষের মধ্যে সামষ্টিক বা সামাজিক অনুভূতি নামে এক ধরনের বিশেষ অনুভূতি রয়েছে। আর এ অনুভূতি-শক্তির মাধ্যমে মানুষ পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়। আর এ কারণেই অন্যের সুখ ও দুঃখ মানুষকে প্রভাবিত করে।
অবশ্য মানুষের সুখ আপেক্ষিক বিষয়। বিভিন্ন ধরনের মানুষ বিভিন্ন অবস্থায় আনন্দ পায়। কোনো কোনো সমাজ-বিজ্ঞানীর মতে, সমাজের দুর্বল বা বঞ্চিত শ্রেণীর মানুষ ফুটবল খেলা দেখা বা এ ধরনের বিষয় থেকে আনন্দ পায়। আবার মধ্যবিত্ত বা অবস্থা সম্পন্ন লোকেরা অর্থ জমিয়ে এবং বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করে আনন্দ বা সুখ উপভোগ করতে চায়। গ্রিক দার্শনিক এরিস্টোটল মনে করতেন চিন্তাশীল জীবনের মধ্যে রয়েছে আনন্দ এবং এই আনন্দই হচ্ছে সর্বোচ্চ আনন্দ। আবার অনেক দার্শনিক ও গবেষক মনে করেন কেবল ধর্মীয় ও নৈতিক জীবন যাপনের মধ্যেই রয়েছে আনন্দ।
পবিত্র ইসলাম ধর্ম মানুষের শারীরিক ও আত্মিক সমস্ত চাহিদার প্রতি গুরুত্ব দেয়। ইসলাম মনে করে, একটি সফল জীবনের জন্য প্রশান্তি ও প্রফুল্লতা থাকা জরুরি। পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন স্থানে সুখ বা আনন্দ শব্দটি প্রায় ২৫ বার এসেছে। যারা মানুষের জন্য আনন্দ ও সুখের ব্যবস্থা করেন, পবিত্র কোরআন তাদের প্রশংসা করে এবং তারা পরকালে আল্লাহর কাছ থেকে পুরস্কার পাবে বলে উল্লেখ করেছে। ইসলাম মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে আনন্দ উপভোগের দিক নির্দেশনা দিয়েছে। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)’র আহলে বাইতের সদস্য হযরত ইমাম রেজা (আ.) বলেছেন, তোমার প্রাত্যহিক তত্পরতার সময়কে চার ভাগে ভাগ করে নাও। এই চার ভাগের এক ভাগ সময়ে আল্লাহর এবাদত করবে। এক ভাগ ব্যয় করবে আয়-উপার্জনের জন্য, অন্য এক ভাগ সময়ে নিজের বিশ্বস্ত ভাইদের সঙ্গে ও এমন লোকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে যারা তোমাকে তোমার দোষ-ত্রুটি সম্পর্কে অবহিত করবে। এছাড়াও অন্য একভাগ সময় চিত্তবিনোদন ও আনন্দের জন্য বরাদ্দ রাখবে। আর আনন্দ ও চিত্তবিনোদনের মাধ্যমে অর্জিত মানসিক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে অন্য সময়ের দায়িত্ব এবং কাজগুলো সম্পন্ন করবে।
সুস্থ বিনোদন বা নিষ্কলুষ আমোদ-প্রমোদ মানুষকে সুস্থ আনন্দ উপহার দেয়। রংবেরংয়ের ফুল, সবুজ গাছ-পালা, ঝর্ণা, পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা প্রভৃতি সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে আমরা একদিকে যেমন আনন্দ উপভোগ করতে পারি, তেমনি কিছুটা হলেও মহান আল্লাহর নেয়ামত বা অনুগ্রহকে উপলব্ধি করে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে পারি। ভ্রমণ ও এর মাধ্যমে সুন্দর দৃশ্য দেখা বা জ্ঞান অর্জন করা সুস্থ বিনোদনের আরেকটি মাধ্যম। পবিত্র কোরআন মানুষকে বিভিন্ন স্থান ভ্রমণ করে অতীতের জাতিগুলোর পরিণতি থেকে শিক্ষা নিতে বলে। ভ্রমণের ফলে মানুষের মনে জমে থাকা অবসাদ, একঘেয়েমি ও ক্লান্তি দূর হয় এবং মন সতেজ ও প্রফুল্ল হয়ে ওঠে। ভ্রমণ মানুষের শরীরকেও সুস্থ রাখে। এ জন্যই বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) বলেছেন, তোমরা সুস্থ থাকার জন্য ভ্রমণ কর।
শরীর-চর্চা ও খেলাধুলাও বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম। বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.) বলেছেন, পিতার ওপর সন্তানের অধিকার হলো, পিতা সন্তানকে লেখা, সাঁতার ও তীর-চালনা শেখাবে এবং বৈধ আয়ের মাধ্যমে সন্তানের জীবিকা নির্বাহ করবে। বিভিন্ন উত্সব অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়াও আনন্দ ও বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম। এ জন্যই ইসলাম ধর্মীয় উত্সব বা দিবস ও ধর্মীয় নেতা বা মহান ইমামগণের জন্মদিনে উত্সব পালন করাকে গুরুত্ব দিয়েছে। তবে উত্সবের নামে বাড়াবাড়ি, অপচয় অর্থহীন কর্মকাণ্ড ও অপসংস্কৃতি বা অনাচারে জড়িয়ে পড়া নিষিদ্ধ। চিন্তাবিদদের মতে অন্যদের সহায়তা করা এবং গরিব ও অসহায় ব্যক্তিদের সাহায্য দেয়ার পাশাপাশি ধর্মীয় ফরজ বা অবশ্য-পালনীয় কর্তব্য সম্পাদনও প্রকৃত ও অকৃত্রিম আনন্দের উত্স ।
দুনিয়ার আকর্ষণ ও চাকচিক্য থেকে নিজেকে দূরে রাখাও প্রকৃত সুখ বা আনন্দের উত্স। ভোগবাদ, বিলাসিতা ও চাকচিক্যের প্রতি মোহ মানুষকে লোভী ও পরকালের প্রতি উদাসীন করে। লোভী মানুষ অনেক কিছু পেয়েও সন্তুষ্ট হয় না, ফলে তার মধ্যে মানসিক অশান্তি বাড়তেই থাকে। তাই যারা দুনিয়ার বাহ্যিক জাঁকজমক ও চাকচিক্যের প্রতি আকৃষ্ট হয় না, তাদের দৃষ্টি হয় অনেক উদার ও প্রসারিত। এ ধরনের মানুষ সামান্য সমস্যায় নতজানু হন না এবং তারা বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যেও উঁচু মনোবলের অধিকারী হন। এক্ষেত্রে প্রার্থনা বা মোনাজাত মানুষের অন্তরে শক্তি যোগায় এবং আত্মাকে করে সজীব ও প্রাণবন্ত। কবিতা বা গজল আবৃত্তি, বিয়ের উত্সব, উপহার দেয়া, উজ্জ্বল রংয়ের জামা-কাপড় পরা, সুগন্ধি ব্যবহার, সুন্দর সাজে সজ্জিত হওয়া, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের সাথে দেখা-সাক্ষাত্ এবং সর্বোপরি কর্ম ও সাধনায় জড়িত থাকা ইসলাম-নির্দেশিত নির্মল আনন্দের আরো কিছু মাধ্যম। সবশেষে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)’র একটি বাণী শুনিয়ে শেষ করব আজকের এই আলোচনা। তিনি বলেছেন—যে কেউ একজন মুমিনকে আনন্দ দিল, সে যেন আমাকে আনন্দ দিল, আর যে আমাকে খুশি করল, সে অবশ্যই আল্লাহকেও খুশি করল।