সাভারের অধরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় মাঠ এখন হয়ে উঠেছে লাশের হাট। সারি সারি লাশ রাখা হয়েছে মাঠজুড়ে।আর নিহত ও নিখোঁজ শ্রমিকদের স্বজনদের কান্না আর আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছে অধরচন্দ্র এলাকার আকাশ-বাতাস। রাত বাড়লেও এ হাটে লোকের আনাগোনা কমছে না। এ বাজারে আসছে লাশের মিছিল। রানা প্লাজা ধ্বসে নিহতদের লাশ আনা হচ্ছে স্কুলের মাঠে। অগণিত লাশ দেখে এই মাঠকে দেখে এখন স্কুল মাঠ বলে মনে হয় না, যেনো লাশের হাট বসেছে এখানে। স্বজনেরা কাফনের কাপড়ে উল্টিয়ে খুঁজে ফিরছে প্রিয়জনের লাশ।
অধরচন্দ্র বিদ্যালয় মাঠ বেশ বড়। মাঠের এক পাশে দোতলা যে বিল্ডিং রয়েছে, তার নিচতলার বারান্দায় রাখা হয়েছে সারি সারি কাফনে মোড়া লাশ। দুর্ঘটনার পড় অনেক সময় গড়িয়ে গেছে। কাফনের মুখ খুলে যারা লাশের সন্ধান করছেন এখন তাদের নাক চেপে দেখতে হচ্ছে। একের পর এক দেখছে, অনেকের মিলছে প্রিয় চেহারার নিথর প্রাণটি। কেউ বোবা কান্নায়, কেউ আহাজারি করে ফিরছেন এখান থেকে।প্রিয়জনের লাশ খুঁজে পেয়ে জমে থাকা কান্না আর বাধ মানে নি তিনি ভাই হায়েম, ফারুম আর ফায়েজের। হাউ মাউ করে কেঁদে তিন ভাই তাদের মেঝো ভাই ফিরোজের লাশ নিয়ে বাড়ি যাওয়ার কথা ভাবছিলেন। কান্নারত তারা নিজেদেরকেই প্রশ্ন করছেন বাবা-মায়ের কাছে কি জবাব দেবেন?
জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২০ হাজার টাকা দেওয়া হয় হায়েমের হাতে। টাকা গুনে দেখার অবস্থা নেই এ লাশের হাটে। নিজের প্রিয়জনের লাশ নিয়ে পিকআপে করে চলে যায় তিন ভাই।একটু পর পর অ্যাম্বুলেন্সে লাশ নিয়ে এনে রাখা হয় স্কুলের বারান্দায়। মাঠে অপেক্ষা করা স্বজনরা আবার দৌড়ে যায়। নাহ..এবারো দেখা মেলেনি গাইবান্ধার রফিকুল ইসলামের বোন রাশেদার। হাসপাতালেও দেখা মেলেনি তার।
২০ বছর বয়সী রাশেদার বাড়ি সাদুল্যাপুর উপজেলায়, দামদুরপুর গ্রামে।রফিকুল জানালেন, বছর চার আগে বিয়ে হয়েছিল একমাত্র ছোট বোনের। ২ বছরের বাচ্চা ইসমাইল এখন মাকে খুঁজছে। স্বামী সাইফুল ইসলামও একই ফ্লোরে ছিল। আহত হয়ে এক বাসাতেই রয়েছে। একই কারখানার শ্রমিক রাশেদার ননদও আহত হয়ে বাসায়।
বুধবারেই ঢাকায় আসেন রাশেদার স্বজনেরা। গত ৩০ ঘণ্টা ধরে খুঁজেও পাচ্ছে রাশেদাকে পাচ্ছে না জ্যাঠাতো ভাই মাজেদুর ইসলাম মাদেল, দেবর মো. বাবু, ফুফাতো ভাই মাহবুব। মাঠের এক কোনে বসে আরো অ্যাম্বুলেন্স আসার অপেক্ষায় করছেন তারা।
স্ত্রী নাসরিন আনোয়ার রানা প্লাজার ৪ তলায় কাজ করতেন। আনোয়ার জাহিদ মাঠে ঘুরছেন একা একা। হাতে বৌ এর ছবি। আট বছর আগে বিয়ে হয়ছিল তাদের। সিয়াম ও রাইসা নামে দুই বাচ্চা রয়েছে। নওগার মুক্তারপাড়া গ্রামে তাদের বাড়ি রাত সোয়া ১১টা। আরেকটি অ্যাম্বুলেন্সে লাশ এসেছে। মাঠের হাজারো মানুষ আবারো ছুটেছে সেদিকে।ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করা এসব স্বজনদের খাবারে আগ্রহ নেই। মাঠের একপার্শ্বে খাবার বিলাচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবকরা। খাবার আর পানি দিচ্ছের তাদের।রয়েছে মেডিকেল টিমও।
স্কুলের ফটকে সন্ধান চাই বিজ্ঞাপন আঠা দিয়ে সাটানোর আর জায়গা নেই। পাসপোর্ট সাইজ, থ্রি আর বা ফটোকপি দিয়ে প্রিয়জনের সন্ধান চেয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছে স্বজনরা।লাশের এ হাট কখন গুটাবে এখনও বলা যাচ্ছে না। এই হাটের যেনো শেষ নেই। রাত রাড়ার সঙ্গে বাড়ছে হাটের স্থায়িত্ব।অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামানো লাশে নেই প্রিয়জনের মুখ। তাই আবারো ফিরে আসে কমলাকে হারানো স্বামী মোদাচ্ছের। চোখ ছল ছল করে। দুঃখ তাকে এমনই কাবু করে ফেলেছে যে এখন বুক ফেটে কান্না করতেও পারছে না সে।
(রুপশী বাংলা নিউজ) ২৬ এপ্রিল /২০১৩.