সতেরো শতকের অজানা ঢাকা সম্পর্কে অজস্র তথ্য ছড়িয়ে আছে ওলন্দাজ বণিকদের ভ্রমণ বিবরণী, ডায়েরি, বার্ষিক প্রতিবেদন, লেজার বুকসহ নানান চিঠিপত্রে।নেদারল্যান্ডসের হেগ শহরে অবস্থিত জাতীয় মহাফেজখানায় সংরক্ষিত এসব নথির কারণে নতুন করে লিখতে হবে ঢাকার ইতিহাস। লিখেছেন আজিজুল ইসলাম
তথ্যের স্বল্পতার কারণে সতেরো শতকের ঢাকার ইতিহাস রচনা করতে ইতিহাসবিদদের বিশেষ সমস্যায় পড়তে হয়। এতকাল ঢাকার প্রথম শতকের ইতিহাসের জন্য নির্ভর করেতে হয়েছে গুটিকয়েক ফার্সি ক্রনিকল আর পর্যটকদের ভ্রমণ বিবরণের ওপর। দীর্ঘদিন ধরে ইতিহাসবিদেরা জানতেনই না, সতেরো শতকে ঢাকার জন্ম, পথচলা ও বেড়ে ওঠার কাহিনি জানতে আমাদের জন্য পসরা সাজিয়ে রেখেছে ওলন্দাজ মহাফেজখানা।
বহির্দেশে, বিশেষ করে এশিয়ায় সমুদ্রবাণিজ্য পরিচালনায় ওলন্দাজ রাজ্যের শত্রুর বিরুদ্ধে লড়ার জন্য ১৬০২ সালে ওলন্দাজরা গঠন করেছিল ফেরেনেগিড উস্ট ইনডিসি কম্পাগনি বা ভিওসি, ইংরেজিতে যাকে আমরা ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নামে চিনি। কোম্পানি প্রতিষ্ঠার এক দশকের মধ্যেই পর্তুগিজদের হটিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, বিশেষ করে ইন্দোনেশিয়ায় কোম্পানি তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে।বাটাভিয়ায় (বর্তমানে জাকার্তা) কোম্পানির এশীয় বাণিজ্যের প্রধান ঘাঁটি স্থাপন করা হয়। ধীরে ধীরে কোম্পানি বাণিজ্যের প্রসার ঘটিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও পারস্যের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপন করে।
ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ব্যবসায়ের প্রয়োজনে যেসব হিসাব, চিঠিপত্র, প্রতিবেদন তৈরি করত, তা প্রথমে বাটাভিয়ায় পাঠাত। সেখান থেকে সব নথিপত্র যেত ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হেডকোয়ার্টার্স আমস্টারডামে। সেখানে এই নথিগুলো সংরক্ষণ করা হতো। পরবর্তীকালে কোম্পানি যখন ভেঙে দেওয়া হয়, তখন এই নথিগুলো ডাচ এডুকেশন, কালচারাল অ্যান্ড সায়েন্স মিনিস্ট্রি নিয়ে নেয়। বর্তমানে এই নথিপত্রগুলো সংরক্ষিত আছে হেগ শহরে অবস্থিত জাতীয় মহাফেজখানায়।
ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলায় কারখানা স্থাপন করে ১৬৩০-এর দশকে। তবে ঢাকায় ওলন্দাজরা কারখানা প্রতিষ্ঠা করে আরও অনেক বছর পর। একটি চিঠিতে একজন ওলন্দাজ কোম্পানি কর্মকর্তা তাঁর ওপরস্থ কর্মকর্তাকে তাঁদের ঢাকা অভিযানের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে লিখেন যে তাঁরা ঢাকায় কারখানা স্থাপনের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে ঢাকা সফরে গিয়েছিলেন। কিন্তু হুগলিতে কিছু মোগল অফিসারের সঙ্গে কোম্পানি কর্মকর্তাদের বচসা হওয়ায় ঢাকায় সফরকারী ওলন্দাজদের জাহাজ আটক করা হয় এবং তাঁদের নবাবের কয়েদখানায় পাঠানো হয়। অবশেষে দিল্লিতে উচ্চপদস্থ ওলন্দাজ কর্মকর্তারা মোগল সম্রাটকে দামি উপহারসামগ্রী দিলে তাঁরা মুক্তি পান। এই তিক্ত অভিজ্ঞতার প্রায় আরও কুড়ি বছর পর ওলন্দাজরা ঢাকায় কারখানা স্থাপন করে। ঢাকার রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য সম্ভাবনার এ রকম বিভিন্ন আলোচনা-পর্যালোচনা পাওয়া যায় তাদের বিভিন্ন প্রতিবেদন ও চিঠিপত্রে।
ঢাকা সম্পর্কে তথ্য যেসব নথিপত্রে পাওয়া যায়, এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো বাংলা অঞ্চলের কারখানা-প্রধানের বার্ষিক প্রতিবেদন, ওলন্দাজ ভাষায় যাকে বলা হয় মেমোরি ওভারখাফে। এ ছাড়া ১৬৫০ সালের পর থেকে ওলন্দাজদের ঢাকা কারখানা-প্রধানের চিঠি, হিসাবপত্র ও প্রতিবেদন থেকেও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানা যায়। এসব চিঠিপত্রে ঘুরেফিরেই কেরানীগঞ্জ, ময়মনসিংহ, রংপুর ও শেরপুরের নাম আসত। ঢাকা সম্পর্কে জানার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নথি হলো ওলন্দাজ কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত ডায়েরি। প্রায় প্রত্যেক ওলন্দাজ কর্মচারী-কর্মকর্তা তাঁদের নিজস্ব ডায়েরি রাখতেন। এ রকম বেশ কিছু ডায়েরি সংরক্ষিত আছে ওলন্দাজ আর্কাইভসে। এসব ডায়েরির নাম ডাক্কা ডাখবুক বা ঢাকা ডায়েরি। সতেরো শতকের ঢাকার সামাজিক ইতিহাস রচনার জন্য এসব ডায়েরির মূল্য অপরিসীম।
আরেক ধরনের মূল্যবান ওলন্দাজ নথি দাখ রেখিস্টার বা লগ বুক এবং ভৌগোলিক বিবরণ। জাহাজের নাবিক এবং ক্রুরা প্রতিদিনের ঘটনা লিপিবদ্ধ করতেন এ রকম খাতায়। পূর্ববঙ্গ থেকে কোনো জাহাজ যখন মাল বোঝাই করে হুগলি এবং বাংলার আরও কোনো অঞ্চলে যেত, তখন বেশির ভাগ সময়ই এসব লগ বুকে তাঁরা পূর্ববঙ্গ সম্পর্কে পাওয়া বিবরণ দেন।
সতেরো শতকে আরাকানের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক ছিল ওলন্দাজদের। আরাকানিদের প্রধান ব্যবসা ছিল বাংলা থেকে নারী-পুরুষ জোর করে তুলে নিয়ে দাস হিসেবে ওলন্দাজদের কাছে বিক্রি করা। আরাকানিদের সঙ্গে ব্যবসা এবং ঢাকায় তাদের বাণিজ্য-সম্ভাবনা খতিয়ে দেখার জন্য বিভিন্ন সময়ে তারা এ অঞ্চলে যাতায়াত করত। তখনকার বিবরণ তারা নোটবুকে টুকে রাখত। কিন্তু সেসবের বেশির ভাগই ইংরেজিতে অনূদিত না হওয়ায় আমরা এর হদিসই জানতাম না।উদাহরণ হিসেবে একটি ওলন্দাজ পর্যটকের ভ্রমণ বিবরণের কথা উল্লেখ করা যায়।ফান দের হেইডেন নামে একজন ওলন্দাজ কোম্পানি কর্মচারী ইন্দোনেশিয়ার বাটাভিয়া থেকে হুগলির উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন। পথিমধ্যে ঝড়ের কবলে পড়ে তাঁদের জাহাজ ডুবে যায়। ফান দের হেইডেন এবং তার প্রায় ৩০ জন সঙ্গী ছোট্ট একটি ডিঙিতে করে তীরে উঠতে সক্ষম হন। সেখানে গাছের পাতা ও অখাদ্য খেয়ে অর্ধাহারে সপ্তাহ খানেক পার করেন তাঁরা। এরপর বহু কষ্টে তাঁরা সন্দ্বীপ নামে বর্তমান বাংলাদেশের উপকূলীয় দ্বীপে পৌঁছান। সেখানে তাঁরা গ্রাম্য মোড়লের আতিথেয়তা পান। তাদের উৎকৃষ্ট মানের চালের ভাত এবং আরও অনেক রসনাময় খাবার দিয়ে আপ্যায়িত করা হয়। ফান দের হেইডেন তাঁর ভ্রমণ বিবরণীতে গ্রামের সমাজ, অর্থনীতি ও নারীদের অবস্থার বিবরণ দেন। তিনি তাঁর বিবরণীতে উল্লেখ করেন চাল, মাছ, মুরগি, কলা এবং বিভিন্ন ধরনের মাংস এখানে প্রায় পানির দামে পাওয়া যায়। আর এ এলাকার মানুষকে তিনি খুবই অতিথিপরায়ণ বলে বর্ণনা করেন।সন্দ্বীপে কয়েক দিন অবস্থান করার পর তিনি এবং তাঁর সঙ্গীরা ভুলুয়া হয়ে ঢাকায় ওলন্দাজ কারখানায় আসেন। ভুলুয়া সম্পর্কেও তাঁর লেখায় তথ্য রয়েছে।সেখানকার মোগল আঞ্চলিক প্রশাসকের প্রাসাদকে তিনি জমকালো হিসেবে উল্লেখ করেন। উল্লেখ্য, সতেরো শতকের প্রথম ভাগে ঢাকায় প্রাদেশিক রাজধানী স্থাপনের পর ভুলুয়ায় মোগলরা থানা প্রতিষ্ঠা করেন এবং কিছু সেনাসহ একজন থানাদার নিয়োগ দেওয়া হয়। বর্তমান বৃহত্তর নোয়াখালী জেলা একসময় ভুলুয়া নামে পরিচিত ছিল।ঢাকায় দু-এক দিন থেকে ফান দের হেইডেন এবং তাঁর সঙ্গীদের হুগলি যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাংলার সুবাদার মীর জুমলা তখন প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন আসাম অভিযানের। তিনি ভুক্তভোগী ওলন্দাজদের হুগলি না যেতে দিয়ে তাঁর সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলকভাবে অন্তর্ভুক্ত করে। বাংলার সুবাদারের সেনাদলে থাকার কারণে তিনি মীর জুমলার আসাম অভিযান, মোগল ফিল্ড আর্মি এবং যুদ্ধরীতি সম্পর্কে প্রভূত অভিজ্ঞতা লাভ করেন। এসব অভিজ্ঞতাই পাওয়া যায় ফান দের হেইডেনের ভ্রমণ বিবরণীতে।
শুধু ফান দের হেইডেনের ভ্রমণ বিবরণীই নয়, এই মহাফেজখানায় রক্ষিত আছে আরও অনেক ভ্রমণ বিবরণী, ঢাকা ডায়েরি, কোম্পানির, বার্ষিক প্রতিবেদন, লেজার বুক, মানচিত্র এবং চিঠিপত্রে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ঢাকা এবং পূর্ববঙ্গ সম্পর্কে অনেক বিচিত্র এবং প্রয়োজনীয় তথ্য। এর সবই সতেরো শতকের পূর্ববঙ্গ তথা বাংলাদেশ এবং ঢাকার ইতিহাস পুনর্গঠনে ঠিক সোনার খনির মতোই।
(রুপশী বাংলা নিউজ) ২৬ এপ্রিল /২০১৩.